X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিরোধীদলীয় নেতা এবং দেবর-ভাবির টানাপড়েন

আমীন আল রশীদ
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৪৪আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:১৪

আমীন আল রশীদ দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির লিগ্যাসি বহন করলেও জাতীয় পার্টি এক্ষেত্রে এককাঠি সরেস। আওয়ামী লীগে যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে অনেক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে তার মেয়ে শেখ হাসিনা এবং বিএনপিতে জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলীয় প্রধান হয়েছেন, জাতীয় পার্টিতে সেখানে দলীয় প্রধান এইচ এম এরশাদ জীবিত থাকতেই তার স্ত্রী রওশন এরশাদ ছিলেন দলের দ্বিতীয় প্রধান। সেই সঙ্গে এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদেরও দলের আরেক শীর্ষ নেতা। আবার এরশাদের মৃত্যুর পরে এখন শূন্য আসনে তার ছেলে সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দিতে চান রওশন। তবে এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থাতেই দলের নেতৃত্বের প্রশ্নে দেবর-ভাবির যে বিরোধ বা দ্বন্দ্বের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিলো, এরশাদের মৃত্যুর পরে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন,সেই ইস্যুতে আগুনটা দৃশ্যমান হলো।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন সংখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসেন। আর উপনেতা হন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। একই সংসদে স্বামী বিরোধীদলীয় নেতা আর স্ত্রী উপনেতা, এরকম ঘটনা বাংলাদেশে তো প্রথমই, বিশ্বের আর  কোনও দেশে এমন নজির আছে কিনা সন্দেহ। গত ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত‌্যুতে শুধু তার সংসদীয় আসনটিই নয়, বিরোধী দলীয় নেতার আসনও শূন‌্য হয়। ফলে এ দুটি জায়গায় কারা আসবেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিরোধ এবং আরও পরিষ্কার করে বললে দেবর-ভাবির লড়াই।  

সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার জন্য ৩ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) স্পিকারকে চিঠি দেন জিএম কাদের। এরশাদের মৃত্যুর পরে তিনি চেয়ারম্যান। যদিও দলের রওশনপন্থীরা এটি মানতে নারাজ। তারা চেয়ারম্যান মানেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে। যে কারণ জিএম কাদেরের এই চিঠির পরদিনই (বুধবার) স্পিকারকে পাল্টা চিঠি দেন রওশন এরশাদ। যেখানে জিএম কাদেরের চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা গ্রহণ না করার অনুরোধ করা হয়। রওশনপন্থীদের অভিযোগ,জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি কমিটির কোনও বৈঠক ছাড়া স্পিকারকে দেওয়া জিএম কাদেরের চিঠির কোনও দাম নেই। পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। একই দিন পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে জিএম কাদের বলেন,এরশাদের নির্দেশেই তিনি দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিরোধীদলীয় নেতা হতে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ দলের ২৫ জন এমপির মধ্যে ১৫ জন তার পক্ষে রয়েছেন বলেও দাবি করেন জিএম কাদের। উল্লেখ্য,মৃত্যুর কিছু দিন আগে এরশাদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার অবর্তমানে জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। যদিও তার মৃত্যুর পরে বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন, সে বিষয়ে তিনি কোনও সিদ্ধান্ত দিয়ে যাননি।

২.জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে ‘বিরোধী দলের নেতা’ বলতে ‘স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসঙ্গের নেতা’কে বোঝায়। অর্থাৎ সরকারি দলের পরেই যাদের আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং যারা সংসদে সরকারের বিরোধিতা করতে চায়, সেই দলের প্রধানই হচ্ছেন বিরোধীদলীয় নেতা। এরশাদ জীবিত থাকতে দলীয় প্রধান এবং একইসঙ্গে সংসদ সদস্য হওয়ায় তার বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে দলের চেয়ারম্যান কে, সেই প্রশ্নে দলীয় নেতারা যেহেতু এখনও একমত হননি, ফলে সংসদে কে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যোগ্য, সেটি বিবেচনার বিষয়। সেই বিবেচনার এখতিয়ার স্পিকারের রয়েছে। কিন্তু তার আগে সংশ্লিষ্ট দল থেকেই এ বিষয়ে স্পিকারকে নিশ্চিত করতে হবে তারা অমুককে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে চান। কিন্তু এখন জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, এবং যদি জিএম কাদেরকে দলের একটি প্রভাবশালী অংশ দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে না নেন এবং যদি রওশন এরশাদও নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা দাবি করে স্পিকারকে চিঠি দেন, সেই জটিলতা নিরসনের দায়িত্ব আখেরে স্পিকারের ওপরেই বর্তাবে। এখানে মনে রাখা দরকার, সরকারবিরোধী দলের প্রধানকেই যে বিরোধীদলীয় নেতা হতে হবে, এমন কোনও বিধান নেই। কারণ, দশম সংসদে দেখা গেছে, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে কাটিয়ে দিয়েছেন পুরো পাঁচ বছর এবং ওই সময়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা রওশন এরশাদ। অর্থাৎ তখন দল থেকেই এই সিদ্ধান্ত স্পিকারকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু এবার যে জটিলতা সৃষ্টি হলো সেটি শেষমেশ স্পিকার সুরাহা করবেন নাকি এখানে সংসদ নেতার (প্রধানমন্ত্রী) গ্রিন সিগন্যাল লাগবে, সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।

সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদলীয় নেতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। Dictionary of Government & Politics-এ বিরোধীদলীয় নেতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Head of the largest party opposing the Government…‘পার্লামেন্টারি শব্দকোষ’ (জালাল ফিরোজ, পৃষ্ঠা ১৩০)-এ বলা হয়েছে, সংসদের সাফল্যজনক পরিচালনা অনেকাংশে নির্ভর করে বিরোধীদলীয় নেতার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতার ওপর। এ কারণে সাধারণত অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এমপিকেই বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়। বাংলাদেশসহ প্রায় সব সংসদীয় ব্যবস্থার রাষ্ট্রে বিরোধীদলীয় নেতাকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। তিনি পূর্ণকালীন অফিস ও স্টাফ পান। আইন প্রণয়ন, সংসদীয় বিতর্ক ও সংকটকালে বিরোধীদলীয় নেতা ‘বিকল্প প্রধানমন্ত্রী’র দায়িত্ব পালন করেন।

এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন বিরোধীদলীয় নেতা কবে বা কোন সংসদে ছিলেন? বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরে প্রথম সংসদে কোনও বিরোধীদলীয় নেতাই ছিলেন না। বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠিত অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ষষ্ঠ সংসদেও বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন না। এর বাইরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা থাকলেও যেহেতু ওই সময়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ছিল, ফলে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরে পঞ্চম সংসদ থেকে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হলে বিরোধীদলীয় নেতার পদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশের প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া—উভয়ই বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল  জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এর বাইরে এখন যে প্রশ্নটি আরও বেশি সামনে আসছে তা হলো, গত তিনটি মেয়াদে (নবম, দশম ও একাদশ) যে ধরনের সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে এখানে বিরোধীদলীয় নেতা কে হলেন তাতে আখেরে খুব বেশি কিছু এসে যায় কিনা? সামান্য সংখ্যক সদস্য নিয়ে তিনি আসলে কী করতে পারেন বা কতটুকু বিরোধিতা করতে পারেন? তাছাড়া সেই বিরোধিতা সরকারি দল কতটুকু আমলে নেবে, সেটিও প্রশ্ন। মনে রাখা দরকার, সংসদ কতটুকু কার্যকর হবে সেটি প্রধানত নির্ভর করে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অর্থাৎ সরকারি দলের ওপর। সেই সঙ্গে বিরোধী দলের আসন সংখ্যা, অর্থাৎ সরকারি দলের সঙ্গে তাদের আনুপাতিক হার আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদে বয়কটের সংস্কৃতি চালু থাকার পরও সংসদ তুলনামূলক কার্যকর ও প্রাণবন্ত ছিল। কারণ, ওই সংসদগুলোয় সরকারি ও বিরোধী দলের আসন সংখ্যায় একটা ভারসাম্য ছিল। কিন্তু বর্তমান সংসদে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত আসনসহ ৩০০ আসন নিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সর্বমোট আসন ২৫। এর আগে দশম ও নবম সংসদেও সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে আসনের ব্যবধান ছিল আকাশ-পাতাল। অর্থাৎ কোনও ভারসাম্য ছিল না। সুতরাং ৩০০ এমপির বিপরীতে মাত্র ২৫ জন এমপি কী বিরোধিতা করবেন আর তাদের বিরোধীদলীয় নেতাই বা কতটুকু ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’ হতে পারবেন?

লেখক:  বার্তা সম্পাদকচ্যানেল টোয়েন্টিফোর

 

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ