X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

খুলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রয়েছে শঙ্কাও

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:১২আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:১২

ড. প্রণব কুমার পান্ডে ১৭ মার্চ ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করোনা অতিমারির বিপর্যয়ের কারণে বন্ধ থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না যেতে পেরে অলস সময় অতিবাহিত করেছে প্রায় দেড় বছর। এ সময় অনেকের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে তাদের শিক্ষা জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন  শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অনলাইন ক্লাস এবং অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম চলমান থাকলেও অনেকেই এই কার্যক্রমের আওতায় বাইরে ছিল বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হলেও এখন পর্যন্ত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের গতি ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ডিভাইসের অপ্রতুলতা।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সরকারি বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম সফল করার জন্য শিক্ষকমণ্ডলীরও দায় রয়েছে। কারণ, শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা এখনও নিজেদের অনলাইন কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত করে উঠতে পারেননি। বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকলেও সরকার বারবার চেষ্টা করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কিছু সময় বিরতির পর কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় বারবার সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়েছে। যাহোক, করোনার তৃতীয় ঢেউ যখন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে ঠিক সেই সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  সিদ্ধান্তটি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কিছু গাইডলাইন বা নির্দেশনা প্রস্তুত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিতরণ করেছে। পঞ্চম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেক দিন ক্লাসের ব্যবস্থা রেখে অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য একদিন স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে হয়। কারণ, শিক্ষার্থীরা একদিন স্কুলে গেলেও তাদের মানসিক বিপর্যস্ততা কাটিয়ে ওঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
 
শিক্ষার্থীরা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। শিক্ষার্থীশূন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মরুভূমির মতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তে নিশ্চিতভাবেই প্রাণের সঞ্চার হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তবে আমাদের মধ্যেও এক ধরনের শঙ্কাও সব সময় কাজ করছে। আমরা নিকট অতীতে আমেরিকার অভিজ্ঞতার দিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে দেখবো, সেখানে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার্থীদের করোনা আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এমনকি আক্রান্ত শিশুদের একটি বড় অংশকে আইসিইউতেও ভর্তি করতে হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা সত্যিই আমাদের শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। আর এ কারণেই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী  যে বার্তাটি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তা হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলায় কিংবা করোনা পরিস্থিতি আবার যদি খারাপ হয় তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শঙ্কা থাকলেও গত কয়েক দিন ধরে যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম চলছে তাতে সত্যিই আনন্দিত আমরা।

তবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান এবং পরীক্ষা চলমান রাখার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের বিষয় আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ-সুবিধা উন্নত দেশের মতো নয়। তবে অত্যন্ত আশার খবর হচ্ছে, খোলার পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সরকারের গাইডলাইন মেনে চলার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা গেলেও ক্লাসরুমগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো সক্ষমতা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের নেই। কারণ, ছোট ছোট শ্রেণিকক্ষে অনেক বেশি শিক্ষার্থীর ক্লাস নেওয়া হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে।

স্বীকার করতে হবে, এসব বিষয় মাথায় রেখেই একই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কয়েকটি ভাগ করে পাঠদান করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, দেড় বছর বাসায় অবস্থান করায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এখন তারা কতটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবে সেটাই বিচার্য। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ করেছি, শিক্ষার্থীরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে, মাস্ক খুলে গল্প করছে এবং এমনকি নিজেদের টিফিন ভাগাভাগি করছে।  এসব অবশ্য তারা আবেগে করছে। এখন স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে শিক্ষার্থীরা যদি দূরত্ব বজায় না রাখে, তবে  নিজেরা আক্রান্ত হতে পারে, তেমনি পরিবার এবং দেশে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।

সুরক্ষাবিধি মেনে চলার জন্য শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।  অভিভাবকরা সন্তানদের যদি বোঝাতে সক্ষম হন স্কুলে সহপাঠী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করতে হবে, মাস্ক পরতে হবে এবং বারবার হাত ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে, তবেই আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এসব না মানলে করোনা পরিস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি নিশ্চিত করা যেমন একটি চ্যালেঞ্জ, তেমনি অভিভাবকদের সুরক্ষাবিধি মেনে স্কুলের বাইরে অবস্থান করার বিষয়টি নিশ্চিত করা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। মিডিয়ায় এসেছে, স্কুল গেটের বাইরে গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন অভিভাবকরা, যা অত্যন্ত ভয়ের একটি বিষয়।  অস্বীকার করার উপায় নেই অভিভাবকরা অনেক দূর থেকে সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসেন এবং বসে থেকে স্কুল শেষে বাসায় নিয়ে যান। একবার স্কুলে আসার পরে বাসায় ফিরে পুনরায় স্কুলে আসা তাদের জন্য কঠিন। এ জন্যই তারা স্কুলের বাইরেই অপেক্ষা করেন।

মনে রাখতে হবে, অভিভাবকরা যদি নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে না পারি, তাহলে সন্তানদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। অনেক অভিভাবক মিডিয়ায় বলেছেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের বসার কোনও ব্যবস্থা করেনি। তবে, এখানে স্কুল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশে অনেক স্কুল রয়েছে, বিশেষ করে যেগুলো শহরে অবস্থিত, সেই স্কুলগুলো অল্প জায়গার ওপরে নির্মিত। তাদের পর্যাপ্ত জায়গা নেই, যেখানে বসার ব্যবস্থা করতে পারে। ঢাকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে বিভিন্ন ভবনে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে অভিভাবকরা স্কুলের বাইরে গাদাগাদি করে অবস্থান করেন। অভিভাবকরা যদি এরইমধ্যে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তবে খুব দ্রুত অন্যরা আক্রান্ত হবেন এবং পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করবে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে। কেউই এখন সঠিকভাবে বলতে পারবো না কবে আমরা করোনামুক্ত পৃথিবীতে বাস করতে পারবো। ফলে, করোনা পরবর্তী নিউ নরমাল জীবন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। যদি খাপ খাইয়ে চলতে না পারি তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়বো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ঠিকই এগিয়ে চলেছে। আমাদেরও উচিত তা করা। এটা করতে পারলেই করোনা সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।

শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নত দেশের সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করা কখনোই সমীচীন হবে না। দীর্ঘদিন  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করাও ঠিক হবে না। এখন পরিস্থিতি যেহেতু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাই আমরা যদি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করি, তাহলে একদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন রক্ষা করা যাবে।


লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ