X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘটনাটি শ্রমিক শোষণের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকলো

রাশেদা রওনক খান
০৫ এপ্রিল ২০২০, ১৪:১২আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২০, ১৪:১৪

রাশেদা রওনক খান পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দলে দলে গ্রাম হতে ঢাকার পথে ছুটছে। ফেরিতে উপচেপড়া ভিড়, দূরপাল্লার পরিবহনসহ অন্যান্য যানবাহন বন্ধ থাকায় সাধারণ এই শ্রমিকেরা অনেক কষ্ট করে কর্মস্থানে পৌঁছার চেষ্টা করছেন। কোথায় গেলো আমাদের শারীরিক দূরত্ব, কোথায় গেলো মানুষের ঘর বন্দি করার জন্য সকল কর্মযজ্ঞ? কেন কীভাবে এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে হাজারো মানুষের ঢল নামানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো? কেন তাহলে এতসব আয়োজন? সবই কি তবে বৃথা যাবে?
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, করোনার এই ভয়ানক পরিবেশে পোশাক শ্রমিকদের এভাবে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার অর্থ কী? তবে কি আমরা ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঘরে নিরাপদ জীবন-যাপন করবো, আর দরিদ্র শ্রমিক গোষ্ঠী এভাবে অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করে যাবে? এখনই বলা হচ্ছে, সামনের তিন সপ্তাহ ভয়াবহ, আবার এই এক সপ্তাহ না যেতেই করোনা সংক্রমণের একটা কঠিন সময়ে এই বিপদের দিনে আমরা শ্রমিক রাস্তায় নামিয়েছি, কেন? এই মুহূর্তে কি আমাদের মুনাফার কথা ভাবা উচিত, না এতগুলো জীবন বাঁচানোর সংকল্প নেওয়া দরকার? নাকি শ্রমিক শ্রেণি বলে তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই? যদি আমরা কেবল মুনাফার কথা ভাবি, তাহলে কি আমরা নিজেদের আর মানবিক ভাবতে পারি? আর যদি মানবিক না হই, তাহলে প্রশাসন পর্যায় হতে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত এতো প্রস্তুতি নিয়ে কী লাভ হলো?
জানি, কেউ কেউ বলবেন, বিদেশি বায়ারদের অর্ডার ডেলিভারি দেওয়া দরকার, বাইরের চাপ আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সবই ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে? আর যদি নিতান্তই এই সংকটে গার্মেন্টস খুলতেই হয়, তবে যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপত্তা কি দেওয়া হয়েছিল? কিসের ভিত্তিতে এত মানুষকে একসঙ্গে রাস্তায় নামার পরিকল্পনা করা হলো? এই মুহূর্তে এভাবে রাস্তায় লাখো শ্রমিককে কী করে নামাতে পারলো পোশাক শিল্প মালিকেরা? কীভাবে তারা এটা চিন্তা করতে পারলেন? হয়তো ধনী শাসক গোষ্ঠীর কাছে একজন শ্রমিক মানে দুর্বল-নিরীহ একান্ত বাধ্যগত কর্মচারী, কিন্তু এই প্রতিটি শ্রমিকের জীবনের মূল্য আছে তার পরিবারের কাছে, আর তার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
আমরা জানি, আমাদের পিপিই দরকার, সেক্ষেত্রে কয়েকটি গার্মেন্টস খুললেই যথেষ্ট, আমি আমার পূর্বের লেখাটিতেও লিখেছিলাম একেবারেই নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিটি শ্রমিকের জীবনের সঠিক নিরাপত্তা দিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি কারখানায় পিপিই তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের আনতে গণপরিবহন দিতে হবে এবং সেই গণপরিবহনে গাদাগাদি করে আনা যাবে না। প্রতি সিটে একজন করে বসবেন এবং যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বাস থেকে নামবেন এবং উঠবেন, এই প্রক্রিয়ায় যেতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে তাদের কাজের পরিবেশ দিতে হবে একেবারেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে।

কিন্তু আমরা কাল যা দেখলাম, তা যেন বজ্রপাতের মতো আমাদের সামনে এসে হাজির হলো। হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে যখন সারা পৃথিবী ঘরে বন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছে। কেবল অধিক মুনাফা লাফের আশায়, অর্থনীতির চাকা বন্ধ হওয়ার ভয়ে শ্রমিকদেরকে জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে না বিজিএমইএ। আমরা এসব ক্ষেত্রে চীনকে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি, কীভাবে তারা তাদের সংকট কাটিয়ে এখন অন্যান্য দেশকে কিটসহ নানা সামগ্রীর জোগান দিচ্ছে। মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, মানবিক পরিসরে দরিদ্র শ্রমিকের জীবনের মূল্যকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। করোনা চাইলেও আমরা থেমে থাকবো না, এই পরিস্থিতি উন্নত দেশগুলোতেও নেই। সব থেমে আছে। আমাদেরও থামতে জানতে হবে। কেননা থামা থেকেই শুরু হবে নতুন করে পথ চলা।

আর যদি এই থামার মাঝেও আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের পথ চলতে হয়, সেই চলা হতে হবে নিরাপদ, যেখানে করোনা হামলে পড়তে পারবে না। দুই দিন আগে আমেরিকান চিকিৎসাবিদ্যার গবেষকেরা জানিয়েছেন, করোনা কেবল হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়ায় না, করোনা আক্রান্ত রোগী নিঃশ্বাসের সঙ্গেও করোনাভাইরাস ছড়ায়। সেক্ষেত্রে আমাদের এভাবে এতো মানুষ রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না, যেখানে মানুষ মানুষের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ছাড়ছে!

বরং এখন যা করা দরকার ছিল, সরকার রফতানিমুখী শিল্পকে যে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, সেখান থেকে শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ অংশ দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, যেন তারা কর্মহীন সময়ে পেটে খাবার জোগাতে পারে। আশা করছি, প্রতিটি কারখানার মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতনসহ ভাতাদি অগ্রীম প্রদান করে দেবেন। সারাবছর তাদের জন্য কাজ করে এখন দুর্দিনে হয়তো অনেক শ্রমিক ও তার পরিবার না খেয়ে মারা যাবে, সেদিকে লক্ষ রাখা একজন মানবিক মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সামনে রোজা ও ঈদ, সেসব মাথায় রেখে শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস অগ্রিম প্রদান করাও জরুরি, যেন এই মুহূর্তে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন করতে গিয়ে থেমে না যায়।

শেষ কথা, তাদের আমরা আন্তর্জাতিক সভা সেমিনারে পত্র পত্রিকায় গবেষণা গ্রন্থে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালক বলি। সেই চালকদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখা আমাদের দায়িত্ব। চালকদের কর্মশক্তিকে ব্যবহার করবো, কিন্তু জীবনীশক্তিকে হুমকির মুখে ফেলে, তা মানবিক রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, তাদের কর্ম পরিবেশে করোনামুক্ত সেটা নিশ্চিত করে তবেই কারখানা খোলার চিন্তা করতে পারে, নয়তো এভাবে অনিশ্চয়তার মাঝে এই বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠীকে গার্মেন্টমুখী করা উচিত হবে না। সকল কারখানার কাজের পরিবেশ সমান নয়, অনেক কারখানায় শ্রমিকেরা কাজ করে খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, সেইসব কারখানা কোনোভাবেই এই মুহূর্তে খোলার অনুমতি পাওয়া ঠিক হবে না।

এই অল্প সময়ের স্বল্প মুনাফা লাভের আশায় সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার মতো কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া আত্মঘাতী হবে। আর কোনও কারণে করোনা আক্রান্ত হলে এই দেশ, সেটা কাটিয়ে ওঠার কিন্তু আমাদের শক্তি নেই, এই সহজ হিসাব আমাদের বুঝতে হবে। আর এটাও মনে রাখতে হবে, এই শ্রমিকরাও অনেকেই তাদের পরিবারের একমাত্র অর্থজোগান দাতা, অতএব তারা আক্রান্ত হওয়া মানে পুরো বাংলাদেশ আর্থিকভাবে আক্রান্ত হওয়া। এখনই শ্রমিকদের করোনামুক্ত সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করুন, নয়তো ঘরে থাকা নিশ্চিত করুন।

সারাদিন লাখো শ্রমিকের মহাসড়কে ঢল নামার পর, নেট দুনিয়ায় তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে গার্মেন্টস বন্ধ থাকার ঘোষণা এসেছে যদিও, কিন্তু এইভাবে খুলে দেওয়ার ঘোষণার আগে বিষয়টির ভয়াবহতা নিয়ে চিন্তা করা আমাদের দরকার ছিল। এভাবে ঘর থেকে বের করে রাস্তার মাঝপথে আবার ঘরে ফিরে যেতে বলাটা পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্তহীনতার প্রমাণ রাখে, যা নাগরিকদের জীবনে অস্বস্তিই তৈরি করে, নির্ভরতা কিংবা বিশ্বস্ততার নয়। হয়তো এই উদাহরণ আমাদের ভবিষ্যতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না!’ সারা বিশ্ব তো বটেই, যখন পাশের দেশ ভারতসহ সকলেই প্রায় লকডাউন কিংবা জনতার কারফিউ করছে, তখন এই ভয়ার্ত সময়ে এভাবে হাজারো মানুষের ঢল নামানোর ঘটনাটি আমাদের অমানবিক পুঁজিবাদী সমাজের শ্রমিক শোষণের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকলো বৈকি!

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ