X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ই-সিগারেটের পক্ষে একজন অধূমপায়ীর ওকালতি

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৮ মার্চ ২০২১, ১৮:৪১আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২১, ১৮:৪১

ডা. জাহেদ উর রহমান
ঘটনাটা যথেষ্ট অভাবনীয় আমার কাছে, কিন্তু এই দেশের মিডিয়ায় বেশি গুরুত্ব পায়নি। দেশের কিছু পত্রিকা এবং নিউজপোর্টাল এ সংবাদটি প্রকাশ করলেও এটা নিয়ে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে বিবিসি বাংলা। সংবাদটি হলো- দেশে ই-সিগারেট বন্ধ করার জন্য ১৫৩ জন এমপি একযোগে স্বাক্ষর করে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

খবরটি চোখে পড়ার পরই মনে ভেসে উঠলো বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটা ঘটনা। তিনি যখন আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে প্রকাশ করেন, তখন অনেক বিজ্ঞানী সেটার বিরোধিতা করেন। সত্যি বলতে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া সেই তত্ত্ব বুঝতেই পারেননি তখনকার অনেক বিজ্ঞানী। তারপর তার বিরুদ্ধে একটা বই লেখা হয় 'হান্ড্রেড অথরস এগেইনস্ট আইনস্টাইন' নামে। এই বই লেখার ব্যাপারটা সঠিক, কিন্তু এই বইয়ের কথা জানতে চাওয়ার পর সাংবাদিকদের আইনস্টাইন যে কথাটি বলেছিলেন বলে আমরা জানি সেটি সঠিক নাকি সঠিক নয় তা নিয়ে তর্ক আছে, কিন্তু কথাটি চমৎকার। তিনি বলেছিলেন, আমার তথ্য যদি ভুল হয় সেটি প্রমাণ করার জন্য একজনই তো যথেষ্ট।

এ ঘটনার আলোকে বলেই ফেলা যায়, ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার পক্ষে সঠিক যুক্তি যদি থেকেই থাকে, তাহলে সেটা বলার জন্য তো একজন এমপি-ই যথেষ্ট। অবশ্য এটা 'গণতন্ত্র' এবং এমপিগণ এই দেশের পার্লামেন্টে কাগজে-কলমে সংখ্যার হিসাব করেন। সেই বিবেচনায় স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা যত বেশি থাকবে তাতে আবেদনের 'ধার' না বাড়লেও 'ভার' তো বাড়ে বটেই।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫৩ জন সংসদ সদস্যকে এক হয়ে সংসদের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমন আহ্বান জানানোর ঘটনা ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম। কত ভয়ংকর সব সমস্যা নিয়ে আমাদের এই দেশে বসবাস - শাসনতান্ত্রিক-আইনি সমস্যা কিংবা যাপিত জীবনের নানা ভয়ংকর সংকট। কিন্তু আমরা এতটা একমত হতে আমাদের সংসদ সদস্যদের দেখিনি এর আগে। তার কাছে ই-সিগারেট এত বড় সংকট! কেন তাদের সেটা মনে হলো?

প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেই চিঠিতে সংসদ সদস্যরা সিগারেট নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবশ্য কতগুলো যুক্তি দিয়েছেন। কয়েকটি এরকম-

'ই-সিগারেট ব্যবহারে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৭১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, হার্ট অ্যাটাক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ৫৯ ও ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ই-জুসে থাকা ক্ষতিকর ফ্লেভারিং এজেন্টের কারণে শ্বাসতন্ত্র, লিভার, কিডনির দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ই-সিগারেটের নিকোটিন শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক। উচ্চমাত্রার এই নিকোটিন স্নায়ুতন্ত্রের স্টেম সেলকে ধ্বংস করে অকাল বার্ধক্যসহ স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের কারণ হয়'।

সংসদ সদস্যরা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং কর বৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে ই-সিগারেট অতি দ্রুত নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।

ই-সিগারেট, যা ভেপিং বলেও পরিচিত, তাতে মানুষ নিকোটিনই নিয়ে থাকে।  ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরলটিতে (ই-জুস) কিছু ফ্লেভারিং এজেন্টের সঙ্গে নিকোটিন থাকে। আমরা অনেকেই জানি না অ্যালকোহলের মতো নিকোটিনও আসলে একটি মাদক, যেটি এই বিশ্বে বৈধভাবে বিক্রি হয়। এবং আমাদের অনেকের অবাক লাগবে, এর চাইতে অনেক কম আসক্তি তৈরি করা এবং কম ক্ষতিকর মাদক অবৈধ। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী আসক্তি তৈরি করা ৫টি মাদকের তালিকা রকম- হেরোইন, কোকেইন, অ্যালকোহল, নিকোটিন ও মেথএমফিটামিন।

ই-সিগারেট মাধ্যমে মানুষ যখন নিকোটিন নেয় তখন সেটা নিকোটিনের যেসব খারাপ প্রভাব শরীরে তৈরি হওয়ার কথা সেগুলো তৈরি করে। কিন্তু পৃথিবীতে আজ এটা প্রতিষ্ঠিত, ই-সিগারেটের ক্ষতি প্রথাগত সিগারেটের তুলনায় অনেকটা কম। এর কারণ, নিকোটিন আসক্তি সৃষ্টিকারী উপাদান হলেও সিগারেটের অন্যান্য কেমিক্যাল শরীরের জন্য নিকোটিনের চাইতে অনেক বেশি ক্ষতিকর। না, এগুলো আমার কথা না; পৃথিবীর মেডিক্যাল বিষয়ে গবেষণার শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কথা।

করোনার সূত্রে আমরা জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টি বলেছে, নিশ্চয়ই ই-সিগারেট প্রথাগত সিগারেটের চাইতে কম ক্ষতিকর। ব্যাখ্যায় সেখানে বলা হয়েছে, প্রথাগত সিগারেটে কমপক্ষে ৭ হাজার ধরনের কেমিক্যাল আছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই খুব ক্ষতিকর।  ই-সিগারেটে এই কেমিক্যালের সংখ্যা প্রথাগত সিগারেটের চাইতে নিশ্চিভাবেই অনেক কম। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলও ই-সিগারেটকে 'লেসার ইভিল' বলেছে স্পষ্টভাবে।

এদিকে ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য সার্ভিস (এনএইচএস) ই-সিগারেটকে বরং প্রমোট করছে। না, তারা এই দাবি করছে না এই সিগারেট ক্ষতিকর না। তারা এটা বলছে, এই সিগারেটে পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই অনেকটা কম (তাদের ভাষায় 'স্মল ফ্র্যাকশন')। প্রথাগত সিগারেটে থাকা অতি ক্ষতিকর টার এবং কার্বন-মনোক্সাইড ই-সিগারেটে নেই। নিকোটিনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জিনিস এতে কম থাকে। তাই এনএইচএস বলছে, যারা এরইমধ্যে সিগারেট পানে আসক্ত তারা এই সিগারেট খেলে তার ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারেন এবং সর্বশেষ তারা এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

ধূমপান থেকে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে এনে ক্রমান্বয়ে সেটা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা রীতিমতো ই-সিগারেটকে প্রমোট করছে এনএইচএস। তারা গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে দেখিয়েছেন, যেসব মানুষ ধূমপান ছেড়ে দিতে চায় তারা ই-সিগারেট হয়ে ধূমপান ছাড়ার ক্ষেত্রে সরাসরি প্রথাগত সিগারেট ছাড়ার চাইতে দ্বিগুণ সম্ভাবনা থাকে।

ধূমপায়ী যারা প্রথাগত সিগারেট খেতেন সেটা ছেড়ে ই-সিগারেট ধরেছেন তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা থেকে আমি জানি, ই-সিগারেট তুলনামূলক সাশ্রয়ী। ই-সিগারেট ক্ষেত্রে ব্যবহৃত তরলটি আমদানির জন্য খুব জটিল প্রক্রিয়ার দরকার নেই, তাই চাইলে এই দেশের অনেক মাঝারি মানের ব্যবসায়ী এই সিগারেট আমদানি করে স্বনির্ভর হতে পারে।

সিগারেটের মতো একটা ভয়ংকর বিষাক্ত নেশা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকারের অনীহা সম্ভবত এই কারণে- এর মাধ্যমে সরকার খুব বড় অঙ্কের শুল্ক-কর পায়। ই-সিগারেটের ক্ষেত্রেও সরকার একটা নীতিমালা তৈরি করে সেখানেও উচ্চমাত্রায় কর আরোপ করতেই পারে।

এবার একটু হিসাব-নিকাশ করে দেখা যাক। ই-সিগারেট ধূমপায়ীদের জন্য অনেক কম ক্ষতিকর, ব্যয়সাশ্রয়ী। অনেক নতুন আমদানিকারক এটা আমদানির মাধ্যমে ভালো ব্যবসা করতে পারবে। খুচরা সিগারেট বিক্রেতারা ই-সিগারেট এবং এর ব্যবহার্য তরল (ই-জুস) বিক্রি করে তাদের ব্যবসা ধরে রাখতে পারবে। তামাকের ব্যবহার কমার কারণে সারাদেশে তামাক উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত চাষিদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পরিবেশগত সমস্যা অনেক কমে আসবে। এসব পণ্যে শুল্ক-কর আরোপের মাধ্যমে সরকারও তার আয় ঠিক রাখতে পারবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ই-সিগারেট সবার জন্য এক আশীর্বাদ। না, কথাটা ঠিক হলো না। ই-সিগারেট অন্তত একটা শ্রেণির জন্য ভীষণ বড় অভিশাপ। হ্যাঁ, ই-সিগারেট ব্যবসায় বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারে প্রথাগত সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর জন্য। ভয়ংকর রকম আসক্তি এবং শারীরিক ক্ষতি সৃষ্টিকারী একটি মাদক আইনি পথে বিক্রি করে অকল্পনীয় পরিমাণ উপার্জন করে কোম্পানিগুলো। ই-সিগারেট নিষিদ্ধ হতেই হবে এই কোম্পানিগুলোর স্বার্থে। এমপিদের ই-সিগারেটের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক জিহাদ ঘোষণা করার পেছনের মূল চালিকাশক্তি কারা, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি আমরা।

প্রথাগত সিগারেট প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর অর্থ, প্রতিপত্তি এবং সামাজিক পুঁজি অনেক বড়। এই দেশের সরকার জনগণের স্বার্থরক্ষা করার চাইতে ক্ষমতা এবং অর্থশালী গ্রুপের‌ স্বার্থ রক্ষার প্রতিই মনোযোগী থেকেছে। সেই অতীত অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করি, ই-সিগারেট নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে।

আইনস্টাইনের সেই বক্তব্য মতে, একজনও যদি যৌক্তিক কথা বলে সেটাই সঠিক। ১৫৩ জন প্রবল পরাক্রমশালী এমপির বিরুদ্ধে আমার মতো একজন মানুষের এই কথা একেবারেই কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না, আমি জানি।‌ জেনেও কাজটা করলাম। কারণ, মনে হলো এই রেকর্ডটুকু অন্তত থাকুক।

পাদটীকা: আমি ধূমপায়ী নই। ‌ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে কোনও সিগারেট, জর্দা এবং তামাকজাত পণ্যের কর অনেক বেশি বাড়ানো উচিত, এবং দ্রুতই এসব পণ্য একেবারেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। সদিচ্ছা থাকলে সিগারেটও পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া যায়। আমাদের কাছের দেশ ভুটান সেটা করে দেখিয়েছে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ