X
শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পোশাক: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

আব্দুল্লাহ সাদী
০৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:০১আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:০১

২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাসের সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের মধ্যে শুধু তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রফতানির পরিমাণ ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের রফতানি খাত প্রায় সম্পূর্ণভাবেই তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। আশির দশক থেকে বাংলাদেশের রফতানি খাতে তৈরি পোশাক শিল্প দোর্দণ্ড প্রতাপে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করার পেছনে পোশাক শিল্পের ভূমিকা সংগত কারণেই সবার আগে উচ্চারিত হয়।

পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেরই প্রধান পোশাকের উৎস বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পোশাকের উচ্চ মান ও ন্যায্য দামের ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান পোশাক রফতানিকারকের জায়গাটি এখনও বাংলাদেশের দখলেই রয়েছে। রফতানির পাল্লা ভারী করার সঙ্গে সঙ্গে যা দেশের মর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। একইসাথে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান পোশাক রফতানিকারক হিসেবে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতেও বাংলাদেশের পোশাক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উত্থান ও অর্থনীতিতে অবদান:

২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে আশার কথা হলো, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও এ বছর রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ ভাগই এসেছে পোশাক রফতানির মাধ্যমে। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো। ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে পশ্চিমা বিশ্বে রফতানি করা বাংলাদেশের পোশাকের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের প্রধান এই রফতানি খাতের ওপরই মূলত দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই প্রধান রফতানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য।

পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসে দেশের রফতানি খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে প্রথম রফতানির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প দিনের মধ্যেই এটি বিপুলভাবে সম্প্রসারিত হয় এবং প্রধান রফতানি শিল্পে পরিণত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা এ শিল্পকে দ্রুত উপরে টেনে তোলে।

২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দাঁড়ায় ৪৭০.২২ বিলিয়ন ডলার, যেখানে শুধু পোশাক শিল্পের অবদান রয়েছে ৯.২৫ শতাংশ। এ খাতে বাংলাদেশের ৪.২২ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা ২.৫৯ মিলিয়ন। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা:

ইউরোস্টাটের তথ্যমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে ২১.১৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্লকটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি বাড়িয়েছে ৩৮.৩৯ শতাংশ। অন্যদিকে এই সময়ে চীন থেকে মোট পোশাক আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭.৯৭ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চীন থেকে আমদানি বেড়েছে ১৯.২৯ শতাংশ। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয় যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান পোশাক রফতানিকারক চীনের পোশাকের চাহিদা দিনে দিনে কমছে এসব দেশে। বিপরীতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের চাহিদা বেড়ে চলেছে। ইইউর মোট আমদানি ২২ শতাংশ বাড়লেও শুধু বাংলাদেশ থেকেই সর্বোচ্চ ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশের পোশাকের মান ও দামের কারণে এর চাহিদা ইউরোপীয় দেশগুলোতে বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি কারখানা ও শ্রমের পরিবেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম উদ্বেগের জায়গা। ফলে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর পরিবেশের ক্রমাগত উন্নতিও আমদানিকারকদের আকর্ষণ করছে। বর্তমানে দেশে সর্বমোট সবুজ কারখানার সংখ্যা ১৯২টি, যার মধ্যে লিড সার্টিফায়েড বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০০টি সবুজ কারখানার মধ্যে ৫০টিই রয়েছে বাংলাদেশের।

তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের শিকার ইউরোপে পোশাকের চাহিদা কমছে বলে ইতোমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রভাবে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকেই বাংলাদেশে কমতে শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্ডারের পরিমাণ। ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ কমেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উদ্ভূত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পোশাকের চাহিদা কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি বৃদ্ধি করে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস অব দ্য টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালের প্রথম দশ মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে গত বছরের তুলনায় ৪৮.৬ শতাংশ বেশি আমদানি করেছে।

এই দশ মাসে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট পোশাক আমদানি হয়েছে ৮.৪৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পোশাক ‍আমদানি উৎসের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চীন ও ভিয়েতনামের পরেই। এ দুটি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি বেড়েছে যথাক্রমে ২০ ও ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ পোশাক আমদানিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তীতে চীনের সাথে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের যে আঁচ বাণিজ্যের ওপর পড়ছে তার ফলে চীনের হারানো জায়গাগুলো বাংলাদেশ পেয়ে যাচ্ছে।

ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ বাজার যুক্তরাজ্য গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধান আমদানি উৎস চীনের রফতানি প্রবৃদ্ধি সেখানে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সেখানেও বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের মোট আমদানিকৃত পোশাকে চীনের অংশীদারত্ব ৩৭ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ভারতেও বেড়েছে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পোশাক রফতানি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। ভারতীয় ক্রেতাদের মধ্যে সেখানে উৎপাদিত পোশাকের চেয়ে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ:

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রফতানি বাজারগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের প্রধান তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ চীনের প্রভাব ক্রমাগতভাবে লাঘব হচ্ছে এসব দেশে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দক্ষতা, দেশীয় পোশাকের মান, শিল্পের পরিবেশ উন্নতকরণ ও ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব দেশ ক্রমেই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে।

তবে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পোশাক রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একইসাথে কাঁচামাল ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি সংকটের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ উদ্ভূত সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে পোশাক শিল্পকে। অন্যদিকে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপিত হওয়ায় বর্ধিত দামের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদাও কমে যাবে। ফলে এসব দেশে পোশাক রফতানি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও এই শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এখনই টেকসই কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার বিকল্প নেই।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, বস্টন ইউনিভার্সিটি, ইউকে।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাবিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার একাধিক তারিখ পরিবর্তন, ক্লাস শুরু ৩ আগস্ট
রাবিতে ভর্তি প্রক্রিয়ার একাধিক তারিখ পরিবর্তন, ক্লাস শুরু ৩ আগস্ট
কুমিল্লায় সাংবাদিকের ওপর হামলা, ছুরিকাঘাত
কুমিল্লায় সাংবাদিকের ওপর হামলা, ছুরিকাঘাত
রাজশাহীতে চাহিদার চেয়ে কোরবানির পশু বেশি, বিক্রি হবে ৩০২ হাটে
রাজশাহীতে চাহিদার চেয়ে কোরবানির পশু বেশি, বিক্রি হবে ৩০২ হাটে
টিভিতে আজকের খেলা (১৬ মে, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (১৬ মে, ২০২৫)
সর্বশেষসর্বাধিক