X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিএস নন-ক্যাডারদের দাবি: মানবিক নাকি যৌক্তিক?

কাবিল সাদি
১৪ নভেম্বর ২০২২, ১৯:২৯আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৫৯

গত ৬ অক্টোবর থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন ভবনসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে বিসিএস নন-ক্যাডার প্রত্যাশীরা। তাদের শান্তিপূর্ণ ও ভিন্নধর্মী আন্দোলন গণমাধ্যমেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কখনও মাইকে স্লোগান, কখনও মোমবাতি প্রজ্বালন, কখনও গান নাটক বা মূকাভিনয়ের মাধ্যমে পিএসসি’র নানা ‘অসঙ্গতি’ তুলে ধরছেন আন্দোলনকারীরা। যে বিধির কথা তুলে ধরে পিএসসি নন-ক্যাডার নিয়োগে জটিলতা এনেছে সেই বিধিকে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বলে লাল ফিতা মোড়ানো ফাইল নিয়েও মিছিল করতে দেখা যাচ্ছে। একইভাবে খাঁচায় বন্দি পাখিকে নিয়ে তাদের অধিকার এই খাঁচায় মোড়ানো অধিকার বলেও তুলে ধরেন। এই যে এতদিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে এখন পর্যন্ত কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার কথাও শোনা যায়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই ব্যতিক্রম। তারা যে বিসিএস উত্তীর্ণ মেধাবী সেটা তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে আরও পরিষ্কার বলে মনে হচ্ছে। আন্দোলনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আন্দোলনের নেতারা যেমন তৎপর একইভাবে এখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরাও যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা চাকরি প্রত্যাশী বেকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা। যদিও এই আন্দোলন ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারের নেতৃত্বে হচ্ছে, তথাপি এতে যুক্ত হচ্ছেন অন্যান্য চলমান বিসিএসের প্রার্থীরাও। নারী প্রার্থীরাও দলে দলে আন্দোলনে শরিক হচ্ছেন ছোট বাচ্চা নিয়ে। এই আন্দোলন কতদিন চলবে তা এখনও বলা মুশকিল। কেননা, এত কিছুর পরেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

এমনকি তারা গণমাধ্যম পর্যন্ত এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে এই আন্দোলনের ফলাফল  কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। এই যে তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, পিএসসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে একটু কথা বলার আকুতি, কোনও কিছুই আমলে না নিয়ে বরং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসি একে-অপরকে দেখিয়ে দিচ্ছেন।

প্রয়াত পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদত হুসাইন এবং সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক হোসেন ছাত্রছাত্রীদের সরকারি চাকরিতে আশাবাদী করে পড়ার টেবিলে বসাতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান চেয়ারম্যান যেন সেই পড়ার টেবিল থেকে কোমলমতি মেধাবী শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের রাজপথে নামিয়ে এনেছেন।

তাদের এই রাজপথে নামানোটা কতটা উচিত বা অনুচিত সেই বিষয়টা বিশ্লেষণের বিষয়। কিন্তু যারা তাদের দাবিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার কথা বলছেন, আমি তাতে একমত হতে পারছি না। কারণ, করোনার দোহাই দিলেই, রাস্তায় মিছিল করলেই বা মোমবাতি প্রজ্বালিত করলেই সরকার চাকরি দিতে পারে না। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যোগ্যতাসম্পন্ন না হলেও তারা যতই আন্দোলন করুক তাতেও মানবিক হওয়ার সুযোগ নেই। শুধু তাই নয়, দেশের সব শিক্ষার্থী যদি চাকরি চেয়ে আত্মহত্যাও করতে চায় তাই বলে কি রাষ্ট্র মানবিক হয়ে চাকরি  দিতে পারবে?

এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার সাধ্য অনুযায়ী নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিতে পারে মাত্র; উদাহরণস্বরূপ কাবিখা বা কাবিটার মতো। কিন্তু এই শিক্ষিত শ্রেণির জন্য এসব অযৌক্তিক  বা অবান্তর চিন্তা। তাই এক কথায় বলা যায় তাদের আন্দোলনের কারণে মানবিক হয়ে চাকরি দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এই যে বিশাল সিলেবাস ও নম্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, এতে আদৌ কি কোনও যৌক্তিক অবস্থান আছে? যদি থাকে তাহলেই কেবল রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

প্রথমত, রাষ্ট্রের থাকতে হবে তার আর্থিক ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা অনুযায়ী লোকবলের চাহিদা।

দ্বিতীয়ত, প্রার্থীর থাকতে হবে চাহিদা মাফিক যোগ্যতা। কেবল এই দুটি শর্ত পূরণ হচ্ছে কিনা এটাই দেখতে হবে। পিএসসি এখানে রাষ্ট্র ও চাকরি প্রার্থী তথা জনগণের মধ্যে পিএসসি হলো যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের কাজে নিয়োজিত থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ মাত্র। পিএসসি চাইলেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না, আবার  রাগান্বিত/আবেগ তাড়িত  হয়ে এই দুই পক্ষের জন্য বাধাও দিতে পারে না।

এখানে পিএসসির দয়া বা মানবিকতা দেখানোর কিছু নেই। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাছাইকৃত যোগ্যদের রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী সুপারিশ করবে এটুকুই তার কাজ। প্রার্থীদেরও দয়া চাওয়ার কিছু নেই, রাষ্ট্রের চাহিদা ও তারা যোগ্য হলে চাকরি প্রাপ্তি তাদের অধিকার।

তাহলে পিএসসি ও আন্দোলনকারীদের বক্তব্য  বিশ্লেষণ করলেই কেবল যৌক্তিক বিষয়টি উঠে আসবে। পিএসসির গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে জানাচ্ছে যে তারা বিসিএস বিজ্ঞপ্তির তারিখ অনুযায়ী ওই বিসিএসের নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ করবে। পরবর্তী বিসিএস থেকে ক্যাডার পদের সঙ্গে নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ করবে। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে যত শূন্য পদ থাকবে কেবল ওই পদই ওই বিসিএসের নন-ক্যাডার প্রার্থীরা পাবে। এটি নাকি তাদের বিধিমালাতেও আছে, ইতোপূর্বে কার্যকর না থাকলেও ৪০তম বিসিএস থেকে কার্যকর করতে চায়।

অন্যদিকে, আন্দোলনকারীদের দাবি ইতোপূর্বে সব বিসিএসের ক্ষেত্রেই পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগমুহূর্ত পর্যন্ত নন-ক্যাডার সুপারিশ করা যায় এবং সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএস নন-ক্যাডারের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। এ বছরের ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগের দিন ২৯ মার্চ ৩৮তম বিসিএস নন-ক্যাডারে সুপারিশ করা হয়। এই কাজটিও বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনই করেছেন। আন্দোলনকারীদের দাবি, এই নিয়মও নন-ক্যাডার বিধিমালায় আছে।

নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা ২০১০ এবং নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) সংশোধিত বিধিমালা ২০১৪-এর বিধি ৪(১) ও ৫(৩) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়–

৪(১) অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার পদ উল্লেখ করা সত্ত্বেও ২০১০-এর ৫(৩)-এ বলা আছে, পরবর্তী বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার ‘পূর্বদিন পর্যন্ত’ পূর্ববর্তী বিসিএস নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করা যাবে, আর ২০১৪ সালের ৫(৩)-এ বলা আছে, পরবর্তী বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার ‘পূর্বে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত’ পূর্ববর্তী বিসিএস নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করা যাবে।

অর্থাৎ ৪১ বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পূর্বে কমিশন একটা তারিখ নির্ধারণ করবে, যে তারিখ পর্যন্ত ৪০তম বিসিএস নন-ক্যাডারদের সুপারিশ করা যাবে। সেই তারিখ আজকের তারিখও হতে পারে, আবার আগামী যেকোনও তারিখও হতে পারে।

বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ নির্ধারণ করার কথা বিধিতে কোথাও নেই, সুযোগও নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, সংশোধিত ৫(৩) অনুযায়ী তারিখ নির্ধারণের সকল ক্ষমতা পিএসসির হাতে।

তাহলে পিএসসি যে অজুহাত দিচ্ছে এটি তিন কারণে প্রতিপালন সম্ভব নয়। প্রথমত, নন-ক্যাডার বিধিমালায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ অনুযায়ী শূন্যপদ বিষয়টি উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত, উল্লেখ থাকলেও সেই তারিখের শূন্যপদ গত ৩৭তম ও ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে সুপারিশ করেছে স্বয়ং পিএসসি। অর্থাৎ একই কারণে ৪০-৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত চলমান সব পদই প্রায় সুপারিশ সম্পন্ন করেছে এই বর্তমান কমিশন। পিএসসিকে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে এই পদগুলো সুপারিশ বাতিল করে ফেরত আনতে হবে, যা আদতে সম্ভব নয়। কারণ, সুপারিশকৃত প্রার্থীরা এখন কর্মরত।

তৃতীয়ত, বিজ্ঞপ্তিতে শূন্যপদ উল্লেখ করার কথা বিধিমালায় আছে কিন্তু ৪০তম থেকে ৪৪তম চলমান কোনও বিসিএসেই কমিশন উল্লেখ করেনি। স্পষ্টত এখানে বিধি মানা হয়নি, এখন সম্ভবও নয়। আর আংশিকভাবে সুবিধা মতো বিধিমালা মানাটা যৌক্তিকও নয়। বিধিমালা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে এই সংকট কোনোভাবেই ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একটি মাত্রই পথ খোলা আছে আর সেটি হলো বিধিমালা পরিবর্তন এবং সংকট সৃষ্টিকারী অংশ বিলুপ্ত করা। এটিই যৌক্তিক এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকদের জন্য কল্যাণকর। কারণ, প্রচলিত পদ্ধতিতেই যেহেতু ক্রমান্বয়ে অধিক সংখ্যক মেধাবীরা নিয়োগ পাচ্ছে এবং রাষ্ট্রও অল্প সময়ে দক্ষ জনবল পাচ্ছে, সেখানে এই বিধিমালা রাখার কোনও কারণ নেই। একই কারণে জনকল্যাণে আমাদের মহান সংবিধানও সময়ে সময়ে সংশোধনী এনে পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা অংশবিশেষ বিলুপ্ত করা হয়। সেখানে পিএসসির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য এই বিধিমালার পরিবর্তন অকাট্য বা অসম্ভব বিষয় নয়।

তাছাড়া যেসব বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিই প্রকাশ হয়নি বা অস্তিত্বই নেই তার জন্য অস্তিত্ব সম্পন্নদের বঞ্চিত করা আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি অতি আবেগী চিন্তা, যা পিএসসি’র মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেমানান। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আইন বা বিধি সৃষ্টি, পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা কার্যকর হওয়া না হওয়া নির্ভর করে রাষ্ট্র অথবা মানুষের কল্যাণ হচ্ছে কিনা। এই ক্ষেত্রে যেখানে রাষ্ট্র (জনবল চাওয়া সরকারি প্রতিষ্ঠান)  ও নাগরিক (চাকরি প্রার্থী) উভয়েরই কল্যাণ হচ্ছে সেখানে পিএসসির বাধা দেওয়াটা রাষ্ট্রের জন্যই সুস্পষ্ট অকল্যাণকর। মনে রাখতে হবে, পিএসসির সৃষ্টিই হয়েছে এই দুই শ্রেণির প্রয়োজনে। যদি কাল রাষ্ট্র মনে করে এটি তার কল্যাণে আসছে না, তাহলে এর পরিবর্তে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হবে, কিন্তু নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের কোনও বিলুপ্তি বা বিকল্প নেই। তাই বলাই যায়, মানবিক নয়, বিধি সংশোধন করে যৌক্তিক কারণেই আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের রাজপথ থেকে তুলে আনুন।

লেখক: কলামিস্ট ও নাট্যকার।

[email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ