X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুটি গল্প এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা

রেজানুর রহমান
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:২৩আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:২৫

দেশটাকে কি আদৌ ভালোবাসি আমরা? ভালোবাসার জিনিসকে মানুষ আগলে রাখে। কোনোভাবেই ক্ষতি হতে দেয় না। সেখানে দেশ তো অনেক বড় ব্যাপার। দেশ না থাকলে কিছুই তো থাকে না। অনেকে হয়তো বলবেন, দেশ থাকা না থাকার প্রসঙ্গ আসছে কেন? দেশ তো আছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যাদের মনে এমন প্রশ্নের উদয় হচ্ছে তাদের প্রতি আমার ছোট্ট একটি প্রশ্ন- এটাকে কি থাকা বলে? বাংলাদেশ কার কী ক্ষতি করেছে যে এত অভিভাবক দাঁড়িয়ে গেলো।

‘অভিভাবক’ শব্দটা ভীতিকর নয়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ভীতিকর। বাংলাদেশের এখন অনেক অভিভাবক। সবাই বাংলাদেশের ভালো চায়। শর্ত একটাই- আমার সঙ্গে থাকো। আমাকে সমর্থন করো। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিই হলো, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব। কিন্তু এটা মানতে নারাজ বড় দেশের বড় কর্তারা। আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে লিপ্ত তারা। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা দেখে বড় দেশের বড় কর্তারা সবাই বাংলাদেশকে যার যার বলয়ে নিতে ব্যস্ত। ভয়ও দেখাচ্ছে কেউ কেউ। ভিসানীতির ভয়। মানবাধিকার রক্ষা কর। দুর্নীতি কমাও, ভোটাধিকার নিশ্চিত করো। তা না হলে তোমাকে ভিসা দেওয়া হবে না। মজার ব্যাপার হলো, এই ভিসা দেওয়া না দেওয়ার বিষয় নিয়ে চরম বাহাসে নেমেছে দেশের দুটি পক্ষ। এক পক্ষ দায়ী করছে অন্য পক্ষকে। উভয় পক্ষের কথাবার্তায় যুদ্ধংদেহী মনোভাব স্পষ্ট। এটাই আশঙ্কার বিষয়। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিককে কে ভিসা দিলো অথবা ভিসা দিলো না তা নিয়ে বাহাস হবে কেন? বরং এই একটি প্রশ্নেই তো দুটি পক্ষের ঐকমত্য জরুরি। লাগবে না তোমার ভিসা। যাবো না তোমার দেশে... সাহস করে কেন এই কথা বলছি না।

আমার এই কথা শুনে অনেকেই হয়তো মনে মনে বলছেন, ভাইরে কথা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। ভিসানীতি নিয়ে কথা বলবেন? সে সাহস কোথায়? বিবদমান দুটি রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি উদ্বেগের কারণ। তাদের অধিকাংশেরই সন্তান অথবা পোষ্য যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করে। পাশাপাশি অনেকেই প্রাসাদসম বাড়ি বানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়। তাদের অনেকের ব্যবসাও আছে যুক্তরাষ্ট্রে। কাজেই ভিসানীতির বেড়াজালে পড়ে তারা যদি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে না পারেন তাহলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

যুক্তরাষ্ট্র যেদিন বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসানীতি কার্যকর করলো পরের দিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও দেখে শুধু অবাক নয়, ভয়ও পেলাম। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি কার্যকর করায় আনন্দে মিষ্টি খাচ্ছেন বাংলাদেশেরই কিছু মানুষ। তারা বর্তমান সরকারের ওপর নাখোশ। তাদের ধারণা এই ভিসানীতির কারণে সরকারের পতন ঘটবে। তখন আরও বড় আয়োজন করে মিষ্টি খাবেন তারা। আমি ভিডিওটি কয়েকবার দেখলাম। যতবারই দেখি ততবারই একটি প্রশ্নই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, এই ভিডিওতে দেশাত্মবোধ কোথায়? দেশের সম্মান, মর্যাদা গুরুত্ব পেয়েছে কি?

একটি স্বাধীন দেশের মানুষের বিরুদ্ধে শক্তিধর একটি দেশ ভিসানীতি আরোপ করেছে এটা কি আনন্দের ঘটনা? মিষ্টি খাওয়া, মিষ্টি বিতরণের মতো কোনও উপলক্ষ? নাকি লজ্জার, অপমানের?

জমাজমি ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য আমাদের দেশে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ হয়। তখন তৃতীয় পক্ষ পাশে এসে দাঁড়ায়। অনেক সময় বানরের পিঠা ভাগ করার ফর্মুলায় ভাইদের মধ্যে জমাজমি ভাগ করে দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে বিবদমান ভাইয়েরা খুশি হয়। কিন্তু প্রলয় যখন থেমে যায় তখন বোঝা যায় বিবাদ মেটানোর নামে তৃতীয় পক্ষ কার কী ক্ষতি করেছে। তখন সম্পর্কের টান অনুভব হয়। ভাই ভাইকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের নিষ্ঠুর খেলা তো ততক্ষণে শেষ হয়েছে। খেলার রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে। তখন তো আর আহাজারির কোনও মানে হয় না।

আকালমান্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি হে... যার বাংলা অর্থ বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। ইশারাটা কী? সহজ উত্তর, দেশকে ভালোবাসুন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দেশের ক্ষতি করবেন না। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবেশীর কাছে নালিশ করার অভ্যাস হয়ে গেছে আমাদের। সামান্য কথায় প্রতিবেশীর কাছে নালিশ করি। প্রতিবেশী ডাক দিলে ছুটে যাই। এমনও হয় প্রতিবেশীর পায়ের কাছে বসেও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অসত্য অভিযোগ করি। ফলে প্রতিবেশীরা বিবাদ মেটানোর নামে নিজের, নিজেদের স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দেয়, দিচ্ছেও। এখন হয়তো আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। যখন বুঝতে পারবো তখন কষ্টে বুক চাপড়েও কোনও লাভ হবে না।

শেষে দুটি গল্প বলি। প্রথম গল্পটা সবার জানা। তবু বলি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একটি লোক রাস্তায় বিরাট গর্ত করে তা খড়কুটো দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিলো যাতে বোঝা না যায়। পরে সে দূরে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। কিন্তু প্রতিবেশী তো আসে না। হঠাৎ লোকটির সন্দেহ হলো গর্তটা ঠিকঠাক মতো গভীর হয়েছে তো? এতে মানুষের মৃত্যু হবে কী? একবার রিহার্সেল করে দেখলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। লোকটি গর্তের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার অভিনয় করতে গিয়ে পড়ে গেলো। এরইমধ্যে গর্তে ঢুকে পড়েছিল একটি বিষধর সাপ। ফলে যা হবার তা-ই হলো। সাপের কামড়ে চতুর লোকটির মৃত্যু হলো।

এবার দ্বিতীয় গল্প। মাকে নিয়ে গল্প। দেশকে আমরা মাতৃভূমি বলি। সেই মাকে নিয়ে গল্প। ছেলে উদভ্রান্ত চেহারায় মায়ের কাছে হাজির। ছেলেকে দেখে মা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কী হয়েছে রে বাবা? তুই এত উতলা কেন?
ছেলে বললো, মা তোমার হৃৎপিণ্ড চাই।

ছেলের কথা শুনে মা একটু ভয় পেলেন। পরক্ষণেই তা বুঝতে না দিয়ে হাসিমুখে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন- আমার হৃৎপিণ্ড?

কেন রে বাবা? আমার হৃৎপিণ্ড দিয়ে কি করবি?

উদভ্রান্ত ছেলে উত্তর দিলো, তোমার বউমা তোমার হৃৎপিণ্ড চেয়েছে।
মা অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, বউমা আমার হৃৎপিণ্ড দিয়ে কী করবে?
ছেলে তখন মায়ের কাছে আসল ঘটনা খুলে বললো। মা, তোমার বউমার ধারণা আমি তার চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসি। আমি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাকে বলেছি- মাকে নয়, আমি তোমাকেই বেশি ভালোবাসি। কিন্তু স্ত্রী আমার কথা বিশ্বাস করেনি। আমি যে সত্য বলেছি তা প্রমাণ করতে চায়। তাই তোমার হৃৎপিণ্ড দরকার...।

মা সব শুনে মৃদু হেসে বললেন, ও এই কথা? যা আমার হৃৎপিণ্ড নিয়ে যা।

ছেলে খুশি মনে মায়ের হৃৎপিণ্ড নিয়ে বউয়ের কাছে যাবার জন্য দৌড় দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো মায়ের হৃৎপিণ্ড। মায়ের হৃৎপিণ্ডই উৎকণ্ঠা ছড়ালো- ব্যথা পেয়েছিস বাবা।

প্রিয় পাঠক, এই হলো মা মানে দেশ। আমরা কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে খুশি করতে গিয়ে অজান্তে এমনটা করছি না তো?

গল্প দুটির মোরাল স্টোরি কি বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে? শুভকামনা সবার জন্য।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ