X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

শিল্পপ্রণোদনা জরুরি, তবে লাখো প্রাণ বাঁচান আগে

কাজী আজিজুল ইসলাম
০৮ এপ্রিল ২০২০, ১৪:৪৩আপডেট : ০১ মে ২০২০, ১৩:৩৩

কাজী আজিজুল ইসলাম করোনা ছোবল দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। শ্রমিকস্বার্থ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীও পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর সাতদিনের মধ্যেই প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হয় সব শিল্পের জন্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যবসাবান্ধব। বিএনপিও ৮৭ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্রস্তাব করে ফের জানান দেয় তারাও ব্যবসাবান্ধব।
শিল্পপ্রণোদনা অবশ্যই জরুরি। বাংলাদেশেও এখন প্রতি তিনজনের মধ্যে দুই জন ভোক্তার খাবারই এখন ঘরের গোলায় থাকে না, বাজার থেকে কিনতে হয়। শিল্পকর্মীদের বিশাল এই ভোক্তাশ্রেণির খাবার, চিকিৎসাসহ শত চাহিদা মেটাতে ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতেই হবে।

করোনাভাইরাস বাজারসৃষ্ট সংকট?

বাজার অর্থনীতিতে ক্রয়ক্ষমতার প্রয়োজন অনিবার্য। যদিও বিখ্যাত চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি এরই মধ্যে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস সংকট নাকি বাজারসৃষ্ট এক সংকট। দেড় যুগ আগে করোনা গোত্রের ভাইরাস সার্স এসেও থেমে গিয়েছিল। তখন বাজার জমবে না ভেবে কোম্পানিগুলোও সার্স ভ্যাকসিন গবেষণা বন্ধ করে শুধু বডি অ্যান্ড বিউটিলোশন বানানোর অধিক লাভজনক ব্যবসায় থেকেছে। এবার সেই সার্সই ধরন পাল্টে নভেল করোনা হয়ে বিশ্বমহামারি বাধিয়েছে।

বাংলাদেশেও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাই এখন ডু-অর-ডাই চ্যালেঞ্জ!

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের অর্থনীতির চেয়েও তার বড় চিন্তা এখন দেশটির জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে। অমর্ত্যর মতে, করোনা মহামারি যুদ্ধ নয়, মহাযুদ্ধের চেয়েও অনেক বড় বিশ্ব দুর্যোগ।

বেঁচে থাকলে বাংলাদেশেও অর্থনীতিকে আবার দাঁড় করাবে মানুষ। তাই এই মহাদুর্যোগে সফল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করে লাখো প্রাণ বাঁচানোর লড়াইটিই এখন প্রথম ও প্রধান জাতীয় মিশন হতে হবে। করোনা মোকাবিলা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যবসাবন্ধব আওয়ামী লীগ, ব্যবসাবান্ধব বিএনপি কেউই এখনও স্পষ্ট ও দৃঢ় মহাপরিকল্পনা বা মহাপ্রস্তাবনা দেয়নি। অনেক ভুল হয়েছে, তবু দোষাদোষি নয়, এখন দেশের লাখো প্রাণ বাঁচানোর লড়াইয়ের কঠিন সময়।

মাত্র ২৯ দিনে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা এক থেকে একশ’ সতের হয়েছে। সতের কোটি মানুষের দেশে এটি হাজার কিংবা লাখও ছাড়াতে পারে; এমন মানসিক প্রস্তুতিও রাখতে হবে। ভয়ে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে, রোগীকে বাঁচানোর লড়াইয়ের শক্তিও কমে। তাই ভয় নয় দৃঢ় প্রস্তুতি চাই। যদিও প্রকৃতি ও পরিবেশের গঠন, অপরিচ্ছনতায় থেকেও এদেশের মানুষের গড় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসহ নানা অনুঘটকের তুলনা করে অনেকেই বলছেন, এদেশের পরিস্থিতি ইতালি, স্পেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো হবে না।

সোশ্যাল ডিসট্যান্সে থেকেও সামাজিকতা ও মানবিকতার শক্তিতেই লড়তে হবে। ওরাই পারছে না আমরা কীভাবে পারব; এমন ভাবাটাও ভুল। আমরা আমাদের মতোই লড়বো এবং আমরা পারবোই।

দেরিতে হলেও অনেক কিছু শুরু হোক এখনই

সবার ঘরে তৈরি মাস্ক সবাই ঘরে-বাইরে পরে চেকোস্লোভাকিয়াও করোনার কমিউিনিটি ট্রান্সমিশন তুলনামূলকভাবে কমিয়ে রেখেছে। এখন আমাদের কিছু পোশাক কারখানা শুধু মাস্ক ও পিপিই তৈরির জন্য খোলা রাখতে হবে। হাইগ্রেড মাস্ক ও পিপিই তৈরিতে চীনের কারিগরি সহায়তা চাইতেই হবে দ্রুত। চীন, ভারত, কোরিয়া এবং জার্মানিসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে; জরুরি চিকিৎসা, ওষুধসহ নানা উপকরণ সহায়তা চাইতে হবে। হয়তো এমন সময়েও আমাদের তাদেরকেও কিছু দেওয়ার থাকতে পারে। দেশে একাধিক প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষা কিট উৎপাদন শুরু হোক। সক্ষম কারখানাগুলোতে গবেষণা এবং উৎপাদন শুরু হোক এযাবৎ প্রমাণিত সবচেয়ে কার্যকর করোনাপ্রতিষেধক ওষুধগুলো। আর দেরি হয়ে গেলেও সরকারি এবং বেসরকারি ল্যাবগুলোতে শুরু হোক করোনাভ্যাকসিন গবেষণা। যেটি ইসরায়েল শুরু করেছে তিন মাস আগেই।

মরার আগে মরবো না

আজ পর্যন্ত বেশিরভাগ ভাইরোলজিস্ট ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, প্রতি পাঁচজনের চারজন করোনা আক্রান্তই বাসায় ‌আইসোলেশনে থেকে নিজে নিজে সাধারণ চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হবেন আর একজনকে যেতে হবে হাসপাতালে। এই শতকরা ২০ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর হবে। নভেল করোনা বড় ঝুঁকিটা হলো এটি অন্য ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত এবং বহুমুখীভাবে সংক্রামক। তবে এতে গড়ে মৃত্যুহার এখনও পাঁচ শতাংশের মতো। তাই মরার আগে মরবো না। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই দুর্যোগে দেহ-মনন-মগজ আর মানবিকতার সর্বোচ্চ শক্তিতে লড়বোই আমরা। মানবিক বাঙালি আমরা এবার মরণশীল সেরা মানুষ হয়ে রুখে দেবো আমাদের জাতির লাখ লাখ প্রাণের প্রতি অদৃশ্য ঘাতকের মৃত্যু পরোয়ানা।

পুনশ্চ: প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলও পোশাকশ্রমিকের করোনাঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারেনি। মার্চের বেতন পাওয়া নিশ্চিত করতে লকডাউন ভেঙে ফেরিতে, ট্রাকে গাদাগাদি করে, মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে ঢাকায় ঢুকেছে লাখো শ্রমিকের মিছিল। এই অভাগারা রাজধানীতে করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিয়াল্লিশ বছর আগে জন্ম নেওয়া বিশ্ববাজারনির্ভর এই শিল্পটি অদুরদর্শী থেকেছে উদ্যোক্তা ও সরকারসহ সবার অদূরদর্শিতায়। এই সুযোগে শোষণকারী আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বিশ্বের সর্বনিম্ন সিএম-এ বড় বড় অর্ডারের লোভের গণ্ডিতে বন্দি রেখেছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে। তাইতো এই শিল্প আজও এতোই দীন যে বৈশ্বিক মহাদুর্যোগে দু’মাসও শ্রমিকদের ঘরে বসিয়ে নিরাপদ রাখতে পারছে না!

গত অর্থবছরে পোশাক রফতানি আয় ছিল দুই লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকার সমান। নিট ওভেন মিলিয়ে পোশাকশিল্পে গড় মূল্যসংযোজন ৫০ শতাংশ ধরলেও প্রকৃত আয় এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকা। ইন্ডাস্ট্রি এনালিস্টদের হিসেবে বেতনভাতা গত দশ বছরে দিগুণ হওয়ার পরও এই শিল্প শ্রমিকদের পেছনে ব্যয় করে মোট রফতানি আয়ের ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, যা বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সমান। মানে শ্রমিককে ঘরবন্দি রেখেও ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলে পুরো বেতন দিলে দেড় মাসের বেতন দেওয়া যায় আর অর্ধেক বেতন দিলে তিন মাসের। সেটি পেলেও তো শ্রমিকরা স্টে-হোম চর্চা করতে পারতো। এই স্টে-হোম কর্মহীন আরাম নয়, তাদের এবং তাদের দেশের আরও লাখ লাখ প্রাণ বাঁচানোর জন্যই জরুরি ছিল। তবু এনিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় থাকলো বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সবাই। সময়ই বলবে জীবনের হিসেবে এর মূল্যটি কত বড় হবে!

লেখক: একাত্তর টিভির সিনিয়র বিজনেস এডিটর এবং বিশ্লেষক  

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলবায়ু অভিযোজনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
জলবায়ু অভিযোজনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ
শতবর্ষী গাছের গোড়ায় জ্বলছে আগুন, ডাল দিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া!
শতবর্ষী গাছের গোড়ায় জ্বলছে আগুন, ডাল দিয়ে বের হচ্ছে ধোঁয়া!
আলকারেজের কষ্টের জয়, বিদায় মেদভেদেভের 
আলকারেজের কষ্টের জয়, বিদায় মেদভেদেভের 
শেফালির মৃত্যু: কারিনা বললেন, ‘আমি বোটক্সের বিরুদ্ধে’
শেফালির মৃত্যু: কারিনা বললেন, ‘আমি বোটক্সের বিরুদ্ধে’
সর্বশেষসর্বাধিক