X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিএস, বিসিএস এবং বিসিএস

উমর ফারুক
০২ এপ্রিল ২০২১, ১৮:১৭আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২১, ১৮:১৭

উমর ফারুক
আমরা কেউ ডাক্তার হতে চাই, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। এটা অবশ্য আমাদের ইচ্ছা নয়। বড়দের চাপানো ইচ্ছা, শেখানো ইচ্ছা। হাতে গোনা কয়েকজন হতে চাই ভবঘুরে, আরও অল্প সংখ্যক সমাজসেবক। কিন্তু মানুষ হয়ে উঠতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা কম। খুবই কম। তাই তো আমাদের মাতৃগর্ভে, হৃদগর্ভে অধিকাংশ সময় বড় বড় চাকুরে জন্মায়, ডাক্তার জন্মায়, ইঞ্জিনিয়ার জন্মায়। নিশ্চিতভাবে তাদের কেউ কেউ মানুষও হয় বটে। একবার শ্রেণিকক্ষে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হতে চাও তোমরা? পেছনের সারি থেকে, অতি ডানপিটে ছেলে পিয়াল অবাক করে বলেছিল, স্যার আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে চাই। ছেলেটা সত্যি বলেছিল কিনা আমি জানি না। তবে আমি খুশি হয়েছিলাম। ভেতরে ভেতরে খুব হেসেছিলামও। আরও বেশি খুশি হতাম, আরও বেশি হাসতাম, যদি শ্রেণিকক্ষের প্রথম সারির কেউ দেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহ প্রকাশ করতো। পিয়াল এখন চাকুরে। নয়টা-পাঁচটা অফিস করে।

সন্ধ্যা নামতে কয়েক মিনিট বাকি। কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে মুকুল অপেক্ষা করছে। খুব জরুরি কিছু বলবে হয়তো। আমাকে ফোনালাপনে ব্যস্ত দেখে ব্যাগ থেকে খাতা, কলম ও বই বের করে অঙ্ক করতে বসলো।  এই দু-মিনিটের অবসরে দুটো অঙ্ক করে ফেলেছে মুকুল। গল্পে গল্পে বিস্ময়বালকটি জানালো, স্যার আমি বিসিএস ক্যাডার হতে চাই। ৪৭তম বিসিএস-এর প্রশাসন ক্যাডার পাবো। দেখে নেবেন। মুকুল আত্মবিশ্বাসী ছেলে। আমি জানি ও যা বিশ্বাস করে তা-ই বলছে। এটা ওর পক্ষে অসম্ভবও নয়। মুকুল এখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এখনই বিসিএস-এর প্রস্তুতি চলছে জোরদমে। ও প্রশাসন ক্যাডার পেলে তো অবাক হওয়ার কিছু থাকার কথা নয়।

বর্তমানে আমি এক অসুস্থ পরিবেশে বাস করছি। চারপাশের সবাই চাকরির পেছনে ছুটছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যবইয়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে বিসিএস গাইড। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে একটু আনমনা হলেই পাঠ্যবইয়ের পাতা উল্টে খুলে যাচ্ছে বিসিএস গাইড। উপস্থিতির নম্বরের ভয়ে শরীরটা হয়তো শ্রেণিকক্ষে কারও কারও থাকছে, কিন্তু মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। ক্লাস শেষেই এক ছুটে কোচিং। চাকরির কোচিং। বিসিএস-এর কোচিং।

চাকরির প্রস্তুতি আগেও ছিল। এখনও আছে। এটা আমার কাছে খুব বড় কোনও বিস্ময় নয়। কিন্তু হারুন যখন বড় গলায় বলে, স্যার আমি কোনও রকমে সিজিপিএ-৩ পেলেই বড় চাকরি পাবো, তখন আমি অবাক হই। তাহলে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সিজিপিএ-৩ পাওয়া কঠিন, কিন্তু চাকরি পাওয়া সহজ। তার অর্থ হলো, আমাদের পাঠপদ্ধতি, অধিকন্তু প্রচলিত চাকরির বাজারে প্রবেশ পদ্ধতির মধ্যে বিস্তর প্রভেদ আছে। যা পড়ে একজন সনদপত্র অর্জন করছে, তা তার কর্মজীবনে কোনও কাজে আসছে না। ফলে তাকে দুটো ভিন্ন প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপদগ্রস্ত করছে এবং চাকরির বাজারকে অতি প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে। এটা হতাশার। এটা একটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য লজ্জার। এর ফলে, রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হচ্ছে, এবং আরেকটু বাড়িয়ে বললে, যোগ্যরাই যে সব সময় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে সে ব্যাপারেও যথেষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করা কঠিন। সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে বৈকি।

৪১তম বিসিএস-এ চার লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করেন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তিন লাখেরও বেশি।  পদের সংখ্যা মাত্র দু-হাজার। হিসাবটা বলে দিচ্ছে, কী নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা। কিন্তু এক কথা সব সময় সন্দেহাতীতভাবে বলা কঠিন যে যারা এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ছেন তারা সবাই অযোগ্য। কারণ যে পদ্ধতিতে বিসিএস পরীক্ষা হয় তা সর্বজন সমর্থিত নয়। অনেকেই মনে করেন, এই পদ্ধতিতে সব সময় যোগ্যকে খুঁজে বের করা সহজ নাও হতে পারে। বলাবাহুল্য, যে নির্বাচনি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক বাছাইটি অনুষ্ঠিত হয় তার যথার্থতা নিয়ে আজ প্রশ্ন  জেগেছে। দ্বিতীয় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সর্বশেষ বিসিএস-এ পররাষ্ট্র ক্যাডারে যে ২৩ জন যোগদান করেছেন তার মধ্যে ১৪ জন ইঞ্জিনিয়ার ও ৫ জন ডাক্তার। তথ্যটি অবাক করা। বিশেষত হতবাক করা। যে কেউই নিশ্চয়ই যেকোনও ক্যাডারে যেতে পারেন। এই পথ উন্মুক্ত থাকাই ভালো। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই যে, রাষ্ট্র অর্থ ব্যয় করে একজন ডাক্তার কিংবা একজন ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সাধারণ শিক্ষা ব্যয় ও বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যয় সমান নয়। ফলে, যখনই একজন বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণকারী বিবিএস-এর মাধ্যমে ভিন্ন ক্যাডার গ্রহণ করেন তখন রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়। আবার তাকে ক্যাডার বদল করার সুযোগও দিতে হবে। ফলে এর বিকল্প হিসেবে, যারা ক্যাডার পরিবর্তন করছেন, অর্থাৎ বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন, তাদের পেছনের রাষ্ট্রের ব্যয়িত অর্থ ফেরত নেওয়া যেতে পারে। জরিমানা করা যেতে পারে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা চাকরিমুখী। কোনোরকমে একটি সনদ দরকার। উদ্দেশ্য চাকরি। এবং সেই চাকরির ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে লোভনীয় বিসিএস। একথা সত্য, যোগ্যদের বিসিএস ক্যাডার হওয়া আবশ্যক। কিন্তু শুধু বিসিএস ক্যাডারকে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করলে অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মনে রাখা দরকার, সব খাতেই মেধাবীদের পদচারণা আবশ্যক। সে জন্য সুযোগের ব্যাপক বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে এবং একই সঙ্গে ক্যাডার বৈষম্যও কমিয়ে আনা অতি আবশ্যক।

শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য চাকরি হতে পারে না। পেশার একমাত্র গন্তব্য বিসিএস হতে পারে না। দেশে অনেক পেশা আছে। তাছাড়া পেশা হিসেবে উদ্যোক্তাও খারাপ নয়। সব সময় চাকুরে না হয়ে চাকরি দেওয়ার মানসিকতা আমাদের শিক্ষাকে আরও প্রায়োগিক ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। আমাদের চাকরি প্রাপ্তি পদ্ধতিতে বিরাট এক পরিবর্তন আবশ্যক এবং তা এখনই। যদি তা সম্ভব না হয় এবং শিক্ষার্থীদের চাকরিমুখী মানসিকতা থেকে ফেরত আনা না যায়, তাহলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের শ্রেণিকক্ষের পাঠদান প্রক্রিয়া। বাস্তবতা হলো, চরম এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে আমাদের চাকরি গ্রহণ প্রক্রিয়া। সাধারণ জ্ঞাননির্ভর নির্বাচন প্রক্রিয়া আমাদের ক্রমাগত ভাবিয়ে তুলছে। বিকল্প থেকে উত্তর বেছে নেওয়ার যে প্রতিযোগিতা পদ্ধতি তা আমাদের ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলছে। চাকরি পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের শ্রেণিকক্ষের একটি যোগসূত্র, একটি সংমিশ্রণ আবশ্যক। তাহলে আরও প্রায়োগিক ও আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে শ্রেণিকক্ষ।

চারদিকে শুধু ক্যাডার হওয়ার প্রতিযোগিতা। চাকুরে হওয়ার প্রতিযোগিতা। এটা কোনও শুভ লক্ষণ নয়, হতে পারে না। এই সংকট থেকে মুক্তি এখনই আবশ্যক। প্রয়োজনে বিসিএস-এ অনার্স কোর্স চালু করা হোক! মাস্টার্স কোর্স চালু করা হোক, এবং সবাইকে সেখানে ভর্তি করা হোক! অথবা শ্রেণিকক্ষ ও চাকরি প্রাপ্তি প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করা হোক। আরও একটি বিকল্প হতে পারে। সেটি হলো, শিক্ষার্থীদের চাকরিতে নিরুৎসাহিত করা। কাজটা স্বল্প সময়ে সহজ নয়, কঠিন। তবে পদ্ধতি যাই হোক না কেন, শিক্ষার্থীদের ‘বিসিএস, বিসিএস এবং বিসিএস’ মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার অথবা অভিভাবকদের অতি প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার পরিবর্তন দরকার, অথবা রাষ্ট্রের ক্যাডার বৈষম্য দূরীকরণ অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির সব পেশাকে যৌক্তিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা দরকার, অন্যথায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ