X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা পরিষ্কারে সমন্বিত উদ্যোগের এখনই সময়

মোহাম্মদ আসাদ উজ জামান
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৩৫আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৭:৫৯

মোহাম্মদ আসাদ উজ জামান আমাদের পরিচয় মানুষ। জীবনের প্রশ্নে মানুষের বিভক্ত হওয়ার কথা নয়। আজ আমাদের অনেকেই অসহায় হয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে যারা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছেন, কিন্তু খালি সিট পাচ্ছেন না, তাদের জন্যে সময়টা ভীষণ অসহায়ত্বের। আর যারা ইতোমধ্যেই কাউকে কাউকে হারিয়েছেন, তাদের কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। আজ ডেঙ্গু নিয়ে কম-বেশি অনেকেই শঙ্কিত, ভীত ও আতঙ্কিত!
ডেঙ্গু একটি জ্বরের নাম। বিশেষ জাতের এডিস মশার কামড় থেকে এই জ্বর হয়ে থাকে। দুই হাজার সালের দিকে  রোগটির  নাম বাংলাদেশে শোনা যায়। কয়েক বছর আগে চিকুনগুনিয়া নামে আরও একটি জ্বরের নাম শোনা গেছে। এই জ্বরেও অনেকে বিশেষভাবে ভুগেছেন।
মাত্র কয়েক বছরেই ডেঙ্গু জ্বর এখন একটি আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কের  কারণ কি শুধু মৃত্যু? অস্বাভাবিক মৃত্যু সব সময়ই আতঙ্ক সৃষ্টি করার কথা। কিন্তু সব অস্বাভাবিক মৃত্যুতে আমরা খুব একটা আতঙ্কিত হই না। এগুলো আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। যেমন, সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুগুলো সাধারণের জন্যে যেন শুধু পত্রিকার নিউজ, কিন্তু যে পরিবারে এ রকম ঘটনা ঘটে, তাদের জীবনের অসহায়ত্ব বলার মতো নয়। মনে হয় পুরো আকাশ যেন তাদের মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে। আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার বড় কারণ হলো—ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে আমরা কোনও কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। 

মনে হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে আমরা সবাই খেই হারিয়ে ফেলেছি। এখন জ্বর হলেই প্রথম প্রশ্ন হলো—এটি ডেঙ্গু কিনা! একটি সাধারণ মশার কামড়েও চমকে উঠছি, এটা এডিস মশা না তো! জ্বর হলেই ছুটছি ডাক্তারের কাছে, হাসপাতালে। ডেঙ্গু টেস্টে নেগেটিভ ফলের পরও আতঙ্ক যায় না। এই আতঙ্কের পরিবেশটি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। আমরা সবাই মিলেই ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছি। সাধারণ জ্বরেও একটি দেশে অনেকেই মারা যায়, কিন্তু সেটা তেমন কোনও আতঙ্ক তৈরি করতে পারে না। আজকের ডেঙ্গুর আতঙ্ক থেকে সহসা কোনও মুক্তি নেই। বাস্তব জীবনে জাদু কাজ করে না, ডেঙ্গু একটি বাস্তব জীবনের আতঙ্ক, জাদু দিয়ে এক নিমেষে এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী কোনও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কোথাও থেকে কোনও আশার বাণীও শোনা যাচ্ছে না। আমরা বুঝতে পারছি, ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আস্থা রাখার মতো কেউ কোনও দিক-নির্দেশনাও দিতে পারছে না। এটি একটি জাতির জন্য খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। মশা মারা নিয়েও অদ্ভুত সব খবর পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।  যখন আমাদের স্বজন হারিয়ে যাচ্ছে, তখন চারদিকে যেন বিভিন্ন রকমের নাটক জমে উঠছে, এই নাটকের পেছনে আর কেউ নেই, এই নাটকের মূলে সেই আমরাই। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!  

এখন দরকার একটি সম্মিলিত উদ্যোগ। সুস্থভাবে বাঁচতে গেলে দুটি জিনিস অপরিহার্য। একটি পরিবেশ, অন্যটি শিক্ষা। এর একটির সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। দুটিকেই অতি যত্নে তৈরি করতে হয়। সারাক্ষণই রাখতে হয় পরিচর্যার ভেতর। এখন সময় এসেছে পরিবেশের যত্ন নেওয়ার। অযত্নে পড়ে থাকা সামান্য পানি, যে পানি জীবনের জন্যে খুবই দরকারি, সেই পানিতে জন্ম নিয়ে মশা আমাদের ঠেলে দিয়েছে ভয়ানক এক আতঙ্কের দিকে। মশা রোধ করতে শুধু মশানিরোধক ওষুধ নয়, পরিবেশও পরিষ্কার রাখতে হবে। যেন নতুন করে মশা জন্ম নিতে না পারে। আর মশানিরোধক যে সব জিনিস বাজারে আছে, তার সব কি পরিবেশবান্ধব? মানুষের জন্যে সেগুলো ক্ষতিকারক কিনা, তাও ঠিকভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এই দাবি নিয়ে আমরা কার কাছে যাবো? কার কথায় আমরা বিশ্বাস করতে পারবো? এ রকম কেউ কি আমাদের আছে?

পরিষ্কার পরিবেশের জন্য আবর্জনা এক ভয়াবহ জিনিস। পরিবেশের ময়লা দূর করতে কেন আজও আমাদের হিমসিম খেতে হয়? উন্নত দেশের বড় কোনও শহরের ময়লা পরিষ্কার পদ্ধতি আমরা কেন অবলম্বন করতে পারি না? আমাদের রাস্তা বা ব্রিজ যদি উন্নত দেশের আদলে হতে পারে, তাহলে ময়লার ব্যাপারে কেন চুপ করে আছি? ময়লা তো ভয়াবহ। এর কারণে আমাদের বাতাস নষ্ট হয়ে গেছে, পানি নষ্ট হয়ে গেছে। বাতাস সরাসরি আমাদের ফুসফুসে চলে আসছে। পানির ময়লা ফসল আর মাছ হয়ে আমাদের শরীরেই ফিরে আসে। এর পেছনের কারণ হলো আমাদের যেমন খুশি যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলার অভ্যাস। অর্থাৎ যখনই আমরা কোনও কিছুর যত্ন নিচ্ছি না, তখনই সেগুলো আমাদের জীবনে ফিরে আসছে অভিশাপ হয়ে। চোখের সামনে এর বড় উদাহরণ—ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো জ্বর!

এই ময়লা পরিষ্কার করলেই কি ডেঙ্গু বা অন্যান্য আতঙ্ক দূর হয়ে যাবে? এরকম আতঙ্ক দূর হলে তো খুবই ভালো। কিন্তু না হলেও সমস্যা নেই, পরিষ্কার পরিবেশের জন্যে যে উদ্যম এবং নাগরিক জীবনে যে সুবিধা আমরা দেখতে পাবো, তার থেকে আতঙ্কিত না হয়েও অন্য আতঙ্ক কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা ধরতে পারবো। জীবন খুবই বাস্তব বিষয়।  জীবনে আতঙ্ক আসবেই। সেই আতঙ্ক দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করাই মানুষের ধর্ম। 

আজ যে আমরা মশার সঙ্গে লড়ে পারছি না, এর দায় কে নেবে? এককভাবে আমরা কেউই দায় নিয়ে পারবো না। কিন্তু সবাই মিলে যদি এর দায় নেই, তখন ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে যায়। আমাদের শক্তি ও অর্থ নিয়ে পরিবেশ পরিষ্কারের আহ্বান জানাতে হবে। এটা ঠিক, সবাইকে পাশে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এখনই শুরুটা করতে না পারলে ভীষণ পিছিয়ে পড়বো—যার সঙ্গে আমাদের সুস্থতা ও জীবন জড়িয়ে আছে।

পুরো ঢাকা নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার উপায় নেই। ময়লা পরিষ্কার সহজ কোনও কাজ নয়। যেহেতু আমরা জানি না, কীভাবে আবর্জনা ঠিকভাবে পরিষ্কার করতে হয়, সেহেতু আমরা শুরু করতে পারি ছোট্ট একটি এলাকা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে। প্রতিটি বাড়ির ময়লা শক্ত পলিথিন ব্যাগে থাকতে হবে। এরপর বদ্ধ অবস্থায়ই এগুলো নিয়ে যাওয়া হবে ময়লা পরিশোধন কেন্দ্রে। এজন্য যথাযথ ময়লা পরিশোধনের একটি ব্যবস্থা অতি জরুরি। ময়লা বহনকারী গাড়ি থেকে যেন কোনোভাবেই কোনও দুর্গন্ধ বের হতে না পারে, এজন্যে শক্ত পলিথিনের ব্যাগ ও ব্যবহার শেষে পলিথিন রিসাইকেল করার ব্যবস্থাও করতে হবে। ময়লার জন্যে যেহেতু আমাদের জীবন আটকে যাচ্ছে, সেহেতু একটু বেশি টাকা দিতে আমাদের উদ্বুদ্ধও করতে হবে। একই সময়ে সেই এলাকায় ড্রেন থেকে রাস্তা মাঠ সব পরিষ্কার করতে হবে, যেন ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ করা যায়।

এক মাস এরকম করে যদি কোনও সাফল্য পাওয়া যায়, তাহলে পরের মাসেই আরও কয়েকটি এলাকায় এই কার্যক্রম চালানো যাবে। আস্তে আস্তে পুরো ঢাকায় এই কার্যক্রম সফলভাবে চালানো যাবে। যদি সাফল্য না আসে, তাহলে কী করতে হবে, তাও কিন্তু এক মাসের মধ্যে বুঝতে পারার কথা। আমাদের শিখতে দিন, উৎসাহ দিন—একটি ময়লামুক্ত পরিবেশের জন্যে কী করতে হবে। আমরা কোনও হুঙ্কার শুনতে চাই না। কিছুটা পরিষ্কার একটি পরিবেশ পাওয়ার পর আমরা চাইলেই যেখানে-সেখানে দৃশ্যমান ময়লা ফেলার জন্য জরিমানা করতে পারি, যা ঢাকা শহরকে নিয়ে যাবে পরিষ্কারের অন্য একটি স্তরে। এগুলো করতে প্রয়োজনে আমরা কাজে লাগাবো সবাইকে।

এই একমাসে পরিষ্কার উদ্যোগের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকবেন, তাদেরও গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে হবে। পরিষ্কার করার চেয়েও এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ! কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

আমরা পারবো এবং আমাদের পারতেই হবে। কেন পারতে হবে? আমাদের জন্য, আমাদের সন্তানের জন্যে। আমাদের জীবনে সন্তান হলো শ্রেষ্ঠ উপহার। এই সন্তান নিয়ে অনেকেই আজ ছুটছেন হাসপাতালে সিটের জন্যে।

আজ সন্তানকে নিয়ে আমরা অসহায় পরিবেশে বাস করছি। আমাদের নিজেদের জন্য এবং তাদের জন্যও সবার এগিয়ে আসা উচিত সমন্বিত কোনও উদ্যোগে। আজকের এই আতঙ্কিত পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্যেই আমাদের সবার উচিত এগিয়ে আসা। আমাদের ভেতর থেকেই কাউকে না কাউকে একটি উদ্যোগের ডাক দিতে হবে।  যে ডাকে কোনও মিথ্যা থাকতে পারবে না। এই ডাক শুধু ডেঙ্গুর জন্য নয়, আমাদের সামগ্রিক পরিবেশের জন্যও। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা জরুরি।  তা হলো প্রকৃতি মিথ্যা বোঝে না, একে পরিষ্কার করতে চাইলে বা পরিষ্কার রাখতে চাইলে মিথ্যা  থাকলে চলবে না। অহেতুক হুমকি দিয়েও কাজ হবে না।

ডেঙ্গুর আতঙ্কিত পরিবেশ থেকেই আমাদের শক্তি নিতে হবে সমন্বিত ভাবনার। সমন্বিত চিন্তার অভাবে ব্যক্তিস্বার্থে আমরা আমাদের নদী, খাল-বিল, মাটি, পানি—সব কিছু নষ্ট করে ফেলেছি। আমরা শুধু নিজের ঘরটা পরিষ্কার রাখতে চাই। কিন্তু সুস্থভাবে বাঁচতে চাইলে, ময়লার ক্ষতিকারক দিক থেকে ভালো থাকতে চাইলে বাড়ির সামনের রাস্তা নয় শুধু, ড্রেনও পরিষ্কার রাখতে হবে। এজন্য দরকার এক স্বচ্ছ পরিকল্পনা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ।  

এই ছোট্ট একটি ঢাকা শহরে কে থাকে? পুরুষ হলে বাবা, ভাই, বাবা ও ছেলে। নারী হলে মা, বোন, ও মেয়ে। এই ছয়টি পরিচয়কে কি আমরা রক্ষা করতে পারবো না? আসুন, বেঁচে থাকার জন্য, জীবনের জন্য একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াই, নিজের শক্তি, দক্ষতা, টাকা সব নিয়ে।

আমাদের এখন আর টাকার খুব একটা অভাব নেই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি শুধু টাকা হলেই জীবন বাঁচানো যায় না। জীবনের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে হয়। কিন্তু আমরা কি জীবন উৎসর্গ করছি না? এই কয়েকদিনে ডেঙ্গুতে কতজন জীবন ‘উৎসর্গ’ করেছেন। রাস্তার দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত মানুষ জীবন ‘উৎসর্গ’ করেই যাচ্ছে। তাহলে আর চিন্তা কী, জীবন দিতে পারলে টাকা কেন দিতে পারবো না? কেন সবাই মিলে বেঁচে থাকার সুস্থ্ ও কার্যকরী একটি উদ্যোগে এক হতে পারবো না।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রানা প্লাজা ধস: ১১ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
রানা প্লাজা ধস: ১১ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ