X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

বাংলাদেশে কাশ্মিরি ছাত্রদের ভিসা জটিলতা প্রসঙ্গে

আনিস আলমগীর
১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:৫৮আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:৫৮

আনিস আলমগীর ঢাকা ট্রিবিউনের ১৩ জানুয়ারি ২০২০ তারিখের খবরে দেখলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ কাশ্মিরি ছাত্রদের ভিসা দিচ্ছে না, খবরটি সঠিক নয়। মন্ত্রীকে প্রেস বিফ্রিংয়ে ভারতীয় ক’টি অনলাইনের খবরের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। সেই খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা পেতে ব্যর্থ হয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কাশ্মিরি মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এক মাস ধরে দিল্লি, কলকাতা, গৌহাটি ও আগরতলায় আটকা পড়ে আছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের শিক্ষার্থীরা কোনও সমস্যা ছাড়াই ভিসা পাচ্ছে, কিন্তু কাশ্মিরিদের ক্ষেত্রে জটিলতা চলছে।
খবরে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের মেডিক্যালে পড়াশোনার জন্য শিক্ষার্থীদের পাঠানোর কাজে জড়িত এজেন্টরা বলছেন, ভিসা পেতে দীর্ঘ বিলম্বের কারণে তারা সমস্যায় পড়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এখন মেডিক্যাল কোর্সের জন্য পরিশোধিত অর্থ ফেরত চাইছেন। বাংলাদেশ, চীন ও অন্যান্য দেশে মেডিক্যালে পড়ার জন্য শিক্ষার্থী পাঠানোর কাজে নিয়োজিত একটি এডুকেশনাল কনসাল্টেন্সির ব্যবস্থাপক বলেছেন, শিক্ষার্থীরা গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দিল্লি, কলকাতা, গৌহাটি ও আগরতলার হোটেলগুলোতে বসে আছেন।
সাধারণত কাশ্মিরি শিক্ষার্থীরা দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার জন্য আবেদন করেন। তাদের কারও কারও সঙ্গে অনেক অভিভাবকও আছেন। এরা আশংকা করছেন, ভারত সরকারের চাপে বাংলাদেশ কাশ্মিরি ছাত্রদের ভিসা দিচ্ছে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা সত্য হলে ভালো, কিন্তু অভিযোগটি অমূলক মনে হওয়ার কারণ নেই। রিপোর্টে দেখলাম, ভারতের বিভিন্ন মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশি কূটনীতিকরাও এ ব্যাপারে স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি। ভিসা দিতে এতোদিন লাগবে কেন? আর দিল্লি থেকে সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে ওই ছাত্রদের গৌহাটি পর্যন্ত আসতে হবে কেন, যেই মিশনের দায়িত্ব পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিষয় দেখা?

শিক্ষার তো কোনও সীমান্ত নেই। এক দেশের ছাত্র অন্য দেশে লেখাপড়া করতে আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রের মহত্ত্ব বিলোপ হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়। গ্রিক আর রোমান জাতির পতন হয়েছে রাষ্ট্রীয় অনুদারতার কারণে। দুই রাষ্ট্র পরস্পর সহযোগিতা করে বড় হওয়ার চেষ্টাতেই মঙ্গল নিহিত। প্রত্যেক সভ্যতা বড় হয় পরস্পরের শিক্ষা, আচার-আচরণ আর উভয়ের মধ্যে যা ভালো তা বিনিময়ের মাধ্যমে। এ বিষয় নিয়ে যে জাতি উচ্চতার পরিচয় দেয় না সে নিচে পড়ে থাকে।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সাধারণভাবে এক সভ্যতার দেশ। ভারতে সভ্যতা বিনাশের কোনও বেগ কখনও ছিল না; ক্ষমতা ও স্বার্থ বিস্তার কখনও এই সভ্যতার ভিত্তি নয়। ভারত এখন বিভক্ত হয়ে তিন রাষ্ট্র হলেও আমরা মনে করেছিলাম কেউ কখনও প্রাচীন সভ্যতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তান আর ভারত ধর্মীয় গোঁড়ামি করে সভ্যতার প্রাচীন শিক্ষা হতে বিচ্যুত হয়েছে।

ভারতের প্রচুর ছাত্র এখন বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করতে আসে। কঠিন ভর্তি পরীক্ষা থাকায় কিংবা ভারতের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ফি অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি তাদের কাছে আকর্ষণীয়। বাংলাদেশের মেডিক্যালে শিক্ষার মানও ভারতের সমমানের। উভয় দেশেই এমবিবিএস প্রোগ্রাম চলে ইংরেজিতে। পাঠ্যবইগুলোও একই। অন্যদিকে কাশ্মিরি শিক্ষার্থীদের তাদের রাজ্যে চিকিৎসা শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ সীমিত। ফলে তাদের কাছে ভারতের অন্যান্য রাজ্য ছাড়াও বাংলাদেশ হয়ে উঠছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।

ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পেশায় চিকিৎসক। তিনি ২০০১ সালে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। পরে তিনি ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নেন সার্জারিতে। নেপাল, ফিলিস্তিন, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকেও বাংলদেশে মেডিক্যাল শিক্ষা নিতে আসে শিক্ষার্থীরা। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সম্প্রীতিও বাড়ে।

কিন্তু এখন দেখি ধর্মই এই সম্প্রীতি সৃষ্টির ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে বেশি। বাংলাদেশ কখনও ভারতীয় ছাত্রদের ভিসা দিতে দ্বিধা করেনি। কাশ্মিরের ছেলেরা এসে ডাক্তারি পড়ে ডাক্তার হলে তো ভারতেরই লাভ। আর আমাদের সরকার ভারতের কথা শুনতে যাবে কেন! কাশ্মিরিরা এমনিতেই নির্যাতিত। কাশ্মিরিরা বেশিরভাগ মুসলমান। আর বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সুতরাং কাশ্মিরের প্রতি সহানুভূতি থাকা স্বাভাবিক।

বৃহত্তর পরিসরে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তবুও পাশের দেশে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় হলে তো সাম্প্রদায়িকতা এখানেও বিস্তার হবে। এএফপির রিপোর্ট অনুসারে বর্তমান নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ভারতে যে আন্দোলন চলছে তাতে এ পর্যন্ত ২৭ জন মানুষ মারা গেছেন, যার বেশিরভাগই মুসলমান। আমি দেখেছি দিল্লির লালকেল্লার সামনে হকারদের বিরাট মার্কেট, যেখানে ৮০ শতাংশ মুসলমান। এদের অনেকে শিক্ষিত। শুধু চাকরি পায় না বলে হকারি করে। কাশ্মিরের ছেলেরা ডাক্তার হলে মোদি-অমিত শাহের সমস্যা কোথায়!

ভারত সরকারের বাধা দেওয়ার খবর যদি সত্য হয় সেটি নিশ্চয়ই সাম্প্রদায়িক ব্যাপার। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে ভারত সরকারকে সহযোগিতা করা গুরুতর অন্যায়। কাশ্মিরি শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসা যদি বন্ধ থাকে, তবে সবার জন্য বন্ধ থাকবে। ভিসা নিয়ে দ্বৈতনীতি কেন! কাশ্মিরের মুসলমান শিক্ষার্থীরা তো অপরাধী নয়। তারা বাংলাদেশে পড়তে আসতে পারবে না কেন! কাশ্মিরি কোনও ছাত্র বাংলাদেশে এসে জঙ্গিবাদ কিংবা অন্য কোনও অপরাধে জড়িত হয়েছে, আমরা তো সেরকম কোনও খবরও পাইনি। তাহলে এই ভিসা হয়রানি কেন!

বাংলাদেশকে দিয়ে ভারত সরকার যদি ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তবে সেই ফল কখনও ভালো হবে না। তাদের উচিত হবে সেই পন্থা ত্যাগ করা। হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে বড় হোক, এটাই তো সরকারের কাম্য হওয়া উচিত। সবাই তো তারা ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা লোকসংখ্যার অনুপাতে সরকারি চাকরিতে অনেক বেশি তা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তো কখনও প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। বাংলাদেশের মানুষ এ ব্যাপারে নির্বাক। নির্বাক লোকদের মোদির সাম্প্রদায়িক সরকার নানাভাবে সবাক করে তোলার চেষ্টা করছে।

ধর্মীয় বিভাজন করে কখনও এই উপমহাদেশে কেউ লাভবান হতে পারেনি। আওরঙ্গজেব ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে মোগল সাম্রাজ্যকে ডুবিয়েছেন। ছত্রপতি শিবাজী মহারাষ্ট্রে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করতে গিয়ে বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন। শিবাজীর প্রধান সেনাপতি ছিল মুসলমান। তার সৈন্যবাহিনীতে অসংখ্য মুসলমান ছিল। নির্বোধের মতো কাজ করলে রাষ্ট্র টিকবে কী করে! শিবাজীর রাষ্ট্র তাই টিকেনি।

এখন নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ ভারতকে বিনষ্ট করার পথ ধরেছেন। গণতন্ত্র ভারতের মজ্জাগত ব্যাপার। রাজা রামচন্দ্র গণতান্ত্রিক রাজা ছিলেন। মানুষের কথা শুনতে গিয়ে রাজা রামচন্দ্র নিজের স্ত্রী সীতাকে পর্যন্ত নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। সেই ভারতে এখন তো গণতন্ত্র আরও ব্যাপক ভিত্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে ভিত্তি পাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা।

যাক, বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করবো কাশ্মিরিরা এখন মজলুম। সুতরাং তাদের ছাত্রদের কোনও বাধাবিঘ্ন ছাড়াই যেন বাংলাদেশে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। যারা বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে তাদের তো বটেই, যারা আগামীতে আসতে চায় তাদেরও যেন সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা না হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেই গাজার একাধিক স্থানে ইসরায়েলি হামলা, নিহত ৯৫
যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেই গাজার একাধিক স্থানে ইসরায়েলি হামলা, নিহত ৯৫
ফেনীতে অস্ত্রসহ ছাত্রদলের সাবেক দুই নেতা আটক
ফেনীতে অস্ত্রসহ ছাত্রদলের সাবেক দুই নেতা আটক
ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই জ্বালানি রূপান্তর জরুরি
ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই জ্বালানি রূপান্তর জরুরি
ফিরে দেখা: ১ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ১ জুলাই ২০২৪
সর্বশেষসর্বাধিক