X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

যার হাত ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলা, ফিরে আসে ‘জয় বাংলা’

সালমান তারেক শাকিল ও তৌহিদ জামান
২৯ আগস্ট ২০২৩, ০২:৫১আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ১৯:০৯

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের শেষ দিকে নতুন উত্তাপ নিয়ে হাজির হয়েছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ‘খবরের কাগজ’ শীর্ষক সাপ্তাহিকীর নতুন উদ্যোক্তা তখন এক স্বপ্নে বিভোর। এই স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়া এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া মুক্তির গল্প। যে গল্প ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভের। যে গল্প ছিল হাজার বছরের বাঙালির কাঙ্ক্ষিত মুক্তির, ‘জয় বাংলা’র।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনকের হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে এই গল্প ছিল অচেনা। হারিয়ে যাওয়া সেই মুক্তি আর ‘জয় বাংলা’কে সাড়ম্বরে ফিরিয়ে এনেছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। সোমবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় প্রয়াত কাজী শাহেদ আহমেদ কেবল এখানেই নিজের লড়াইকে থামিয়ে রাখেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নিজেই দায়ের করেছিলেন প্রথম মামলা। নিজের আপন ছোট ভাইকে হত্যার দায়ে একাত্তরে পাকিস্তানের দোসর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যশোরে মামলা করেছিলেন।

১৯৯৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর যশোর জজকোর্টে নিজের ২০ বছরের ছোট ভাই কাজী মঈনুল হাসানকে হত্যার জন্য গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে মামলা করেন। সেদিন তার সঙ্গে ঢাকা থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও যশোরের টিপু সুলতান ছিলেন।

স্থানীয়রা জানান, সেদিন মিছিলসহ জজকোর্টে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করেন কাজী শাহেদ আহমেদ।

এই মামলা করার পরিস্থিতিও খুব সহজে ধরা দেয়নি কাজী শাহেদ আহমেদের কাছে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, দৈনিক আজকের কাগজ প্রকাশের মধ্য দিয়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে নতুন করে যে উজ্জীবনী সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সাহসেই তিনি ১৯৯৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার মনস্থির করেন। 

১৯৯৩ সালের ৩০ আগস্ট প্রকাশিত ‘খবরের কাগজ’ সংখ্যা

স্বরচিত ‘জীবনের শিলালিপি’তে কাজী শাহেদ আহমেদ লিখছেন, ‘এ অবস্থায় একদিন ঠিক করে ফেললাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মামলাটা আমি নিজেই করবো। আমার এ মামলা গোলাম আযমের বিরুদ্ধে হবে। মামলাটি কোথায় করবো এবং কেন করবো? যশোরে করবো কারণ সেখানেই আমার ভাই কাজী মঈনুল হাসানকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সে হত্যার জন্য গোলাম আযম দায়ী।’

এ বিষয়ে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘যত দূর মনে পড়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রথম দাবি তার প্রকাশিত দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায় উঠে এসেছিল। তারও আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলাটি যশোরে হয়েছিল। কাজী শাহেদ আহমেদের ছোট ভাই মঈন সাহেব ১৯৭১ সালে শহীদ হয়েছিলন। ওই ঘটনায় যশোর আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ।’

তিনি বলেন, ‘সেই মামলার আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। ওই মামলার পথ ধরেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ শুরু হয়। সেই বিচারে বাংলাদেশে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এর সব কৃতিত্ব কাজী শাহেদ আহমেদের। তার মৃত্যু আমাদের পথপ্রদর্শক শূন্য করেছে। গভীর শোক জ্ঞাপন করছি।’

মামলা করার আগে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে স্বরচিত বই ‘জীবনের শিলালিপি’তে কাজী শাহেদ আহমেদ বলছেন, ‘আমি এই প্রস্তাবনা নিয়ে প্রথমে গেলাম শেখ হাসিনার কাছে তার সম্মতি জানার জন্য। উনি আমার কথাগুলো অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে শুনলেন। এ সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। তবে তিনি মামলার কথায় খুবই খুশি হলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে গেলাম খালেদা জিয়ার কাছে। তাকেও পুরো ঘটনাটা বললাম। তিনি আমার কথা শুনে শুধু বললেন, এটা আপনার অধিকার। আপনি মামলা করতেই পারেন।’

গ্রন্থে শাহেদ আহমেদ আরও উল্লেখ করেন, “আমার যা বোঝার তা বুঝে গেলাম। তারপর গেলাম জেনারেল নাসিমের কাছে। তিনি তখন ডিজিএফআই প্রধান। তাকে পুরো ঘটনা বলা হলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে স্যালুট করে বললেন, ‘শাহেদ ভাই, কাজটা তো কাউকে না কাউকে করতে হতো। আপনিই করেন।”

তিনি লিখেন, ‘এরপর আমার শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। জেনারেল নাসিমের কাছ থেকে চলে এসে যশোর যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলাম।’

ওই মামলা নিয়ে শাহেদ আহমেদকে স্থানীয় পুলিশ থেকে জানানো হয়েছিল, তারা কোনও সাক্ষী-সাবুদ পাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘জীবনের শিলালিপি’তে শাহেদ আহমেদ বলেন, ‘আমি তাতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করি না। কাজ যেটা করার তা করে ফেলেছি। সেই ঘটনার দুই দশক পর শেখ হাসিনার সরকারই এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে এবং তা চলমান আছে। রায় বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রতিটি গর্বিত বাঙালির মতো আমার জন্যও এটা বিশাল একটা পাওয়া।’

যেভাবে ফিরে আসে জয় বাংলা

ফিরে আসেজয় বাংলা

“আমার অনেক দিনের ইচ্ছে পত্রিকায় আবার ‘জাতির পিতা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, আর ‘বাঙালি’ এই শব্দগুলো নিয়মিত ছাপা হবে। নতুন প্রজন্ম জানবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে লেখা হবে। মানে ম্রিয়মাণ মুক্তিযোদ্ধাদের আবার জাগাতে হবে। বিপ্লব ঘটাতে হবে, ১৬ ডিসেম্বর আবার ফেরত আনতে হবে।” কথাগুলো কাজী শাহেদ আহমেদের। স্বরচিত ‘জীবনের শিলালিলিপি’ গ্রন্থে তিনি তার পত্রিকা প্রকাশের পেছনে যে আকাঙ্ক্ষা তা এভাবেই উল্লেখ করেন।

১৯৮৮ সালে সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বের করার পর কাজী শাহেদ আহমেদকে প্রকাশনার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন। এরপর কাজী শাহেদ আহমেদ পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাপ্তাহিকীর কার্যালয় করেন নিজের ব্যবসায়িক অফিসে।

খবরের কাগজ যখন পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখনই সামরিক শাসক এরশাদের তোপের মুখে পড়ে পত্রিকাটি। নিষিদ্ধ হয়। যদিও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের রায়ে রাহুগ্রাস মুক্ত হয় খবরের কাগজ।

১৯৯০ সালের ২৫ অক্টোবর খবরের কাগজের সংখ্যায় বের হলো ‘জয় বাংলা’।  প্রচ্ছদে লেখা ছিল, ‘জয় বাংলা’ বাঙালিদের জাতীয় স্লোগান। এই স্লোগানের কোনোরকম পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন তথা বিকৃতিকরণ একটি ক্ষমাহীন জাতীয় অপরাধ।’

কাজী শাহেদ আহমেদ তার আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘এই সংখ্যার খবরের কাগজ সারা জাতিকে কাঁপিয়ে দিলো। এমনকি আওয়ামী লীগও কেঁপে গেলো।’

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার তখন কারফিউ জারি করেছে। ‘চারদিকে বিপ্লব আর বিদ্রোহ’ এই শিরোনামে খবরের কাগজ বেরুনোর পর রাষ্ট্রীয় চাপ বাড়ে। একদিন অফিসে তালা লাগিয়ে সবাই পালিয়ে যান। কিছুদিন পরই এরশাদের পতন হয়।

বহুত আলোচিত ব্যঙ্গচিত্র ‘তুই রাজাকার’

বহুল আলোচিততুই রাজাকার

১৯৯১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজকের কাগজ বাজারে আসে। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর দৈনিকটিতে ‘তুই রাজাকার’ নামে নতুন সিরিজ প্রকাশ শুরু হয়। একাত্তরের পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের ব্যঙ্গ করে আঁকা কার্টুনে অলঙ্কৃত এই সিরিজটি সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ওই সিরিজ প্রকাশের পর দেশের মৌলবাদীরাও কাজী শাহেদ আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠে। আজকের কাগজ পত্রিকা অভিমুখে তখন রাজাকারদের দোসররা বিক্ষোভ মিছিলও করেছিল।

‘তুই রাজাকার’ সিরিজে গোলাম আযম, আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা আবদুর রহিম, আবদুস সবুর খানসহ অনেক পাকিস্তানি দোসরের ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হয়।

/আরআইজে/এফএস/
টাইমলাইন: কাজী শাহেদ আহমেদের জীবনাবসান
২৯ আগস্ট ২০২৩, ০৪:০৪
২৯ আগস্ট ২০২৩, ০২:৫১
যার হাত ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলা, ফিরে আসে ‘জয় বাংলা’
সম্পর্কিত
স্মরণসভায় বক্তারাস্রোতের বিপরীতে নির্ভয়ে কাজ করে গেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ
কাজী শাহেদ আহমেদের স্মরণসভা শুক্রবার
স্মরণসভায় বক্তারা‘নিষ্ঠা ও প্রেরণার বাতিঘর কাজী শাহেদ আহমেদ’
সর্বশেষ খবর
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
সর্বাধিক পঠিত
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার