X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

চীনা দূতাবাসের ক্ষমা চাওয়া ও বিএনপির রাজনীতির ব্যারোমিটার

স্বদেশ রায়
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৫৯আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৩৯

স্বদেশ রায় বিএনপির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলে থাকেন, তাইওয়ানে ট্রেড মিশন খোলার অনুমতি দেওয়াই বিএনপির রাজনৈতিক জীবনে সব থেকে বড় ভুল হয়েছিল। এর ফলে বিএনপি বাস্তবে চীনের ‘এক চীন নীতির’ বিরুদ্ধে যায়। চীন যে তাইওয়ানের আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করে না তাদের অংশ মনে করে, সেটাকে বিএনপি অস্বীকার করে। যে কারণেই চীন বিএনপির থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগের দিকে যায়। আর এটাই বিএনপির মিত্রহীন হওয়ার কারণ বলে তারা মনে করেন। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিএনপি কখনও ভারতের সমর্থন পাবে না। ভারতের বিন্দুমাত্র বন্ধুত্ব পেতে হলে তাদের পাকিস্তানের বন্ধুত্ব শতভাগ ছাড়তে হবে। বিএনপির পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ইউরোপের আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আবহওয়ায় বিএনপির প্রবেশের সুযোগ কম। কারণ, উদার গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ইউরোপীয় আধুনিক গণতন্ত্রের সহজাত মিত্র। সেখানে সামরিক সরকারের দল হিসেবে বিএনপিকে তারা নিম্নবর্গীয় বলেই মনে করে। তাদের কাছে বিএনপি কোনোদিন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মর্যাদা পাবে না। অন্যদিকে বিএনপির গায়ে লাগানো আছে মুসলিম মৌলবাদের গন্ধ। তাই ৯/১১ এর পর থেকে বিএনপি পশ্চিমাদের কাছে একটি নিষিদ্ধ ফলের মতোই। আমেরিকার কূটনীতি যতই দ্বিচারিতায় ভরা হোক না কেন, ৯/১১ এর পর থেকে তাদের কাছে বিএনপিও নিষিদ্ধ ফল। তারা বাংলাদেশে জামায়াত বা বিএনপিকে যে আসকারাটা দেয় সেটা অনেকখানি জঙ্গি মৌলবাদীদের সঙ্গে যতটুকু যোগাযোগ রাখতে হয় ততটুকুই। এর বেশি কিছু নয়। তারা স্পষ্ট জানে সুইডেন থেকে শুরু করে আমেরিকা পর্যন্ত যত জঙ্গি হামলা হয়েছে তার প্রায় সবকটিতে পাকিস্তানে ট্রেনিং নেওয়া জঙ্গি ছিল। তাই নতুন করে আরেকটি পাকিস্তান তারা বানাতে চায় না। বরং জঙ্গিদের তাদের কখনও কখনও কাজে লাগে এ কারণে জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গে ততটুকু সংযোগ তারা রক্ষা করে চলে। বিএনপির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও এটা অনেক ভালো বোঝেন।

তাই বিএনপির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সব সময়ই মনে করেন, তাইওয়ানে ট্রেড মিশন খোলার অনুমতি দিয়ে এক চীন নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে বিএনপি তাদের কপাল পুড়িয়েছে। কারণ, সত্যি অর্থে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন ছাড়া বিএনপির বড় কোনও বন্ধু ছিল না। সেই বন্ধু দূরে সরে যাওয়ার কারণেই বিএনপি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। এখন পাকিস্তান ছাড়া তাদের কোনও বন্ধু নেই। এমনকি এক সময়ে আরব রাষ্ট্রগুলো যে বিএনপির বড় মিত্র ছিল, তারাও গত দশ বছরে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। সৌদিসহ অনেক আরব রাষ্ট্র এখন আওয়ামী লীগের অনেক বড় মিত্র। এমনকি তারা পাকিস্তানের থেকে ভারতের বড় মিত্র। এমতাবস্থায় বিএনপি গত ১৫ আগস্ট হঠাৎ করেই যেন তাদের বগি টেনে নেওয়ার নতুন ইঞ্জিন পেয়েছিল। ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার মিথ্যা জন্মদিবসে চীনা দূতাবাস থেকে ফুল ও উপহারসামগ্রী পাঠানোর পর থেকেই চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল বিএনপি। মনে করেছিল, তাদের বধুঁয়া আন বাড়ি রেখে আবার তাদের বাড়িতে আসছে। শুধু বিএনপি নয়, দেশের অনেকেই মনে করেছিল চীন আবার বিএনপির দিকে ঝুঁকেছে। 

বিশিষ্ট প্রবীণ সাংবাদিক ও মানবজমিনের উপদেষ্টা সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তার এক কলামে এমনই লিখেছিলেন—১৫ আগস্ট শেখ হাসিনার একটি সেনসেটিভ দিন, কিন্তু তারপরেও সেই স্পর্শকাতরতার গুরুত্ব না দিয়ে চীন প্রকাশ্যে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা পাঠানোর মধ্য দিয়ে নতুন বার্তা দিলো, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মোড়। মতিউর রহমান চৌধুরীর মতো অনেকেই মনে করেছিলেন, চীন তাদের অবস্থান বদল করছে। অর্থাৎ এতদিন শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে তারা যে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে চলছে সেখান থেকে তারা সরে গেলো। তারা এখন শেখ হাসিনার ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বা তাদের প্রকৃত অবস্থান জানিয়ে দেওয়ার জন্য এ কাজটি করলো। 

কিন্তু এর পরপরই তিন সপ্তাহের মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটলো। এক. বিএনপির খোলা সেই তাইওয়ানের ট্রেড মিশন থেকে বাংলাদেশের কোম্পানি ওয়ালটনকে কিছু করোনা বিষয়ক সামগ্রী দেওয়ার একটা অনুষ্ঠান হয়। সেখানে তাইওয়ানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীও ছিলেন। এ নিয়ে চীনের দূতাবাস থেকে প্রতিবাদ জানালে বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে বিশ্বাস করে। তবে ওই দুই মন্ত্রীকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেই কোনও কিছুই বলা হয় না। বরং যেটা জানা যায় তা হলো, বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে যেমন বিশ্বাস করে তেমনি তাইওয়ানের সঙ্গে ট্রেড মিশন নিয়েও চলবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, কেন তাদের দূতাবাস ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবসের প্রতিপক্ষকে এভাবে শুভেচ্ছা জানিয়ে মূলত বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবসকে অবমাননা করলো? 

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বাংলাদেশের সরকারের এ বার্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে তা শেষ পর্যন্ত বোঝা গেলো। ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস ক্ষমা প্রার্থনা করলো তাদের ১৫ আগস্টের অমার্জনীয় ভুলের জন্য। তারা স্বীকার করলো বেগম জিয়ার মিথ্যা জন্ম দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে তারা ভুল করেছে। এজন্য তারা ক্ষমাপ্রার্থী। 

চীনের এই ক্ষমা প্রার্থনার ভেতর দিয়ে দুটো বিষয় প্রমাণিত হলো। এক, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চীনের কাছে মোটেই কোনোরূপ নতজানু নয়। কিছু অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এখন চীনের অর্থ ছাড়া বিকল্প নেই। সেজন্য চীনের প্রতি অনুগত থাকতে হবে বাংলাদেশ
সরকারকে। এদের বিপরীতে গিয়ে সরকার বলে দিলো, তারা তেমনটি মনে করেন না। বাস্তবে তেমনটি মনে করার কোনও কারণ নেই। চীনের একক বিনিয়োগে কোনও দেশেরই অর্থনীতি গড়ে উঠতে পারে না। বরং সেটা চীনের একটি অর্থনৈতিক কলোনি হবে। বাংলাদেশের সুষম উন্নয়নের জন্য বিশ্ব আর্থিক সংস্থাগুলোর বিনিয়োগ, দীর্ঘ দিনের বন্ধু জাপানের বিনিয়োগ এবং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বের বিনিয়োগ বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে। দৃষ্টি রাখতে হবে প্রশাসনিক কিছু কিছু কর্মকর্তার অনৈতিকতার কারণে অনেক সময় চীনের বিনিয়োগ দেশে ঢুকাতে গিয়ে জাপানের অনেক সফট বিনিয়োগ যেন চলে না যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাপানের মতো ভালো বিনিয়োগকারী বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগও পাওয়া যায়। এমনকি জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মি. আবেও বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। যাহোক, বাংলাদেশ সরকার যে শুধুমাত্র চীনের বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল নয়, সরকার যেমন প্রয়োজনে বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে তেমনি চীনের ওপরও কঠোর হতে পারে সেটা প্রমাণ করে দিলো। দ্বিতীয়ত চীনের এই ক্ষমা প্রার্থনার ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হলো, চীনের কাছে বেগম জিয়ার তথাকথিত জন্মদিন বা বিএনপি এখন কোনও গুরুত্ববহন করে না। তাদের সব থেকে বড় প্রয়োজন বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা। এ কারণে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাদের দূতাবাস ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ নয়, যে কর্মকর্তারা এই ভুল করেছে তাদের এ ভুলের জন্য চীনা সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বলেও মনে করছে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আর বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার স্বার্থে চীন এটাই করবে। কারণ এ মুহূর্তে চীন নিজে খুব সুবিধাজনক স্থানে নেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখার পরিসর বড় হয়ে যাবে ও প্রসঙ্গান্তরে চলে যাবে। তবে গত একমাসে চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে, আরব বিশ্বে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অনেক বন্ধুত্ব হারিয়েছে। আফ্রিকা গত কয়েক বছর হচ্ছে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে আগের থেকে অনেক বেশি সতর্ক। এমনকি শ্রীলংকার নতুন সরকার বলেছে, চীনের অর্থে হাম্বানটোটা বন্দর তৈরি ছিল তাদের ভুল সিদ্ধান্ত। এবং তাদের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’। এমতাবস্থায় চীনের জন্য বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা অনেক জরুরি। আর সে কারণেই এই ক্ষমা প্রার্থনা। 

চীনের এই ক্ষমা প্রার্থনার ভেতর দিয়ে এতক্ষণে বিএনপির যে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতারা উজ্জীবিত হয়েছিলেন তারা মনে হয় অনেকখানি চুপসে গেছেন। বাস্তবে তাদের চুপসে যাওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই। কারণ, চীন শুধু শেখ হাসিনার সরকারের কাছে ক্ষমা চায়নি, তারা এর ভেতর দিয়ে বিএনপিকেও জানিয়ে দিলো, বিএনপি তাদের জন্য মোটেই প্রয়োজনীয় কিছু নয়। অর্থাৎ বিএনপির এখন হারাধনের শেষ সন্তানের মতো হাতে আছে শুধু পাকিস্তান। আর পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে যে বাংলাদেশের ক্ষমতায় যাওয়া যায় না তা নতুন করে বলার কোনও দরকার নেই। তাই বাস্তবে চীনের এই ক্ষমা প্রার্থনার ভেতর দিয়ে বিএনপির রাজনীতির ব্যরোমিটারের পারদ এখন মাইনাস স্কেলেই চলে গেলো। এই মাইনাস স্কেলে বসে শীত নিদ্রাও কতটা সম্ভব তাও বলা কঠিন। মাইনাস স্কেলে একমাত্র ফসিল হিসেবেই টিকে থাকা যায়। তাই বিএনপি এখন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অতীতের ফসিল হিসেবে অবস্থান নিতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আর কোনও ভুল নেই।  

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ