X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

টিপ্পনীর মনস্তত্ত্ব

জোবাইদা নাসরীন
০৪ এপ্রিল ২০২২, ১৭:২৬আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২২, ১৭:২৬
জোবাইদা নাসরীন ‘দিদি এটা আপনার দ্যাশের জিনিস’– নিউ মার্কেটে বিক্রেতার কাছে এই কথাটি শোনার পর আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি আমার ‘দেশের বাড়ির’ কথা বলছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনার দেশ কোনটি?’, তিনি আবারও বললেন, ‘আমার তো এ দেশেই। আর এসব জিনিস ইন্ডিয়ান, আপনার দ্যাশের।’ বললাম, ‘আমার দেশ ইন্ডিয়া, আপনাকে কে বললো?’ তিনি আবারও বিরক্তভাবে বললেন, ‘কপালে লাল টিপ দেইখ্যাই বুঝতে পারি, কেউ কওন লাগে না।’ এতক্ষণে আমি বুঝলাম ‘আমার দ্যাশের’ জিনিস বলতে উনি কী বুঝিয়েছেন।

আরও বছর খানেক পরের ঘটনা।  মগবাজার মোড়ে বসে আছি। একজন বয়স্ক নারী ভিক্ষুককে এগিয়ে আসতে দেখে নিজেই ব্যাগ থেকে টাকা বের করলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, নারীটি আমার দিকে তাকিয়েই আমার কাছে আর ভিক্ষা চাইলো না। আমাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো আমার পেছনের রিকশায়। ফের এই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হওয়ায় একটু ইচ্ছা হলো জিজ্ঞেস করি যে কেন ভিক্ষুক আমার কাছে ভিক্ষা চাইলেন না। তখন সেই ভিক্ষুক খুব শান্ত স্বরেই জানালেন, ‘হিন্দুদের থেকে উনি ভিক্ষা নেন না।’ জানতে চাইলাম ‘চেহারা দেখে কি চেনা যায় কে কোন ধর্মের?’ তিনি বললেন ‘ওই যে টিপ পরছেন, ওটাইতে বোঝা যায়।’

ওপরের দুটো বিষয় পড়তে গিয়ে হয়তো আমাদের মনে হবে যে এসব তো একটি শ্রেণির চিন্তা। বাংলাদেশের হয়তো ‘শিক্ষিত’ শ্রেণি এই ধরনের বক্তব্য এবং মনস্কতায় আলাদা।

তাহলে সেই গল্পও বলি। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চাকরির  ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন শিক্ষক আমাকে বললেন ‘তুমি টিপ পরো কেন, তোমার চেহারা হিন্দু হিন্দু লাগে।’ সেই ঘটনার প্রতিবাদে একটি জাতীয়  দৈনিকে একটি কলামও লিখি। সে ঘটনার পর অনেকেই বলেছেন দেশ এখন ‘অমুক’ রাজনৈতিক দলের হাতে, তাই এসব তো হবেই। কিন্তু দেশ এখন সেই ‘অমুক’ রাজনৈতিক দল থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখনও বিভিন্ন শ্রেণি এবং প্রায় সকল খাতেই এই বিষয়গুলোর চর্চা কম বেশি আছে।

এই কথাগুলো এখানে বলা প্রাসঙ্গিক কারণ বাংলাদেশে গত দুদিন যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে তা হলো তেজগাঁও কলেজের  শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরা নিয়ে একজন পুলিশ সদস্যের গালি দেওয়ার বিষয়টি। এটি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো যখন পুলিশ সদস্যের এই কটূক্তির বিপরীতে সেই শিক্ষক যখন প্রতিবাদ জানিয়েছেন তখন তার পায়ের ওপর দিয়ে সেই মোটরসাইকেল চালিয়ে নিয়ে যান।

এখানে কতগুলো প্রসঙ্গ আলোচনায় আনা খুবই জরুরি। প্রথমত, এই টিপ নিয়ে ‘টিটকারী’ কটূক্তি কোনোভাবেই কোনও ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আর এখানে এটিও ভাবার কোনও অবকাশ নেই যে কোনও একজন পুলিশ সদস্যই এ দেশে একমাত্র এই ধরনের কটূক্তি করেছে।

এই ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটি ‘শুধুমাত্র একটি ‘সাধারণ’ টিপের ঘটনা নয়। এখানে আছে, ভয়াবহ ‘হিন্দু বিদ্বেষ’, ‘নারী বিদ্বেষ এবং পুরুষতান্ত্রিক দাপুটেপনা। যার কারণে ভাষাটি হয়ে পড়েছে ‘তুই টিপ পড়ছোস কেন?’ টিপের প্রতি ঘৃণা আসলে কোনোভাবেই একটি সাজের অনুষঙ্গের প্রতি ঘৃণা নয়। এটি সাম্প্রদায়িক চাহনি। এবং নারীর প্রতি ক্ষোভের কারণ হলো নারীকে পুরুষের অধিকারভুক্ত প্রাণী মনে করা হয়।

পুরুষ নারীর যেকোনও কিছুর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার রাখে। যার কারণে আমরা শুনতে পাই ‘তুই পরছিস ক্যান’ বাক্যটি। নারী যখন এর প্রতিবাদ করেছে তখন সেই সেই পুরুষতান্ত্রিক অহং আরও বেড়ে গিয়েছে। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে সেই নারীকে পিষিয়ে ফেলতে চেয়েছেন। লতা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি যদি না সরে যেতেন তাহলে মোটরসাইকেলটি তার শরীরের ওপর দিয়েই যেত।

কেন এসব ঘটছে? আমার মা ষাটের দশকের মধ্যভাগে বিয়ে করেছিলেন এবং তখন পাকিস্তান আমল ছিল। মায়ের বিয়ের ছবিতে আজও আকর্ষণীয় হয়ে মায়ের কপালে জ্বল জ্বল করছে লালটিপ। টিপ নিয়ে বিশেষ করে লালটিপ নিয়ে এই মতাদর্শিক জ্বলুনি এ দেশে গত পনের বছরের ঘটনা মাত্র। কী এমন হলো হঠাৎ এই লাল টিপের  প্রতি লোকজন এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে?

এটি সাম্প্রদায়িক জ্বলুনি। আমরা যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িকতার যে চাষবাস করছি তারই ফসল এই টিপ কেন্দ্রিক কটূক্তি। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আসলে সাম্প্রদায়িকতার বিষ আছে। সব সময় না প্রকাশ পেলেও কোনও কোনও মুহূর্তে আমাদের আসল রূপ বের হয়ে আসে।  আর নারী বিদ্বেষও সচল আছে আছে আমাদের মনস্কতায়। এই দু’টার কার্যকরী মিলন আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ভয়াল রূপকে হিংস্র করে। তাই আমরা কখনও মেনে নিতে পারি না, একজন নারী তার নিপীড়নের প্রতিবাদ করবে, আবার তিনি যদি ধর্মীয়ভাবে হিন্দু হন তাহলে তার প্রতিবাদ আরও কাঙ্ক্ষিত নয়। যে কারণে পুরুষতান্ত্রিক হিংস্রতা আরও বেড়ে যায়।

কী প্রক্রিয়ায় আসলে এই নারী বিদ্বেষী এবং সাম্প্রদায়িকতার বীজকে আমরা প্রতিনিয়তই যত্ন করে বড় করছি? সেই প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণও গুরুত্বপূর্ণ।  আমরা প্রতিনিয়তই নারী বিদ্বেষী ‘ওয়াজ’ শুনছি। আগে শুধু হয়তো কিছু বক্তা তাদের ওয়াজ মাহফিলে এসব বলতো। এখন বাসে উঠলে আপনি না চাইলেও এগুলো শুনতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এগুলো প্রচারিত হচ্ছে। ইউটিউবে আছে। সুতরাং এগুলো শুনে শুনে মানুষের মনে নারী বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি হয়। এর বাইরে আছে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি। এখানে এই ধরনের ধর্মীয় বয়ান এবং ওয়াজের ভূমিকা রয়েছে। আমাদের সেগুলোর প্রতি কোনও নজর নেই।

এটি সত্যি যে একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, যার দায়িত্ব মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া, সেই সদস্যের এই কটূক্তির কারণে হয়তো সকলের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। তাই তাকে খুঁজে বের করা এবং শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়েই এই ধরনের ঘটনা ঘটবে না ভাবলে আমাদের ভুল হয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হলো নারীর প্রতি কিংবা কোনও ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ  ছড়ানো কোনও তথ্য কিংবা কোনও বক্তব্য মানবিকতার লঙ্ঘন এবং সেটি আমাদের সংবিধান বিরোধীও। তাহলে সেগুলোর প্রচার বন্ধ করাই প্রথম কাজ হবে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 
ইমেইল: [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ