X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ইস্যুতে পাকিস্তানের রূপ পরিবর্তন

ফারাজী আজমল হোসেন
২০ ডিসেম্বর ২০২১, ১৩:৪০আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২১, ২১:৫৬

ফারাজী আজমল হোসেন বিগত ৫০ বছর যাবৎ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় কোনও আগ্রহ ছিল না পাকিস্তানের। দেশটি তার পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের জন্মকে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে নতুন প্রচারণায় নেমেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশ ইস্যুতে পাকিস্তানের এই রূপ পরিবর্তনের কারণ কী?

২০০১ সালে জামায়াত বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় পাকিস্তান। বিষয়টি কারও অজানা নয়। বাংলাদেশের বুকে খুব সম্ভবত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে এসেছে দেশটি। ১৯৭১ সালে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণের কলঙ্কিত স্মৃতির জন্য খুব সম্ভবত ভারতের পর সবচাইতে বেশি পাকিস্তান দায়ী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে। আর এ কারণেই ১৯৭১ সালে তাদের সহায়ক হিসেবে যেমন ছিল শান্তি কমিটি, ২০০১ সালে সেই শান্তি কমিটির মতোই কাজ করে গেছে জামায়াত-বিএনপি। এ সময়ে ১৯৭১ সালের মতোই হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চলেছে বাংলাদেশে। স্বাধীন রাষ্ট্রে পরাধীন অবস্থায় থাকা বনেদি হিন্দু পরিবারের অনেকেই বাংলাদেশ ছেড়ে এ সময় চিরতর আশ্রয় নেয় ভারতে। হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালের শান্তি কমিটির কথা মাথায় রেখেই খুব সম্ভবত তৎকালীন জামায়াত নেতাদের অত্যাচারকে ‘শান্তির আগুন’ বলে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়, যেখানে ২৪ জন নিহত হন এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় ৩০০ নেতাকর্মী আহত হন। এই গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের বুক থেকে মুছে ফেলা। কেননা, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দেশের মানুষ নতুন করে খুঁজে পায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অর্থকে। যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এ দেশ থেকে মুছে দিতে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে তারই কন্যার হাত ধরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করবে, এটা কল্পনাও করেনি পাকিস্তান ও তার এদেশীয় সমর্থকেরা। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন, তখন আবারও আরেকটি ১৯৭৫ ঘটানোর চেষ্টা ছিল তাদের। বঙ্গবন্ধু পরিবারকে এই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার সেই মিশনে ১৯ বারের বেশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যাকে নিজ হাতে রক্ষা করেছে, তাকে মারার ক্ষমতা পাকিস্তানের বা তার সহযোগীদের নেই। আর এ কারণেই আজও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার কন্যার হাত ধরেই আজ বিশ্বের বুকে নতুন এক পরিচয় পেয়েছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার হাত ধরেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে শিক্ষা, অর্থনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিনিয়োগ, ঋণমুক্ত অর্থনীতি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তানের যেই ভয় ছিল তা আজ বাস্তবতা। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ যে কোনও ভুল করেনি তা আজ প্রমাণিত। আর এ কারণেই এখন বাংলাদেশ ইস্যুতে ভিন্ন পথে হাঁটছে পাকিস্তান।

বিগত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দেশদ্রোহী’ অ্যাখ্যা দিয়ে এসেছে পাকিস্তান। কিন্তু ২০২০ সালের শেষভাগ থেকে তাদের এই বক্তব্য থেকে সরে আসছে দেশটি। বিগত ১২ মাসে একাধিকবার সেনাবাহিনী শোষিত দেশটিতে পাক-বাংলা সম্মেলন, পাক-বাংলা কনফেডারেশনসহ বিভিন্ন নামে একাধিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এ বিষয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে খুঁজলে কয়েক হাজার ভিডিও পাওয়া যাবে, যার অধিকাংশ ইংরেজি ও বাংলা সাবটাইটেল বা অনুবাদ করে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এসব অনুষ্ঠানের বার্তা প্রচারে গুগল ও ফেসবুক প্রমোশনের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। মজার বিষয় হলো, প্রতিটি সেমিনার, ভিডিওর বিষয় খুবই কাছাকাছি। এখন আর বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ বলছে না পাকিস্তান। বরং তাকে সত্যিকার "পাকিস্তানপ্রেমী" হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত তারা। ৭ মার্চের ভাষণ এবং ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছে, ‘শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিল’ এবং ‘তিনি দেশভাগ চাননি’। তিনি কতটা "পাকিস্তানপ্রেমী" ছিলেন তা প্রমাণ করতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ভিডিও এডিট করে তার শেষে ‘জয় বাংলা’- এই কথার পর ‘জয় পাকিস্তান’ জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক পূর্বের কোনও রেকর্ড করা ভাষণ থেকে নেওয়া বলে অনেকে জানিয়েছেন।

পাক-বাংলা কনফারেন্সে পাকিস্তানের সুশীলগণ এখন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণ দায় দিচ্ছেন তৎকালীন নেতৃত্বে থাকা ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও নিয়াজীকে। সেই সঙ্গে তাদের অভিযোগ, ১৯৭১ সাল হওয়ার পেছনে এবং ইয়াহিয়া, ভুট্টো এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি করতে সহায়তা করেছে ভারত! তবে মজাদার বিষয় হলো, বারবার ১৯৭১ সাল ও তৎকালীন সময় বাংলাদেশে চলা মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে কথা বললেও কোনও বক্তাই এ দেশে চালানো ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যা বা দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চালানো গণহত্যার কথা উল্লেখ করেননি। বরং তাদের ভাষা ছিল- ‘ওয়াহা পে যো হুয়াথা, ওয়ো গালাত থা’। অর্থাৎ ওখানে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) যা হয়েছে তা ভুল হয়েছে। কিন্তু ভুলটা কী করেছে তার কোনও বর্ণনাতে যাওয়ার সাহস কোনও বক্তাই দেখাননি। বরং তারা অধিকাংশ বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকিস্তানের জন্য সত্যিকারের দেশপ্রেমিক’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করে।

পাকিস্তান প্রচারিত এসব বার্তায় বারবার বলার চেষ্টা করা হয় যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কনফেডারেশন চেয়েছিলেন, তিনি দুই দেশ তৈরি করতে চাননি।’ কিন্তু এক্ষেত্রেও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়ে কোনও আলোচনা করেনি তারা।

গোলাম আযমের বইয়ের ভাষায় সম্প্রতি পাকিস্তান প্রমাণ করার চেষ্টা করছে ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কোনও বৈষম্যই করেনি পশ্চিম পাকিস্তান! এ ক্ষেত্রে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, আদমজী জুটমিল থেকে শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি এবং এমন আরও অনেক উদাহরণ টেনে ধরা হয় এবং দাবি করা হয়, বাংলাদেশের মানুষের এজন্য ‘পাকিস্তানের শুকরিয়া আদায় করা উচিত’।

কিন্তু এই আলোচকও বলতে ভুলে গেছেন, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে নির্মাণ করা হয় বা আদমজী জুটমিল থেকে শুরু করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত সব শিল্প কারখানার মালিক বা কর্মকর্তা ছিলেন কারা এবং শ্রমিক ছিলেন কারা। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না ঘটালেও যে আজকের দুর্বার বাংলাদেশ ঠিকই সব বাধা পেরিয়া পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতো, এ বিষয়ে কি কোনও সন্দেহ রয়েছে?

১৯৭১ সালে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের জন্য কখনোই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে ফেরত যাওয়া ৯৩ হাজার সৈন্যকে। আর পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার ১ বছরের মধ্যেই এই সৈন্যদের দিয়ে বেলুচিস্তানে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। কিন্তু কোনও ঘটনার জন্যই এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনও সেনা কর্মকর্তা বা সৈন্যকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেই ভুল করেছে সে বিষয়েও কখনও আলোচনা করেননি কোনও সুশীল।

এক্ষেত্রে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সবচাইতে বেশি দ্বিমুখী আচরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের মসনদে বসার বেশ আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত থাকার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর বিষয়টি নিয়ে আর কখনোই কথা বলেননি। পাকিস্তানের সুশীলরাও বারবার তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করলেও মোটাদাগে সেনাবাহিনীর যে ভুল, তা নিয়ে কোনও কথা বলেনি।

উল্টো চলতি বছর ১৬ ডিসেম্বর এক নতুন ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে দেশটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে। ‘সেপারেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান— দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ নামের এই ডকুমেন্টারিতে বারবার যে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো- ‘পাকিস্তান থেকে স্বাধীন জাতি চাননি শেখ মুজিব’। দেশটির সাবেক সিনেটর ও ফেডারেল তথ্যমন্ত্রী জাভেদ জব্বার সম্প্রতি ডন পত্রিকায় এমন মন্তব্যও করেন।

এই ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও নিরাপত্তাহীনতাকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলে পাকিস্তানের স্বাধীনতা নস্যাৎ করেছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। পূর্ব পাকিস্তানের নানা সংকট ব্যবহার করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কৃত্রিম সমস্যা বানিয়ে আঞ্চলিক অস্থিরতা তৈরি করা হয়। আর এই সময়ে বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবী নেতারা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেন।’

ডকুমেন্টারির এই ভাষাই বলে দিচ্ছে কেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ওপর এত আক্রোশ পাকিস্তানের। আর কেনই বা দেশের সূর্যসন্তানদের ১৪ ডিসেম্বর খুঁজে খুঁজে এনে হত্যা করা হয়েছিল। 

এখানে আরও দাবি করা হয়, ‘১৯৭১ সালে যে হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের সংখ্যা বলা হয় এটা ভারতের তৈরি এবং পাকিস্তানের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের মানুষিক বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্যই এমনটা করেছে ভারত।’

কিন্তু বাংলাদেশে যেই প্রত্যক্ষদর্শীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে রক্তের গঙ্গা বইতে দেখেছে, যারা ঢাকার প্রতিটি মোড়ে ২৬ মার্চ লাশ পড়ে থাকতে দেখেছে, তাদের কারও বক্তব্য এখানে স্থান পায়নি। স্থান পায়নি নিরপেক্ষ কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হাস্যরসের জন্ম দেওয়ার জন্যই যেন ১৬ ডিসেম্বর এই ডকুমেন্টারি উন্মুক্ত করা হয়।

শুধু তাই নয়, জাভেদ জব্বার এই সিনেমা নিয়ে মন্তব্য করেন, ‘১৯৭১ ছিল যন্ত্রণা ও বিষণ্ণতার। ১৯৭১ সালের ট্র্যাজেডি নিয়ে অনেক সুলিখিত বই ও বিপুল পরিমাণ সাহিত্য খুঁজে পাওয়া গেলেও এই বিষয়ে একটি তথ্যচিত্রও আমি খুঁজে পাইনি। তাই এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছি।’

অর্থাৎ তার দাবি অনুসারে এটি ১৯৭১ সাল নিয়ে একমাত্র তথ্যচিত্র! বাকি যা তৈরি হয়েছে সবই প্রোপাগান্ডা। বিবিসি, সিএনএন বা যেই তৈরি করুক না কেন, ১৯৭১ সাল নিয়ে তার এই ডকুমেন্টারির আগে কিছুই তৈরি হয়নি!

মজাদার বিষয় হলো, বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছরকে সামনে রেখে আরও একটি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বাজারে ছাড়ে পাকিস্তান, যার নাম ‘খেল খেল মে’। বাংলাদেশে যেই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে সে বিষয়ে কতটা এই চলচ্চিত্রে বলা হয়েছে তা বেশ ভালো অনুমান করা যায়। কিন্তু তার থেকে বড় বিষয় হলো বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার জন্য এবং বেলুচিস্তানে বিগত ৪৯ বছর ধরে চালানো হত্যাকাণ্ডের জন্য এই চলচ্চিত্রেও দায়ী করা হয় ভারতকে। সেই সঙ্গে আরও বলা হয়, ‘ভুল হয়েছে একটি, যারই ভুল হোক, আসুন ক্ষমা চেয়ে নিই।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কোনও ভুলের এখানে তুলনা করা হচ্ছে, তা হয়তো এই চলচ্চিত্রের পরিচালক নিজেও জানেন না।

তবে এই চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি এবং সেমিনারের মাধ্যমে বারবার একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। আর তা হলো- বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে ‘সত্যিকার পাকিস্তানপ্রেমী’, ‘পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাসহ আরও অনেক প্রশংসা করছে। এর অন্যতম কারণ একাধিকবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা শেষে ব্যর্থ হয়েছে তারা এবং দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও তার এদেশীয় সমর্থকরা জেনে গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া তাদের জন্যও আর কোনও উপায় নেই। আর এ কারণেই এখন বাংলাদেশের প্রশংসা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা হচ্ছে পাকিস্তানে। সেই সঙ্গে পাকিস্তান যে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেটিও অনুমান করা যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্যই প্রতি মাসে আয়োজিত হচ্ছে পাক-বাংলা কনফারেন্সের মতো বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান।

তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাইলেই কি আমরা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দিতে পারবো? যেই নির্লজ্জতা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে চলে যাওয়া ৯৩ হাজার সৈন্য দেখিয়েছে তার বিচার ছাড়াই আমরা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দেবো? ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখের বেশি নারীর সম্ভ্রমহানির দায় অস্বীকার করা পাকিস্তানকে আমরা ক্ষমা করে দেবো? যেই পাকিস্তানের কারণে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেই পাকিস্তানকে আমরা ক্ষমা করে দেবো? যেই পাকিস্তানের কারণে আজও এই দেশে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস পায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো, সেই পাকিস্তানকে আমরা ক্ষমা করে দেবো? পাকিস্তান না হয় চীনের ঋণের দায়ের নিচে থেকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশের কাছে, আমরা কেন সেই ক্ষমা গ্রহণ করবো?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ