X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কে বলে দুর্ভিক্ষ নেই!

মোস্তফা হোসেইন
০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:০৮আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:০৮

আমার শিকড় গাঁয়ে। সেই গাঁয়ের মোসলেমের কথা বলি। প্রচণ্ড কর্মঠ মানুষ। আকারে খাটো। প্রকারটা ব্যতিক্রম। সৎ-নিষ্ঠাবান যাকে বলে। সামাজিকতায় শীর্ষে। শুধু মোসলেম নয়, ওর বাবা-দাদা পূর্বপুরুষের সঙ্গেও আমাদের পারিবারিক শখ্য ছিল। আত্মীয়ের চেয়ে বেশি। গৃহস্থালি কাজে তাদের সহযোগিতা অকল্পনীয়। সবাই তাকে পেতে চায়। যেমন আগের দিনে ওর পূর্বপুরুষদেরও গৃহস্থরা টানাটানি করতো।

সেই মোসলেম এখন আর মানুষের বাড়িতে কাজ করে না। ওর ছেলেদের বারণ। ছেলেরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভিডিও কল করে। বাবা যেন আর অন্যের বাড়িতে ভারী কাজ না করে, সেটা নিশ্চিত হতে চায়। বাবা তাই কলা ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। তাই মোসলেমের সঙ্গে পাড়ার মানুষের সম্পর্ক এখন ক্রেতা আর বিক্রেতার।

ওই পাড়ার আমোদ আলীর ছেলেও ছিল মোসলেমের জুটি। বছর পাঁচেক আগে সে আলাদা বাড়ি করে মোসলেমদের বাড়ি থেকে খানিক দূরে চলে গেছে। সেও অন্যের বাড়ি কাজ করে না। মোসলেম নতুন বাড়ি করার জন্য জায়গা তৈরি করেছে মাত্র, কিন্তু আমোদ আলীর ছেলে ইতোমধ্যে পাকা ঘর করেছে। আমাদের পাশের পাড়া করিমপুরের যারা আমাদের গৃহকর্মে প্রধান সহায়ক ছিল, তাদের সবারই ঘর ছিল ছনের, সেই করিমপুরে এখন একটিও কাঁচা ঘর নেই।

আমাদের শৈশবে ভোরবেলা খালপাড়ে গেলে দেখা যেত লাইন ধরে মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। সেই পাড়ায় একটিও ঘর নেই যাদের এটাচড বাথরুম নেই। পুরো পাড়ায় আমাদের বাড়িতে একটি টিউবওয়েল যেখানে ভরসা ছিল, এখন প্রতিটি ঘরের ভেতর পানির ব্যবস্থা। মোটর ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করছে। জীবনমানের আর ব্যাখ্যা দেওয়ার কি প্রয়োজন আছে?

প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে

শখের কারণে ছোট একটা ফল বাগান শুরু করেছি কয়েক বছর হলো। সবসময় শ্রমিক নিতে হয় না বাগানের কাজে। গত ১৫ দিন ধরে চেষ্টা করেও বাগানে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না একজনও। সবাই ব্যস্ত হয়তো নিজের কাজে, না হয় পূর্বে কথা দিয়ে অন্যের কাজ করায় ব্যস্ত। প্রতি ঘণ্টায় ১০০-১২৫ টাকা তাদের পারিশ্রমিক। ৫ ঘণ্টা কাজ করে অন্যের। বিকেলে করে নিজের। সন্ধ্যায় পাড়ার দোকানে যায়- চা খায়, গল্প করে টেলিভিশন দেখে।

অতীত কি ভুলে থাকা যায়?

বছর কয় আগে, বাড়ি গিয়ে এক ভাতিজাকে নিয়ে বিকেলে রাস্তায় হাঁটছি। ভাতিজা ঢাকা সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে অনার্সের ছাত্র তখন। তার জিজ্ঞাসা– পাকিস্তান আমলই নাকি এখনকার চেয়ে ভালো ছিল? কাকা, আপনারা কেন বাংলাদেশ নিয়ে এত উৎফুল্ল?

ওই সময় দেখা গেলো করিমপুরের ওদু মিয়া বাজার থেকে ফিরছেন। ওদু মিয়া আমার থেকে বছর কয়েক বড়। হাতে তেলের বোতল, একটি রুই মাছ এবং কিছু সবজি। ওদু মিয়াকে থামালাম।

জিজ্ঞেস করলাম- কেমন আছো ওদু মিয়া।

জবাব– আমরার আর বালা থাহন।

তাকালাম তার সদাইয়ের দিকে। বললাম, ওদু মিয়া, তোমার কি পাকিস্তান আমলের কথা মনে আছে? বোতলভর্তি তেল, হাতভর্তি সদাইপাতি কি এভাবে বাজার থেকে আনতে পারতে?

ওদু মিয়া সঙ্গে সঙ্গে সামনে বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে- অতীতে ফিরে যায়।

‘‘ আপনেরার বাড়ির পশ্চিম দিয়া যে ছুডু বিলডা, ওই বিলে নামতাম কাতি (কার্তিক মাসে। হাঁটতাম দর্পনারায়ণপুরের দিকে। হাঁটতাম আর হাঁটতাম পানি ভাইঙ্গা। হালুক (শালুক) তুইল্যা পাইলাতে (পাতিল) ভরতাম। দুপুরের আগে বাইত ফিরতাম। সিদ্ধ কইরা ঘরের হগলে খাইতাম।”

জিজ্ঞেস করলাম- বোতলভর্তি তেল কি আনতে পারতে?

ওদু মিয়া থ মেরে যায়। অতীত হাতড়াতে থাকে।

ভাতিজাকে বলি, কী মনে হয় বাংলাদেশকে?

তাকে বলি, তুমি যে রাস্তার পাশে বসে আছো, এই রাস্তা ছিল জমি থেকে কয়েক ফুট উঁচু। বর্ষায় ডুবে যেতো। তোমার বাবাসহ আমরা বর্ষায় স্কুলে যেতে পারতাম না হেঁটে। যে কারণে আমাদের লেখাপড়ার শুরুটা একটু বেশি বয়সে। আর পুরো পাড়ায় আমাদের বাড়ি ছাড়া শতভাগ শিশুদের লেখাপড়ার কথা চিন্তাও করা যেতো না। গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজন ছিল স্নাতক।

রোগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। মরণযন্ত্রণা শুরু হলে গ্রামের উমেশ ঠাকুরের হোমিও ওষুধের দুই পুড়িয়াই ছিল ভরসা। যাদের কিছু টাকা পয়সা আছে, তারা ৩ কিলোমিটার পূর্বদিকের মন্দবাগ বাজারের অবনী ডাক্তারকে ডেকে আনতো।

ওই সময় একটা রীতি ছিল। মৃত্যুশয্যায় রোগীকে ফল খাওয়াতে হয়। আমার দেখা কথা বলি। পূর্বপাড়ার একজন মৃত্যুশয্যায়, তার ছেলেরা ১০ কিলোমিটার হেঁটে শশীদল রেলস্টেশনে গিয়ে রেলে চড়ে কুমিল্লা থেকে এক ছটাক আঙুর এনেছিল। আর একটা বেদানা। বাবা হারানোর পর তাদের একটা সান্ত্বনা ছিল, ওদের বাবাকে ফল খাইয়ে দিতে পেরেছে।

এবং হতাশা থেকেই যায়

ওদু মিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের পুরোটাই শুনছিলেন দোকানে বসা লোকজন। তারাও তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। কিন্তু যুক্ত হলো উপসংহারের কথা– আও শান্তি কি আছেনি?

জানতে চাই, অশান্তিটা কি নিয়ে?

জবাব– দেহেন মাইন্য-গইন্য নাই, কেউ কাউরে মানে না। অভাব-অভিযোগের কি শেষ আছেনি।

সবশেষে

বোধকরি ‘অভাব অভিযোগের কি শেষ আছেনি’, এ বাক্যাংশই হতে পারে উপসংহার। আমরা একসময় ‘ভাত দে...’ কবিতায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখনও যাতে সেরকমই আসক্ত হয়ে পড়ি, সেই চেষ্টাই চলছে। উসকে দেওয়া হচ্ছে- স্বাধীনতাকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চলছে দুর্ভিক্ষ নামের আবরণে। কিছু সুশীল এবং রাজনীতিবিদ জোর করে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ চলছে এমনটা প্রমাণের জন্য পণ করে বসে আছেন। নতুন প্রজন্মকে নিকট অতীতের কথাও জানানো জরুরি। জানানো হচ্ছে কি?

আসলে দুর্ভিক্ষ প্রচণ্ডভাবে বিরাজমান আমাদের দেশে। সেই দুর্ভিক্ষ হচ্ছে রুচির (শিল্পী মামুনুর রশীদকে সমর্থন করে) চিন্তা ও মানসিকতার। এই দুর্ভিক্ষটা পিছু ছাড়ছে না আমাদের- সেই শিল্পাচার্যের আমল থেকে। মামুনুর রশীদ শিল্পাচার্যকে উদ্ধৃত করেই আমাদের জানিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষের কথা। সত্যিই রুচিবোধের দুর্ভিক্ষ তীক্ষ্ণতর হচ্ছে শুধু।

 

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
ভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনালভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ