X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৭১-এর বুদ্ধিজীবী শূন্যতা পূরণ হয়েছে কি?

আনিস আলমগীর
১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:২৭আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:৫০

আনিস আলমগীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাতেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাও যুক্ত ছিল। সে কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হত্যার সঙ্গে শিক্ষকদেরও ঘর থেকে তুলে এনে হত্যা করা হয়। সেই ধারা যুদ্ধের সময়জুড়ে বজায় ছিল। কিন্তু এই দেশটিকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেওয়ার একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনা থেকে ১০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মি খুঁজে-খুঁজে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। পাকিস্তানি হায়নাদের সহায়তা করেছে জামায়াতে ইসলামী এবং অবাঙালি পাণ্ডারা।

ইতিহাস বলে এই কাজটির মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল আল বদর, আল শামস বাহিনী। এ দুটি সংগঠনের মূল নেতৃত্ব ছিল জামায়াতে ইসলামীর কুখ্যাত ছাত্রনেতারা এবং পাকিস্তানের সমর্থক অবাঙালি খুনিরা। ‘আল বদর’ নামক এই সংগঠনটি গঠন করেছিল হিটলারের গেস্টাপোর আদলে। কিন্তু নামকরণ করেছিল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর বদর যুদ্ধের অনুকরণে, তারা ধর্মের অপব্যবহার করেছে ধর্মের নামে। তাদের এই আল-বদর বাহিনীর সদস্য সংগ্রহ করা হতো মূলত পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের থেকে। প্রতিটি ইউনিটে ৩১৩ জন করে সদস্য থাকতো। কারণ, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিম সেনার সংখ্যা ছিল ৩১৩।

বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিল বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন (অপারেশন ইন-চার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। খুনিদের মধ্যে নানা ভূমিকায় ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদী, এবিএম খালেক মজুমদার, মাওলানা আবদুল মান্নান, আবদুল কাদের মোল্লা প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে জেনারেল রাও ফরমান আলীর স্বহস্তে লিখিত যে ডায়েরি পাওয়া যায় তাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি হতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায়, যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছিল।

চৌধুরী মঈনুদ্দীন ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। যুদ্ধ শেষে এই খুনি বাংলাদেশ ছেড়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়েছে এবং এখনও সেখানে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত আছে। সে তার কর্মস্থল অবজারভার ভবন থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলীকে পৌঁছে দিতো। সারা দেশে এক হাজারের বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের স্মরণে ১৪ ডিসেম্বরকে আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করে আসছি।

বেছে বেছে জাতির সূর্যসন্তানদের হত্যা করা প্রসঙ্গে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছে তা হলো, ‘এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নির্বীজ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেয়া। ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তারপর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ হতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে।’

রাও ফরমান আলীরা যুদ্ধের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কবি, লেখক, চলচ্চিত্রকার, সংগীতকার, চিকিৎসক, সাহিত্যিকদের হত্যা করেছিল। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যখন দেখে পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখন তারা নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক- সব দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। বন্দি অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। তাদের লাশ ক্ষত-বিক্ষত করে রাখা হয়। অনেককে চেনা যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। পাওয়া যায়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে ঢাকায় রায়ের বাজার এবং মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে তাদের লাশের স্তূপ ছিল।

ডিসেম্বরে এসে যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের সিংহভাগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, অনেকে জীবনে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দেননি, যদিও তারা স্বাধীনতা কামনা করেছেন মনে প্রাণে। সম্মুখ যুদ্ধেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য সংখ্যক। যুদ্ধকালে বহাল তবিয়তে পাকিস্তান সরকারের চাকরি করার জন্য এখনও অনেকে তাদের সমালোচনা করতে শুনি। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে জাতিকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার মতো বড় মাপের কবি-সাহিত্যিকদের রচনাও নেই আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারে। অথচ স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী- এমন অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল। একটাই উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি হায়নাদের- বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দেওয়া।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনও স্বপ্নই সত্য হতে দেয়নি বাংলাদেশ। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ সব সূচকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু যেসব বুদ্ধিজীবীকে তারা হত্যা করেছিল, আমাদের মেধাশূন্য করেছিল, জাতি হিসেবে আমরা সেই বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছি কিনা? কেউ বলবেন, ১৯৭১-এর পর কয়েক প্রজন্ম মিলে বাংলাদেশে নতুন একটি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহল দাঁড়িয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষ ১৯৭১ সালে যে মাপের বুদ্ধিজীবীদের আমরা হারিয়েছি সেই মাপের বা তার থেকেও অনেক বড়মাপের বুদ্ধিজীবী এ দেশে সৃষ্টি হয়েছে।

অন্য পক্ষ বলবেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল জাতি হিসেবে তা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধের পর পরই নতুন রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে মেধাহীন লোকেরা স্থান পেয়েছে। এমনকি সেই শূন্যতা পূরণ করতে পাকিস্তান ফেরত বা পাকিস্তানিমনাদেরও নানা সেক্টরে রেখে দিতে হয়েছিল। যার কারণে স্বাধীন দেশের সব কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের আদলেও চলছে, নামে ভিন্নতা এসেছে শুধু।

এই শূন্যতার আরেকটি কারণ বিজয়ী রাষ্ট্র তার মূলনীতিগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়ার আগেই, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রতিবিপ্লবের সম্মুখীন হয়েছে। ফলে নানা সেক্টরে যে পরিমাণ এবং যে মাপের বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি। আর দীর্ঘ সামরিক শাসনে একটি পোষ্য ভারাক্রান্ত, মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবী সমাজ গড়ে উঠেছে, যার রেশ গণতান্ত্রিক শাসন আমলেও বহমান। এই ধরনের মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবী সমাজ দিয়ে রাষ্ট্র কতটা এগুতে পারবে তা নিয়েও কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন। যে জাতির স্কলার নেই, স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী সমাজ নেই, আরও স্পষ্ট করে বললে- মেরুদণ্ডসম্পন্ন সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠেনি- সে জাতি অবকাঠামোগতভাবে উন্নত রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে সত্য কিন্তু পৃথিবীতে তারা জাতি হিসেবে কতদিন টিকবে তার গ্যারান্টি নেই।

তবে সব বিতর্ক একদিকে ফেলে রেখে আমরা একবাক্যে স্বীকার করতে পারি যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের যেটুকু অর্জন, রাষ্ট্র হিসেবে যতটা এগোতে পেরেছে- তা একেবারেই নগণ্য নয়। সে হিসেবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যে ত্যাগ, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবনদান- বৃথা যায়নি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ