X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির দৈন্য

কাকলী প্রধান
২২ মার্চ ২০২২, ২০:০৮আপডেট : ২২ মার্চ ২০২২, ২০:২৭
কাকলী প্রধান সদ্য শেষ হলো একুশে বইমেলা। হবে কী হবে না। হলে কতদিনের জন্য হবে। ১৫ দিন নাকি ৩০ দিন! এ নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা এবং টেনশন ছিল। করোনার মহাকালে জেরবার অবস্থা সব প্রতিষ্ঠানের। তারমধ্যে বই প্রকাশনী ব্যবসা! করোনার সময়টায় অফিস কর্মচারী সামলে ওঠাই ছিল মহাঝক্কির ব্যাপার। অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো কর্মচারী ছাঁটাই করার দুঃসাহসিক কাজটা এখানে নিতান্তই কম। কারণ, বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানুষের এতটা নিষ্ঠুর হওয়া চলে না। অনেকটা নিজে না খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ানোর মতো। আমরা যারা শিশু প্রকাশনার মধ্যে আছি তাদের অবস্থা তো আরও খারাপ।

মূল প্রসঙ্গে আসি। বইমেলা হবে। আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যেও আমরা কমবেশি নতুন বই প্রকাশ করার চেষ্টাও করেছি।

শুরু হলো বইমেলা।

কখনও কাটে বইপ্রেমীদের অপেক্ষায়। সারা দিন বসে থাকাই সার। বইপ্রেমীদের দেখা মেলে না। কখনও উপচে পড়া ভিড়। মনে হয়, হায় হায় এখনই বুঝি স্টল ফাঁকা হয়ে যাবে। সব বই বেচা হবে। মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে যাবো। স্টল বানানো, স্টল বরাদ্দ খরচ; আর যে দু-চারটা মানুষ খাটাখাটনি করছে তাদের খরচটা বুঝি উঠে আসবে। সেসব দিন কি তাহলে গতই হয়ে গেলো!

সাধারণ মানুষের ঐতিহ্যনির্ভর সংস্কৃতির ভেতর আমাদের চলাফেরা, ঘোরাঘুরি, ওঠাবসা এবং লেখালেখি। বই বের করতে গিয়ে এবং বইমেলার স্টলে বসতে গিয়ে পাঠক ক্রেতার কিছু পরিবর্তন চোখে পড়লো। সেটিই আসলে আজকে আমার লেখার বিষয়। পাঠক ভাববেন তাহলে বাছা এত কথা লেখার কী দরকার! ওই যে খুব সাধারণ মানুষ বলে আসল কথাটা ফটাশ ফটাশ বলতে পারি না। একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে হয়। সেজন্য পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

যাই হোক– ক্রেতা আসে। একদলকে দেখলে মনে হয় এরা বুঝি বই কিনবে না। শুধুই নেড়েচেড়ে দেখে চলে যাবে। অবাক করে দিয়ে তারাই হয়তো বেশ কিছু বই কিনে ফেলে। একদল আসে বই দেখে নেড়েচেড়ে জিজ্ঞেস করে ছবি ছাড়া বই নেই! ছবির বই পড়লে পাপ হবে। বুঝতে পারি বাঙালি এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম সংস্কৃতি বদলে গেছে। গেড়ে বসেছে ভয়ংকরতম অন্ধত্ব আর কুসংস্কারাছন্ন শিক্ষা। একদল আসে স্কুলের গ্রামার বই খুঁজতে। একদল আসে নোট বই খুঁজতে। একদল মা-বাবা আসে যারা সাংস্কৃতিকভাবে সন্তানদের ধমকে বলেন– অনেক হয়েছে, এবার কাজে লাগবে এমন বই কিনো। হাবাগোবা হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কাজ থাকে না আমাদের। একদল আসে আরবি বই খুঁজতে। সঙ্গে ইসলামের আদব কায়দা শেখানোর বইয়ের চাহিদা। ইংলিশ মাধ্যমে পড়ুয়া শিশুদের বাবা-মারা এসে বই নাড়েচাড়ে। মিষ্টি হেসে বলেন বইগুলো খুব সুন্দর। কিন্তু ইংরেজিতে লেখা কোনও বই নেই? আমার ছেলে কিংবা আমার মেয়ে বাংলা পড়তে পারে না।  বাংলায় ওর ভীষণ ভয়। বসে শুধু ভাবি সত্যি কি বিচিত্র দেশ। কী স্বাধীন আমাদের স্বাধীনতা আর কতখানি বেপরোয়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা!

তথাকথিত ভদ্র সংস্কৃতির ধারায় করা লালিত পালিত? যাদের পূর্ব পুরুষের রক্তে জ্ঞানে শ্রমে এই বাংলার বহু কিছু সমৃদ্ধ হয়েছে তারা? তারা কোথায়? হ্যাঁ তারাও আসেন। তাদের আবার ভিন্ন রকম ঠাটবাট আদব কায়দা। এরকম একদলও আসেন। মূল সংস্কৃতির ধারক বাহক বলে বহুল পরিচিত। নিত্য তাদের সভা সেমিনার। বাংলা বাঁচাও বলে তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত। তাদের অ্যারোস্টোক্রেসিই হলো প্রান্তিক, প্রান্তিক জনের সঙ্গে ওঠাবসা। তারাও আসেন। সঙ্গে দু-চারজন হতশ্রী শিশু। তাদের সাজিয়ে গুছিয়ে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা। ‘ওরা’? তাদের ড্রাইভার বাবুর্চি এবং বাসার সহকর্মীদের সন্তান। তাদের গর্বিত উচ্চারণ– নেরে তোদের কোন কোন বই পছন্দ, এটা পছন্দ, ওটা! ওটা নিবি? বই সহকর্মী কিছু বই দেখিয়ে বলে– ম্যাডাম কিছু বই আপনাদের নাতি নাতনিদের জন্য নিয়ে যান। বসে ভাবি– আহারে আমার সাধারণ বোকা সহকর্মী। ভদ্রলোকের উল্টোপিঠে ব্যবহৃত ভাষার গরিমাটুকুই বেচারা বুঝতে পারেনি। এদের সন্তান নাতিপুতিরা বাংলা বর্ণমালা জীবনে চোখেও দেখেনি। মুচকি হাসার সময়টুকুও পাইনি বিশ্বাস করুন পাঠক। উত্তর এলো– ওরা কেউ বাংলা পড়তে জানে না। সঙ্গে মেকি লজ্জিত গর্বিত হাসি। এ সম্প্রদায়ের মানুষগুলো সবসময়ই লাভের গুড়টুকু খেয়ে থাকেন। আর মার্জিত ভাষায় নিম্নবর্গীয় অনুন্নত মানুষদের ভালোবাসার মানুষ বানিয়ে বাংলা বই কিনে দিয়ে তৃপ্তি পান। ভাবি, থাক বাবা বই তো বেচা হচ্ছে কিছু। হোক না সেটা নিম্নবর্গীয়দের। আরও ভাবি, বাংলা ভাষা কি তাহলে শুধুই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ইতর জনের ভাষা হয়ে বেঁচে থাকবে!

 অসহায় বোকাসোকা বাংলা বই প্রকাশক কর্মী চিন্তার পাকে পড়ে যাই। আহারে আমার রক্তবর্ণ বর্ণমালা, আহারে আমার দৈন্য বাঙালি, যাদের আদতে সাংস্কৃতিক কোনও অহংকারবোধই তৈরি হয়নি। হয়েছে কি?
 

লেখক: আলোকচিত্রী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
একযুগ পর দলছুট, সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ