X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, অথবা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ

মাসুদ কামাল
২০ আগস্ট ২০১৮, ১৭:৫৭আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৮, ১৮:০৫

 

মাসুদ কামাল ‘শুনুন, আপনার লেখায় তথ্যগত ভুল আছে। সে রাতে বাসটি যখন ধাক্কা দেয়, মন্ত্রী তখন গাড়ির মধ্যে ছিলেন না!’
‘মন্ত্রীকে ধাক্কা’ শিরোনামে আমার যে লেখাটি বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে এক ভদ্রলোক বললেন এ কথা।
আমি অবাক হলাম। কিছুটা বিরক্তও। একাধিক মিডিয়ায় খবরটি বের হয়েছে, বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে, ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশও স্বীকার করেছে, ধাক্কা মারা বাসের যাত্রীর আসনে বসে থাকা চালক আর চালকের আসনে থাকা কন্ডাকটরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা অপরাধ স্বীকার করেছে, সে সব পড়েই তো আমি লিখেছি। সবাই বলেছে- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন গাড়ির মধ্যেই ছিলেন, তিনি ভিতরে থাকা অবস্থাতেই বাসটি পিছন থেকে ধাক্কা মারে। তাহলে? তাহলে কি করে উনি বলেন মন্ত্রী গাড়িতে ছিলেন না? 
তিনি বললেন, মন্ত্রী গাড়ির ভিতরে থাকলে, তাকে হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতাকে আসামি করে এরই মধ্যে একাধিক মামলা হয়ে যেত। কিন্তু মামলা তো হয়নি। মামলা যখন হয়নি, তখন মনে হয় গাড়ির মধ্যে মন্ত্রী মহোদয় ছিলেন না। না হলে বিরোধী দলের নেতাদের হয়রানি করার এমন দুর্দান্ত সুযোগ তারা হাতছাড়া করতেন না!

এই ভদ্রলোক বয়সে আমার চেয়ে ছোট। কিন্তু মেধা ও রসে যে অনেক বেশি ধারালো, সেটা বুঝতে কষ্ট হলো না মোটে।

তার কথা শুনে হাসলাম। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, খুব বেশি একটা ভুল কি বলেছে সে? ‘রাজনৈতিক মামলা’ নামে একটা বিষয় তো আছে এই দেশে। নানা ছুঁতানাতায় রাজনৈতিক মামলা কি হয় না? কোথায় কোন মিছিলে গণ্ডগোল হয়েছে, গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, রাজধানীতে থাকা কেন্দ্রীয় নেতারা কি সেই ঘটনার হুকুমের আসামি হন না? বলা হয়, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, আর সেই ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। ফলে কেন্দ্রীয় নেতাই হবেন আসামি। প্রয়োজনে একজন নয়, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সকলকেই আসামি করা যেতে পারে। 

মামলার এই সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশের মানুষ বেশ ভালোই পরিচিত। এটা নতুন কোনও বিষয় নয়, আগের সরকারের আমলেও হয়েছে। যখন যে দল সরকারের বাইরে থাকে, তারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, আবার তারাই যখন সরকারে যায়- এর যথেচ্ছ প্রয়োগ করে। হয়তো সে কারণেই মন্ত্রীর গাড়িতে ধাক্কার সঙ্গে মিলিয়ে একটা ষড়যন্ত্র, এবং তার প্রেক্ষিতে কম করে হলেও একটি রাজনৈতিক মামলার সম্ভাবনা কেউ কেউ দেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি, আর সে কারণেই বোধকরি আমার ওই পরিচিত ভদ্রলোকের মতো অনেকেই অবাক হয়েছেন।

তবে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ কিন্তু থেমে থাকেনি। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া গেছে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে হয়ে যাওয়া আন্দোলনের মধ্যেও। বলা হচ্ছে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মধ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা ঢুকে পড়েছিল। আন্দোলনটিকে দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা বিভিন্নভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। শেষ দিকে নানা গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনটিকে সরকার পতনের দিকে পর্যন্ত নিতে চেষ্টা করেছে। তারই প্রমাণ মেলে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে হামলার মধ্য দিয়ে।

একই রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রয়োগ দেখা গেছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়েও। ঠিক এই কথাগুলো তখনও বলা হয়েছে। সেই আন্দোলনটিও নাকি দীর্ঘায়িত হচ্ছিল ওই ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনাতেই। প্রমাণ স্বরূপ তখন হাজির করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাকে। এটিকে ইস্যু করে একের পর এক কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার করা শুরু হলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে ধরা হলো তাদের।

ঠিক সেই একই প্রক্রিয়া দেখা গেল এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। একের পর এক গ্রেফতার হতে থাকলো স্কুল, কলেজ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কি তাদের অপরাধ? অপরাধ- তারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত করতে চেয়েছে! তবে এ আন্দোলনকে অন্তত একটা দিক দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক মিলানো যাবে না। সেটি হলো- সরকার কিংবা সরকারের কোনও সংস্থা শুরু থেকে কখনোই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে নীতিগতভাবে বিরোধিতা করেনি। বলেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নাকি খুবই যৌক্তিক। বড়রা যা পারেনি, ছোটরা সেটাই করে দেখিয়েছে। তাহলে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার কেন? যে আন্দোলনকে সরকারের মন্ত্রীরা সমর্থন দিয়েছেন, সেটির সঙ্গে যুক্ত থাকা অপরাধ কেন হবে? এখানেও সেই আদি ও অকৃত্রিম- ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।’ বলা হলো- সরকার পতনের ষড়যন্ত্র হয়েছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো- কেউ কিন্তু বলছে না যে শিক্ষার্থীরাই সে ষড়যন্ত্র করেছে। বরং বলছে, জামাত শিবির এবং বিএনপির লোকেরা ষড়যন্ত্র করেছে, তারপর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়েছে। গুজব ছড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারীরাই যদি আন্দোলনকে উসকে দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের কেন ধরা হচ্ছে না? ষড়যন্ত্রকারীদের না ধরে এই যে ছাত্রছাত্রীদের ধরা হলো, তাদের রিমান্ডে নেয়া হলো, এসব ঘটনা তাদের মনে স্থায়ী যে ক্ষত সৃষ্টি করবে, সেটা কি সহজে নিরাময় হবে? এদের অনেকে এরই মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। কিন্তু জামিন পাওয়ার পর যে ছেলে বা মেয়েটি ঘরে ফিরলো, সে কি সেই আগের মতোই আর থাকবে?

আমি একটা বিষয় বুঝি না, যে অন্দোলনকে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, এমনকি পুলিশের কর্মকর্তারা পর্যন্ত সমর্থন দিলেন, সেখানে জামাত শিবির কি করে ঢুকলো? সরকারের বিভিন্ন সংগঠন কেন ঢুকতে পারলো না? বলা হয়ে থাকে, দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন নাকি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এটি সরকার সমর্থিত। ছাত্রছাত্রীদের যে আন্দোলনকে খোদ সরকারের লোকেরা সমর্থন দিচ্ছে, সেখানে ছাত্রলীগ কেন যুক্ত হতে পারলো না। যদি পারতো, তাহলে তো আন্দোলনকারীদের মধ্যে অবস্থান করতে করতেই তারা ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করতে পারতো। যৌক্তিক এই আন্দোলনটিকে তারাই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, একটা নিয়মতান্ত্রিক পথে পারিচালিত করতে পারতো, এভাবে এলোমেলো হতে দিতো না।

একথা কিন্তু ঠিক, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি শেষ দিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। তিন দিন পরেই, আমি নিজেও ভাবছিলাম, এবার তাদের ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত। তারা যা বলার তা বলতে পেরেছে, যা দেখানোর তা দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠলো- তারা ফিরবে কি করে, কি নিয়ে? বিজয়ের দৃশ্যমান কোনও নমুনা তো তাদের দেয়া হয়নি। সরকার যদিও বলেছে- সব দাবিই মেনে নিয়েছেন তারা, কিন্তু এই বক্তব্যের ওপর আস্থা রাখা সহজ ছিল না। কারণ, দাবি মানা এক কথা, আর সেটা বাস্তবায়ন করা আরেক কথা। দাবিগুলোই এমন যে সবক’টি মেনে নিলেও এখনি সেসব বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন আইন তৈরি করতে হবে। এর সবই সময়সাপেক্ষ।

এই যে জটিল বাস্তবতা, এটাই ছিল এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। সবাই বলছে- তোমরা জিতেছো। কিন্তু জয়ের কোনও দৃশ্যমান নমুনা তো দেয়া হয়নি তাদের হাতে। আমার তো মনে হয়, একেবারে শুরুর দিনই, কিংবা বড়জোর পরের দিনই এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটানো যেত। কিছু না, এখন যেভাবে সব দাবি মেনে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা বলে, এবং তার সঙ্গে বাড়তি হিসেবে মন্ত্রী শাজাহান খানকে সরিয়ে দিলেই হতো। এ সরকারের আছেই আর কয় মাস, এরমধ্যে শাজাহান খানের মতো একজন মন্ত্রীকে সরিয়ে দিলে বিশাল কোনও ক্ষতি হয়ে যেত না। উল্টো, এই বিশাল প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা অতি কাছের মানুষে পরিণত হতে পারতেন। আর বড়জোর ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে এই প্রজন্মের সকলেই গুরুত্বপূর্ণ ভোটারে পরিণত হবে। আমার তো মনে হয়, এই সুযোগটা হাতছাড়া হয়েছে অনেকটাই। অনেকে বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সরকার পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে অসহায়। অনেক ন্যায্য আইনও তারা প্রণয়ন করতে পারে না এদের সম্ভাব্য হুমকির কারণে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন সরকারকে কঠোর হওয়ার একটা সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু এই সুযোগ তারা একজন ব্যক্তির কারণে হাতছাড়া করেছে।

আমি কখনোই মনে করি না, বৃহত্তর জনগণের চাহিদার বিপরীতে ক্ষুদ্র কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করে কোনও একটি সরকার বেশি দিন জনপ্রিয় থাকতে পারে। জনপ্রিয় ইস্যুগুলো প্রতিদিন আসে না। যখনই আসে, সেগুলোকে ধরে ফেলতে হয়। ভোটের সময় যেমন হিসাব হয়, বেশিরভাগ মানুষ কি চায়, তেমনি সরকারে গিয়েও হিসাব করতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কি চাহিদা। আমার ধারণা, নিরাপদ সড়ক এবং কোটা সংস্কার- শিক্ষার্থীদের এই দুই আন্দোলনের ক্ষেত্রেই সরকার সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। যারা তাদের পক্ষ হতে পারতো, তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। যারা তাদের ছায়া হতে পারতো, তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

আসলে সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজতে নেই। বিরোধীদের দমনের সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়া। জনগণকে পক্ষে পেয়ে গেলে, জনগণই ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চিতে সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবে, অনেকটা ওই ছায়ার মতো। বিপরীতে জনগণের চাহিদাকে গায়ের জোরে দমনের চেষ্টা করলে আন্দোলন দীর্ঘায়িত হবে। আর দীর্ঘায়িত আন্দোলন ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ করে দেবে অনুপ্রবেশের।

 লেখক: সিনিয়র নিউজ এডিটর, বাংলাভিশন

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাইলফলক: পার্বত্য উপদেষ্টা
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাইলফলক: পার্বত্য উপদেষ্টা
ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাময়িক বরখাস্ত
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাময়িক বরখাস্ত
জুভেন্টাসের বিপক্ষে এমবাপ্পেকে পাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ?
জুভেন্টাসের বিপক্ষে এমবাপ্পেকে পাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ?
সর্বশেষসর্বাধিক