X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

কোথায় ঈদ করছে সুবোধ’রা?

তপন মাহমুদ
২৭ জুন ২০১৭, ১৫:৫৯আপডেট : ২৭ জুন ২০১৭, ১৬:০০

তপন মাহমুদ জানি না, এতদিনে এই শহর থেকে সুবোধ পালাতে পেরেছে কিনা।  এখন সত্যিই সে কোথায়? এই ফাঁকা ঢাকায়, নাকি গ্রামের কোনও মেঠো পথে সুখের খোঁজ করছে সে? নাকি পথে যেতে যেতে অন্য কোথাও হারিয়ে গেলো? নানা প্রশ্ন মাথায় খেলা করছে! সুবোধ আসলে এই ঈদ কোথায় করছে? নাকি এবারের উৎসব তাকে খুব একটা টানতে পারছে না।
হতে পারে পাহাড়ের কষ্ট দেখে, সেখানেই চলে গেলো সে।  অথবা হাওরে নিরন্ন মানুষের খোঁজ নিতে গেছে।  সাথে নিয়ে গেছে তার স্বল্প সম্বল।  তবে, জীবনের সাধ ভুলে কতটা পেরেছে তাও কে জানে!
এই ক’দিনে কোটি কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের পথে পাঁ বাড়িয়েছে।  টিকেট পাওয়ার কষ্ট, চলতি পথের ঝক্কি সব পায়ে ঠেলেছে শুধু আপন জনের কাছে একটু ভালোবাসার উষ্ণতা পাওয়ার আশায়।  গ্রামের মাটির পথে খালি পায়ে কয়েক পাঁ হেঁটে ভোলার চেষ্টা করছেন ‘শত সহস্র বছরে’র নাগরিক ক্লান্তি। গাড়ির অসহ্য শব্দযন্ত্রণা থেকে অল্প সময়ের জন্য হলেও তো মুক্তি! হর্নের আওয়াজ নয়, ঘুম ভাঙবে পাখির ডাকে।  ইট কাঠের নাগরিক দৃশ্যের বদলে ক্ষণিকের জন্য হলেও শীতলতা দেবে সবুজ শ্যামল গ্রাম।  নিঃশ্বাস জুড়ে নির্মল বায়ু।

কিন্তু একটা দুশ্চিন্তা ঈদের আনন্দেও হুল ফুটিয়েছে ঘরে ফেরা মানুষগুলোকে। তাকে আবার ফিরতে হবে চেনা শহরের অচেনা বিভ্রমে।  যন্ত্রণার জীবনে, যে জীবন তাকে বেঁধে নিয়েছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। চাইলেই এ চক্রব্যুহ থেকে তার মুক্তি নেই।  তাকে আবার জড়াতে হবে ইট-কাঠের জঞ্জালে।

বহু মানুষের কাছে আমাদের গ্রামগুলো হলো জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’।  দু’দণ্ড শান্তির খোঁজেই সেখানে যাই আমরা, আমাদের যেতে হয়।  হয়তো প্রিয়জনের আবেগ ভরা প্রশ্ন ‘এতদিন কোথায় ছিলে? উত্তর কারো কাছে থাকে না।  কারণ আমাদের ফিরতে হয় এই শহরের ‘বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে’। অর্থ যশ খ্যাতি বা ক্ষমতার ‘ঘাইহরিণীর’ ডাক শুনে গ্রাম থেকে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসি আমরা।  আর এই শহর, এই সময় আমাদের শিকার করে নেয়।  তখন আমরা ভিন্ন মানুষ হয়ে যাই।  ‘বিপন্ন বিস্ময়ে’র ঘোরেই আমাদের দিন কাটে।  এই শহরে গ্রামের মানুষগুলো তাই সারাজীবন ‘আউটসাইডার’ হয়েই থেকে যায়।  আমাদের জীবনটাও আসলে লেখক থমাস উলভের ‘ইউ কান্ট গো হোম অ্যগেইন’ উপন্যাসের মতই যাদের কখনও আর ঘরে ফেরা হয় না।

আসলে এই শহর - নাগরিক জীবন এমনই মায়াজাল পেতে রেখেছে, কারও সাধ্য নেই তা ছেঁড়ার।  পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলালে এমন লাখো কোটি মানুষের খোঁজ পাওয়া যাবে, যাদের এই শহর ঠকাচ্ছে।  তবু এক অদ্ভুত গতিময়তা তাদের সব সময় টেনে রাখেছে কেন্দ্রের দিকে।  যেতে দিচ্ছে না প্রান্তে।  তারা হয়তো প্রতিদিনই পালানোর পথ খোঁজে।  কিন্তু অন্ধ কানা গলি ছাড়া আর কিছুই পায় না।  কারণ এই শহর ক্ষমতাশালীদের, তাদের আত্মীয় পরিজনের।  এই শহর সুবিধাবাদীদের।  যারা নীতি ভুলে দুর্নীতিকেই জীবনে ব্রত করে নিয়েছে তাদের।  হয়তো সংখ্যায় এরা কম, কিন্তু ক্ষমতায় এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

তাই তো, কে বা কারা এই শহর থেকে সুবোধ’দের পালাতে বলছে।  কেউ হয়তো বলছে পালিয়ে নয় প্রতিরোধেই নির্মিত হোক আগামীর সময়।  অচেনা একজন লিখেছেন, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা/ বড় নষ্টদের এই শহরটা/ এখানে জারুল ফুলের দিনে/ কেউ তোর হাত ছুঁয়ে হাঁটবে না। ’ কিন্তু সুবোধরা পালিয়ে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? তারা কি নিজেরা বেঁচে যাবে? তখন এই মহানগড়ের বা কী হবে?

সে যাই হোক।  ভাবছিলাম এই ঈদে এত এত মানুষ যে গ্রামে গেলো, তাদের ভেতর কি সুবোধরা নেই? আছে তো বটেই।  কারণ এই ঈদযাত্রা তো এক বোধেরই যাত্রা।  সু-বোধের যাত্রা।  কারণ ইদ তো সবাইকে আপন করে নেওয়ার শিক্ষাই দেয়।  নজরুল যেমন তারে গানে দোস্ত দুশমন ভুলে হাতে হাত মেলানোর কথা বলছেন, ঈদ তো আসলে তাই।

কিন্তু সুবোধের কাছে, সুবোধ’দের কাছে এই সময়ের ঈদ একটু অন্য।  ঈদ মানেই এখন কে কার চেয়ে বড় তা দেখানোর প্রতিযোগিতা।  ঈদ মানে গরিবের প্রতি ধনীর করুনা।  ঈদ মানে সচ্ছল মানুষের আনন্দ, আর অসচ্ছলদের বেদনা। এই কারণেই হয়তো কখনও পালাবার কথা ভাবে সুবোধ।  এই পালাতে চাওয়ার মাঝে ভীষণ অভিমান আছে।  কষ্ট আছে।  না পাওয়ার বেদনা আছে।  অধিকারের বার্তা আছে।  মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আর্তি আছে।

এসব ভাবনা নিয়ে কেমন কাটছে সুবোধ কিংবা সুবোধ’দের ঈদ? কোথায় কাটছে সেটা হয়তো বড় কিছু নয়! তবু শুধু একটাই আশা মানুষের মনে অন্তত সুবোধ ফিরে আসুক।  সবাইকে ঈদ মোবারক!

লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাহিব রেজার মৃত্যু: ডা. সপ্নীলসহ আরও ২ চিকিৎসকের সনদ স্থগিতের বিজ্ঞপ্তি 
রাহিব রেজার মৃত্যু: ডা. সপ্নীলসহ আরও ২ চিকিৎসকের সনদ স্থগিতের বিজ্ঞপ্তি 
চা কিংবা কফি দিয়ে চুল ধুলে যেসব উপকার পাওয়া যায়
চা কিংবা কফি দিয়ে চুল ধুলে যেসব উপকার পাওয়া যায়
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাইলফলক: পার্বত্য উপদেষ্টা
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাইলফলক: পার্বত্য উপদেষ্টা
ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
সর্বশেষসর্বাধিক