X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়ের বাহানায় কারও অধিকার বঞ্চিত করা যায় না

জোবাইদা নাসরীন
২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৫৮আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৫৮

জোবাইদা নাসরীন কয়েক বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে একজন ছাত্রী তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর কাউকে জানায়নি। মেয়েটির পরিবারও জানতো না। এমনকি মেয়েটির রুমমেটরাও তার শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারেনি। রুমের মধ্যে মেয়েটি সন্তান প্রসব করার পর কাউকে না জানিয়ে সন্তানকে ট্রাংকের ভেতর লুকিয়ে রাখে। পরে রুমমেটরা রুমে ফিরে এলে ট্রাংকের ভেতর থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ পায়। পরে সেই ট্রাংক ভেঙে দেখা যায় সেখানে একটি বাচ্চা রয়েছে। তবে দীর্ঘক্ষণ ট্রাংকের ভেতর থাকায় অক্সিজেনের অভাবে বাচ্চাটি মারা যায়। পরে জানা যায়, মেয়েটির বিয়ে এবং অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয় প্রকাশিত হলে হল কর্তৃপক্ষ তার সিট বাতিল করে দেবে- এই ভয়ে মেয়েটি হল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে রুমমেট কাউকে জানায়নি। কিন্তু এই গোপনীয়তা পরে  ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে  আসন বণ্টন সম্পর্কিত নীতিমালায় আছে, ‘কোনও ছাত্রী বিবাহিত হলে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। অন্যথায় নিয়ম ভঙ্গের কারণে তার সিট বাতিল হবে। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিত ছাত্রীকে চলতি সেশনে হলে থেকে অধ্যয়নের সুযোগ দেওয়া হবে। অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী হলে থাকতে পারবেন না।’ তবে ছাত্র হলগুলোতে এই ধরনের কোনও নীতিমালা নেই।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি ছাত্রী হলে অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীকে থাকতে না দেওয়া ও বিবাহিতদের শর্ত সাপেক্ষে থাকার নীতিমালাটি বাতিল চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হলের ছাত্রীরা। গত ১৪ ডিসেম্বর পাঁচটি ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা ভিসি বরাবর বিধানটির বাতিলসহ চার দফা দাবি জানান। এরপর থেকেই আলোচনায় ওঠে আসে এই বৈষম্যমূলক নীতিমালা এবং এর যৌক্তিকতা বিষয়ে তর্কবিতর্ক। শিক্ষার্থীদের এই দাবিগুলোর সঙ্গে আমি একেবারেই একমত।

প্রথমে বলে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের আইনে ১৮ বছর বয়সের পর নারীদের বিয়েতে আইনগত কোনও বাধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেক ছাত্রীই বিবাহিত থাকেন। কিন্তু এর সঙ্গে তার শিক্ষার সব অধিকারের কোনও ধরনের সংঘর্ষ হওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং আমরা চাই বিবাহিত হলেও নারী শিক্ষার্থী যেন নির্বিঘ্নে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে এবং সম্পন্ন করতে পারে। কারণ, বিয়ে যেন কারও শিক্ষাজীবনে কোনও ধরনের বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।

কেন এই নীতিমালাটির সংস্কার প্রয়োজন? কারণ বিবিধ। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে বিয়ে হওয়ার পর অনেক নারীই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী স্বামীর নির্যাতনে মারা যায়। এই ধরনের সহিংসতার পর অনেক সময়ই নারী কোথায় থাকবে সেটি নিয়ে জটিলতা হয় এবং তার শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়। এসব ক্ষেত্রেও নারীর নিজের একটি কামরায় থাকা খুব জরুরি। ভার্জিনিয়া উলফ নারীর একটি কামরা থাকার যে আকুতি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের নারীদের বিভিন্ন অবস্থা বিশ্লেষণে এটি আসলে খুবই জরুরি। অনেক সময় মেয়েটি হয়তো বাবার বাড়িতেও যেতে পারে না। সেখানেও হয়তো সেভাবে সমর্থন দেয় না। তখন মেয়েরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তখন তার নিরাপদভাবে থাকার একটি জায়গা প্রয়োজন হয়। আর সে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয় তাহলে হলে থাকাটাই তার জন্য সবদিকে থেকে ভালো ব্যবস্থা। আর শিক্ষার্থী হিসেবে হলে থাকা তার অধিকার। সেখানে আমি মনে করি বিবাহিত মেয়েদের সিট বাতিলের কোনও যৌক্তিকতা আদৌ নেই। তবে অনেকেই ঢাকায় বাসা থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময়ের জন্য সিট রেখে দেন এই ভেবে যে পরীক্ষার সময় হলে থাকবেন বলে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যার তুলনায় প্রত্যেক হলেই সিট সংখ্যা কম, সেক্ষেত্রে সাধারণভাবে ঢাকায় বাসায় থাকা শিক্ষার্থীদের হলে সিট না রাখার জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে সেটির সঙ্গে বিবাহিত-অবিবাহিত বিভাজন কাঙ্ক্ষিত নয়।

এখন আসি প্রেগন্যান্ট শিক্ষার্থীদের প্রশ্নে। সেখানেও আসলে সিট বাতিলের সুযোগ নেই। কারণ, প্রেগন্যান্ট হলে কি তার শিক্ষা এবং সেটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য সুবিধা এবং অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন? নিশ্চয়ই নয়। তবে এক্ষেত্রে স্বীকার করে নিতে হবে যে  বর্তমান হলগুলোর যে ব্যবস্থাপনা সেগুলো সেই বিশেষ সময়কে যথার্থভাবে সমর্থন দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বেশিরভাগ হলেই শিক্ষার্থীরা ডাবলিং থাকে। কারণ, শিক্ষার্থীর তুলনায় সিট সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু এ সময় একটি চাপা সিটে চাপাচাপি করে থাকা গর্ভবতী মেয়েটির স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে প্রত্যেক হলেই ডাইনিং এবং ক্যান্টিনে খাবার মান একজন গর্ভবতী নারীর পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য যে যথেষ্ট নয় সেই বিষয়ে বলার আর কোনও অবকাশ নেই। এই সময় নারীর বিশেষ যত্নের দরকার হয়। যেকোনও সময় যেকোনও জরুরি অবস্থা তৈরি হতে পারে। সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে দেখা হল প্রশাসনের সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে। সেজন্য এক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নারী শিক্ষার্থীদের এই সময়টি পরিবারে কিংবা নিকট স্বজনের সঙ্গে থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে কোনোভাবেই সিট বাতিল হবে না।

এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন, নীতিমালাটি সব হলেই একইভাবে প্রয়োগ হচ্ছে তা নয়। যেমন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে এটি শিথিল আছে। তবে বাতিল না হয়ে শিথিল থাকলে যে সমস্যাটি হয় তা হলো এটি বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করার সুযোগ থাকে। এখানে সূর্যাস্ত আইনের কথাই যদি আমরা ধরি তাহলে সেখানেও দেখতে পারি সেই আইনটিও কিন্তু এখনও আছে। সেটিও কিন্তু বাতিল হয়নি, শিথিল হয়েছে মাত্র। তার মানে হলো যেকোনও সময়ই এটি আবার তাজা হয়ে উঠতে পারে।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে বৈষম্যমূলক এবং অপ্রয়োজনীয় আইন এবং নীতিমালাগুলো শিথিল নয়, বাতিল করতে হবে। তা না হলে এর প্রয়োগ হতে পারে যে কারও হাতেই।

লেখক: শিক্ষক,  নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন জেলায় নামাজ আদায়
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর বোল্ট
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্স 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ