X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লকডাউন থামলেও মৃত্যু থামেনি

প্রভাষ আমিন
১৫ জুলাই ২০২১, ১৫:৪৫আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২১, ২০:১৫

প্রভাষ আমিন মোহাম্মদপুর থেকে কাওরানবাজার, আমার বাসা থেকে অফিসে আসতে কঠোর লকডাউনে ১০ মিনিট, সাধারণ সময়ে ২০ মিনিট লাগে। আজ লেগেছে দুই ঘণ্টা। ঈদ উপলক্ষে ৭ দিন লকডাউন শিথিলের সুযোগে ঢাকার সব মানুষ যেন ঘরের বাইরে চলে এসেছেন। রাস্তাঘাট, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন, ব্যাংক, শপিং মল দেখলে বোঝার উপায় নেই বাংলাদেশ করোনার সবচেয়ে ভয়ংকর সময় পার করছে, আগের দিনও মারা গেছেন ২১০ জন। মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক স্থিতিশীল হয়ে আছে বেশ কয়েক দিন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণের হারও। বিখ্যাত কবিতা ‘জেলখানার চিঠি’তে নাজিম হিকমত লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর মাত্র ১ বছর!’ এখন লিখলে হয়তো লিখতেন এক মাস বা এক ঘণ্টা। মৃত্যুর পাশেই চলে জীবনের বিপুল আয়োজন। আর এটা সত্যি, সময়ই সবচেয়ে বড় উপশমকারী। গত বছর মার্চে প্রথম যখন করোনায় একজনের মৃত্যুর খবর এলো, সরকারের ঘোষণার অপেক্ষা করেনি, মানুষ ভয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু এখন মৃত্যুর ডাবল সেঞ্চুরিও যেন গা-সওয়া।

উভয় সংকট বলে একটা কথা আছে, কিন্তু সরকারের সংকট নিছক উভয় নয়, বহুমুখী। জাতীয় পরামর্শক কমিটি যখন কারফিউ জারির পরামর্শ দিয়েছে, সরকারকে তখন লকডাউন শিথিলের ঘোষণা দিতে হয়েছে। পরামর্শক কমিটি নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। প্রতিদিন দুইশ’ মৃত্যু আর ৩০ ভাগ সংক্রমণের হার নিয়ে আসলে কারফিউই দরকার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঈদের সময়, বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় কারফিউ দিয়েও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা মুশকিল। আগের ঈদের সময়কার অভিজ্ঞতা বলে, আটকে রাখার চেষ্টা করলেই বরং মানুষ আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে যায়। যেকোনোভাবে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। তারচেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে চলাচলের সুযোগ দিলে ঝুঁকি কিছুটা হলেও কম থাকবে। তবে বাস্তবতা হলো, দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউনে পরিস্থিতি যতটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে এক সপ্তাহ খোলা থাকলে পরিস্থিতি তারচেয়ে অনেক বেশি খারাপ হবে। এ যেন সেই তৈলাক্ত বাঁশের গল্প।

যতটুকু ওঠে, নেমে যায় তারচেয়ে বেশি। আর সরকারকে তো শুধু পরামর্শক কমিটির কথা শুনলে চলে না। জীবনের পাশাপাশি মানুষের জীবিকার কথাও ভাবতে হয় তাদের। লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ দিলেই গার্মেন্ট, শিল্প-কারখানা, দোকান মালিক, পরিবহন শ্রমিক- একের পর এক খুলে দেওয়ার দাবি আসতে থাকে। এ-কূল রক্ষা করতে গেলে ও-কূল ভেঙে যায়, সরকারের এমন টানাপড়েন দশা। তবে আমি সব সময় বলি, করোনা মোকাবিলার দায়িত্ব একা সরকারের নয়। সরকার নানামুখী চেষ্টা করবে বটে, তবে এ লড়াই জিততে হলে সরকারকে আমাদের সবার সহায়তা করতে হবে। যত কঠোরই হোক, লকডাউন দিয়ে করোনা ঠেকানো যাবে না। আসলে করোনা পুরোপুরি ঠেকানো অত সহজ নয়। দুটি উপায় আছে- মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া। দ্বিতীয় উপায়টি অনেক কঠিন, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। সরকার নানা উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। কিন্তু টাকা থাকলেও টিকা পাওয়া অত সহজ নয়। আর পেলেও প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে অন্তত ৫ বছর সময় লাগবে।

কিন্তু পাঁচ বছর তো আর লকডাউন থাকবে না। তাই আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। সরকার বলুক আর না বলুক, লকডাউন থাকুক আর না থাকুক; সুরক্ষিত থাকতে হলে আমাদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। শেষ পর্যন্ত জীবনটা কিন্তু আপনারই, সরকারের নয়। আপনি বা আমি করোনায় মারা গেলে পরিসংখ্যানে আরও এক যোগ হবে মাত্র। সরকারের কোনও ক্ষতিই হবে না। কিন্তু আমার বা আপনার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। তাই নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটাই আমাদের মাথায় নেই।

লকডাউন দিলে আমরা সরকারের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলি। আর্মি-পুলিশের ভয়ে বড় রাস্তায় না উঠলেও অলিতে-গলিতে জীবনযাত্রা একদম স্বাভাবিক। যেন গলিতে করোনা নেই। হাজারটা অজুহাত নিয়ে আমরা ঘর থেকে বের হই। আমরা ঘর থেকে বেরুলে, ঝুঁকি তো আমারই। আমরা পুলিশকে অল্প ভয় পাই, সেনাবাহিনীকে বেশি ভয় পাই, টিভি ক্যামেরা দেখলে লজ্জা পাই। কিন্তু করোনাকে একদমই ভয় পাই না। পুলিশ না হয় জরিমানা করবে, ধরে নিয়ে যাবে বা দুটি লাঠির আঘাত দেবে। কিন্তু করোনা ধরলে তো আপনার জীবন কেড়ে নেবে। আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, কোনটা বেশি ভয়ংকর- পুলিশ না করোনা? এই যে আজ লকডাউন তুলে নেওয়ার পরক্ষণেই আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনার বেরুনোর কাজটা কি অতি জরুরি ছিল? নাকি ঘরে থেকেও সেরে নিতে পারতেন।

কোরবানির ঈদ কিন্তু করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ, কোরবানির জন্য পশু কিনতে আমরা দলবেঁধে পশুর হাটে যাবো। তারপর সেটাকে বাড়ি আনা, জবাই করা, তৈরি করা, মাংস বণ্টন করা- সব পর্যায়েই অনেক মানুষের অংশগ্রহণ। আর অনেক মানুষ মানেই অনেক করোনার ঝুঁকি। তাই ঈদের পর আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার নিরুপায় হয়ে লকডাউন তুলে নিয়েছে বটে। কিন্তু লকডাউন নেই মানে করোনা নেই, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। লকডাউন থামলেও মৃত্যুর মিছিল কিন্তু থামেনি। ঈদের পর পরিস্থিতির অবনতির যে আশঙ্কা, সেই আশঙ্কা যেন আপনার ক্ষেত্রে সত্যি না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু আপনারই। আপনি মাস্ক পরুন, জনসমাগম এড়িয়ে চলুন, ঈদে আনন্দ না হয় একটু কম করুন। যতই জীবিকার প্রশ্ন আসুক, শেষ পর্যন্ত জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেঁচে থাকলে আরও অনেক ঈদ করা যাবে, নতুন করে সাজানো যাবে জীবন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ