বিশ্বব্যাপী আলোচনার অন্যতম বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। সিনেমায় বহু দেখা রোবট এখন আমাদের হাতের নাগালে। যেমন, চ্যাটজিপিটিকে প্রশ্ন করলে উত্তর পেয়ে যাচ্ছি। আমার প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য এবং লেখার কাজেও সে সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে এআই ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে বিষয়টি তখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এক্ষেত্রে মূল বিতর্ক ছিল- `তাহলে যন্ত্র কি মানুষের জায়গা দ্রুত নিয়ে নেবে?'
মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তির সঙ্গে গণমাধ্যমের যাত্রা নতুন নয়। হাতে লেখা পত্রিকা থেকে প্রিন্ট পত্রিকা, সেখান থেকে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের প্রযুক্তির সঙ্গেই গণমাধ্যম নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ রেডিও আসায় প্রিন্ট পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়নি, কিংবা টেলিভিশন আবিষ্কারের কারণে রেডিও ঝরে যায়নি। তবে হ্যাঁ, ব্যবহারে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে, এর বেশি কিছু নয়। ঠিক তেমনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গণমাধ্যমের ক্ষতির কারণ হবে, এমনটা মনে হয় না। কোনও না কোনোভাবে সময়ের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা এআইকে বশ করে ফেলবে নিশ্চিত।
এবার একটু পেছনে ফিরতে চাই। ২০১৬ সালে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘অনলাইন মিডিয়ার শক্তি’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। তখন ফেসবুকে ‘লাইভ’ ফিচারটি সবে শুরু হয়েছে, যদিও তখনও সবার জন্য সেই সুযোগ উন্মুক্ত ছিল না। তখন অনেকেই শঙ্কা করছিলেন, এই ফিচার চালু হলে গণমাধ্যম হুমকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু আমি সেসময় লেখায় বলতে চেয়েছিলাম, যেকোনও ঘটনা মুহূর্তেই মানুষ এই ফিচার ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিতে পারবে। এমনকি পাঠকই হয়ে উঠবে গণমাধ্যমের অন্যতম সোর্স।
আজ ২০২৪ সাল পর্যন্ত শত শত উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে গণমাধ্যম সাধারণ মানুষের ফেসবুক ভিডিও কিংবা লাইভ থেকেই ফুটেজ কিংবা তথ্য নিয়ে যাচাই-বাছাই করে সংবাদ সরবরাহ করেছে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের সামনে নিত্য-নতুন প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ আসবে, এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে যাওয়াই বড় কথা।
এখন এআই নিয়েও বিশ্বব্যাপী অনেক আলোচনা হচ্ছে। নিউজরুমে যদি এআই একীভূত করা হয়, তাহলে অনেকেই চাকরি হারানোর শঙ্কা করেছেন। তবে আমার কাছে এমনটা মনে হয় না। বরং এআই ব্যবহার করে কীভাবে গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী করা যায়- সেদিকেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমা দেশে ইতোমধ্যে অনেকেই এআই ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ তৈরি, তথ্য বিশ্লেষণ, ইমেজ তৈরি, ছবির ক্যাপশন, ভিডিও নির্মাণ, এমনকি সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনে এআই ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশ বরং এখনও পিছিয়ে আছে। এর প্রধান কারণ ধারণা করা যায় অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতেও এআই ভূমিকা রাখতে পারে। যখন কনটেন্ট বাড়বে, তাতে নতুনত্ব আনা যাবে এবং তখন পাঠকও বাড়বে। পাঠক বাড়লে বিজ্ঞাপনদাতারাও নতুন করে ভাবতে উৎসাহী হবেন। এমনকি এআই ব্যবহার করে কীভাবে বিজ্ঞাপন প্রচারেও নতুনত্ব আনা যায়, সেসব নিয়েও কাজ শুরু হয়ে যাবে। অবশ্য এসব কিছুর জন্য প্রশিক্ষণ জরুরি।
আমার মনে হয় সাংবাদিকতায় যারা আছেন কিংবা কাজ করতে আগ্রহী, তাদের এই নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নিউজরুমে কীভাবে এটি একীভূত করা যায়, কীভাবে প্রোডাকশন বাড়ানো যায়, সেসব বিষয়েও কাজ শুরু করতে হবে দ্রুত। তা না হলে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়বো। ততদিনে দেখা যাবে নতুন কোনও প্রযুক্তি হাজির হয়ে গেছে। তবে এআই ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নতুন এডিটরিয়াল গাইডলাইন তৈরি করা। এআই ইথিক্স কতটা শক্তিশালী হবে, সে বিষয়ে সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞ যারা আছেন, তাদের এখন থেকেই কাজ করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যন্ত্র কখনও মানুষকে সরিয়ে দিতে পারে না, পারবেও না। বরং মানুষ যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
বাংলা ট্রিবিউন এবার ১০ বছর পূর্ণ করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমরা পথ চলছি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নতুন প্রযুক্তিসহ সব ধরনের চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করতে হয়েছে। দীর্ঘ পথচলায় আমার সব সহকর্মীর ভূমিকা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। তরুণদের একটি দল নিয়ে আমরা যাত্রা করেছিলাম, সেটা এখন অনেক পরিণত। প্রত্যেকেই জানে কোন কাজটা তাকে কীভাবে করতে হবে। এই তরুণদের দলে অভিজ্ঞতার মিশেলও রয়েছে। আবার অনেক তরুণ গত ১০ বছরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তবে পথ এখানেই শেষ নয়। আরও পরিণত হয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
আমরা জানি সংকট থাকবে, সারা বিশ্বের গণমাধ্যম সংকটে আছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ থাকে। এমন নানামুখী চাপের ভেতরেই সাংবাদিকতা করতে হয়। এটা নতুন নয়। গণমাধ্যমের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, কেউই খুব সহজভাবে পথ চলতে পারেনি। তবু শেষ পর্যন্ত পাঠকদের জন্যই সাংবাদিকতা করে যেতে হয়। সাংবাদিকতা কোনও চাকরি নয়, এটি সমাজ-দেশ-জাতির প্রতি দায়িত্ব পালন করা।
বাংলা ট্রিবিউন যাত্রালগ্ন থেকেই কখনও তথ্যের সঠিকতার সঙ্গে আপস করেনি। কখনও পাঠককে বিভ্রান্ত করেনি। যদি কখনও ভুল হয়, সঙ্গে সঙ্গে সেজন্য ক্ষমা চাইতেও আমরা কুণ্ঠাবোধ করিনি। ক্ষমা চাইলে কেউ কখনও ছোট হয় না, বরং আস্থার জায়গা বাড়ে। আমরা এমনটাই মনে করি। আমরা এও মনে করি, দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের চেয়ে সঠিক সংবাদ পরিবেশন গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা ট্রিবিউনের পথচলায় পাঠকদের প্রতি রইলো আমাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে আছেন, কৃতজ্ঞতা রইলো তাদের প্রতিও।
শেষ করতে চাই একটি কথা বলে। আমি সবসময়ই বলে এসেছি, আমাদের সঙ্গে যে সহকর্মী একদিনও কাজ করেছেন, তারও এই গণমাধ্যমের প্রতি ভূমিকা আছে। একইসঙ্গে আমরা গত ১০ বছরে কয়েকজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। তাদের আমরা সবসময় স্মরণ করি। সবার প্রতি রইলো অসীম কৃতজ্ঞতা।
লেখক: সম্পাদক, বাংলা ট্রিবিউন।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।