X
রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্ব কার?

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৩৯আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৩৯
ড. প্রণব কুমার পান্ডে আমি ধর্ম বিষয়ে কোনও বিশেষজ্ঞ নই।  তবে সময়ের আবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ অল্প বিস্তর পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, প্রতিটি ধর্মই পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথা বলে। পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষ যে ধর্মগুলো পালন করে সেই প্রত্যেকটি ধর্মের মূল কথা হচ্ছে যে যার ধর্ম সমানভাবে পালন করবে এবং পরের ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি অন্যতম স্তম্ভ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে সবসময় অবস্থান করবে। আমরা যুগের পর যুগ ধরে দেখেছি যে বাংলাদেশে কীভাবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে একসঙ্গে বসবাস করেছে। তবে কখনও কখনও কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছু উত্তেজনা তৈরি হলেও সেগুলো ছিল একটি শ্রেণির রাজনীতির ফসল।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় যে কথাটি বলেন সেটি হলো, "ধর্ম যার যার, উৎসব সবার"। এই বোধকে হৃদয়ে ধারণ করে বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ বিভিন্ন ধর্মের উৎসবগুলোতে একত্রিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। এটিই আবহমান বাংলার পরিচয়। যুগের পর যুগ এখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কাউকে বিচার না করে বসবাস করে আসছে। ঈদের সময় যেমন সর্বজনীনভাবে হিন্দুরা অংশগ্রহণ করে, ঠিক তেমনি হিন্দুদের দুর্গোৎসবে শুধু হিন্দুরাই আনন্দ করে না, একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এটিই হচ্ছে আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও চরিত্র। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করার চেষ্টা করেছে। কখনও বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা কখনও সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচার একসময় বাংলার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। তবে গত এক দশকে পরিস্থিতি বদলে গেছে। তবে এটি ঠিক বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে এই দেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার।

আমরা নিজেদের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এই পরিচয় কখনোই পরিচিত করতে চাই না। সবাই বলতে চাই আমরা বাংলাদেশি এবং এটিই আবহমান বাংলার বেশিরভাগ মানুষের হৃদয়ের চাওয়া। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শারদীয় দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, প্রতিমা, বাড়িঘর  ভাঙা এবং কোথাও কোথাও শারীরিকভাবে যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর নির্যাতন পরিচালনা হয়েছে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুধু হিন্দুদের আহত করা হয়েছে বিষয়টি সেরকম নয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ এই বিষয়টিতে আহত হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের ঘটনা হঠাৎ করেই কেন ঘটলো?  প্রতিবছর বাংলাদেশে হাজার হাজার পূজামণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হয়। আমরা যদি গত এক দশকের চিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করি তাহলে দেখবো এই ধরনের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে তেমনভাবে ঘটেনি। তাহলে কি সত্যিই এটি কোনও পরিকল্পনার অংশ ছিল? এই ধরনের অশান্তি এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে কোনও স্বার্থান্বেষী মহল তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যই কি এই কাজটি করেছে।

এখানে দ্বিমত করার কোনও উপায় নেই যে এটি কোনও না কোনও কুচক্রী মহলের চিন্তার ফসল। এটি হয়তো একটি বড় রাজনৈতিক পরিকল্পনা অংশ, যার মাধ্যমে চেষ্টা করা হয়েছিল বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অথবা কোনও গোষ্ঠীর ক্ষমতা পরিবর্তনের নীলনকশার পরিকল্পনার অংশ। তারা চেষ্টা করেছিল আরও ব্যাপকভাবে বিষয়টিকে যদি বাংলাদেশের সব জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া যেত তাহলে পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপের দিকে যেতে পারতো। কিন্তু সেটা করতে তারা ব্যর্থ হলেও যে ঘটনাগুলো গত কয়েকদিন ধরে ঘটেছে সেটা সত্যিই আমাকে খুব ব্যথিত করেছে।  আগেই বলেছি আমি কখনও নিজেকে কোনও ধর্মের অনুরাগী হিসেবে দেখতে পছন্দ করি না। যার জন্য প্রথম দিকে এ বিষয়গুলোকে আমি সত্যি সত্যি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এ বিষয়ে লেখার আগ্রহ প্রকাশ করিনি। কিন্তু ঘটনার পরিক্রমায় যেভাবে রংপুরের একটি জেলে পল্লিতে আগুন দেওয়া হয়েছে সেই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েছি এই লেখাটি লেখার।

এখন একটি প্রশ্ন হচ্ছে একটি দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে কার? অনেকেই বলবেন যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি  বজায় রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই উত্তরটি কী আসলে সঠিক- এটা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের একার পক্ষে একটি দেশে সম্প্রীতি বজায় রাখা সম্ভব নয়। অবশ্যই অনেকেই আমার এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। কারণ, রাষ্ট্রের রয়েছে প্রশাসন, যা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রশাসনের শক্তি দিয়ে মানুষের মনের ভেতরে যে পৈশাচিকতা আছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আর এই কারণেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের জনগণের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা যদি নিজেদের দায়িত্ব পালন করি এবং নিজেদের সাম্প্রদায়িক না ভেবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কল্পনা করি, তাহলেই সম্ভব এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা। আর আমরা যদি নিজেদের পৈশাচিক হিসেবে বিবেচনা করি এবং গুজবে কান দেই, তাহলে এর পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে।

তবে, জনগণের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও অনেক দায় রয়েছে। বিশেষ করে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা, যারা স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের। কুমিল্লাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেই সময় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার নির্দেশনা প্রদান করেছেন যাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিজেদের অবস্থান থেকে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু  অনেক নেতাকে দেখেছি এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করতে। তাদের এই নির্বাক ভূমিকা কীসের ইঙ্গিত? তাহলে কি  যারা আজ আওয়ামী লীগের পদ-পদবি নিয়ে বসে আছেন তারা মনেপ্রাণে সাম্প্রদায়িক? তারা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা ধারণ করেন না? এই বিষয়টি সত্যিই ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।

যেসব দল সাম্প্রদায়িক দল নিয়ে রাজনীতি করে তাদের কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা কখনও আশা করা যায় না। কিন্তু যে দলের স্রষ্টা এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা অসাম্প্রদায়িক ধারণার বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, সেই দলের নেতাকর্মীদের কাছে এটি সত্যিই কাম্য নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের কিছু নেতাকে যে ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করতে দেখেছি সেটাও আমাদের ব্যথিত করেছে। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক দল। সেই দলের নেতারা যদি সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলেন তাহলে যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে তাদের জন্য বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় হবে। গত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা কমে যাবে।

দুর্বলের ওপর সবলের আঘাতে কোনও জাতির বীরত্ব প্রকাশ পায় না। কোনও জাতি তখনই নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারে, যখন তারা দুর্বলকে মর্যাদা দিয়ে একসঙ্গে বসবাস করে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক এবং বাহক। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশকে ধারণ করার জন্য প্রয়োজন সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সহাবস্থান। আর এই সহাবস্থান যারা নষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে শক্ত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণ এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যদি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলেই  সম্ভব এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাভূত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মব সন্ত্রাস ছেড়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জামায়াতের
মব সন্ত্রাস ছেড়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জামায়াতের
‘মেসি ফুটবল খেলে খুশি’
‘মেসি ফুটবল খেলে খুশি’
রাউজানে প্রকাশ্যে যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা
রাউজানে প্রকাশ্যে যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা
৯০তম জন্মদিনে আরও ৪০ বছর বাঁচতে চান দালাই লামা
৯০তম জন্মদিনে আরও ৪০ বছর বাঁচতে চান দালাই লামা
সর্বশেষসর্বাধিক