রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব আগুনের ধরন, সময় প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এসব অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কোনও নাশকতা? ঘনঘন অগ্নিকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও। তিনি এসব ঘটনায় ষড়যন্ত্র বা নাশকতা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।
ঈদের আগেই কেন একাধিক মার্কেটে আগুন লাগছে, আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সাার্ভিসকে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে ও অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের ওপর কেন হামলা হচ্ছে, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এগুলো বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস কিনা; এসব প্রশ্ন রাখেন সরকারপ্রধান।
এর আগে সকালে নিউ মার্কেট এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্রিফিং করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) ভবনের তৃতীয় তলা থেকে। বিষয়টি নাশকতা কিনা, খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধও জানান তিনি।
শনিবার (১৫ এপ্রিল) ভোরে লাগা আগুনে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের প্রায় ১ হাজার ৫০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। মার্কেটটির ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোকেরা রাত ৩টার দিকে ব্রিজ ভাঙ্গার কাজ করছিল, ব্রিজের ওখানে বিদ্যুতের লাইন ছিল; যা তারা খেয়াল করেনি। ওই লাইনের ওপর বুলডোজার চালানোর সময়ই আগুনের সূত্রপাত হয়।’ পরিকল্পনা ছাড়াই এই ব্রিজ ভাঙার কারণেই আজ এই দশা (অগ্নিকাণ্ড) হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে এ ধরনের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলছে, ‘একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই অগ্নিকাণ্ডকে নিউ মার্কেটের সঙ্গে সংযুক্ত পথচারী পারাপার সেতুর (ফুটওভার ব্রিজ) সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত করার অপচেষ্টা করছে। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে; যা ডিএসসিসির দৃষ্টিগোচর হয়েছে।’ দুর্যোগের এই কঠিনতম সময়ে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ‘ভিত্তিহীন সংবাদ ও গুজব’ ছড়ানো থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।
ব্যবসায়ীদের কারও কারও ধারণা, এখানে কেউ না কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার ব্যবসায়ী মো. সবুজ আহাজারি করছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগেই ব্যবসায়ীদের মার্কেটে কেন এত আগুন, এটা স্বাভাবিক না। মনে হয় কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’ ঈদ উপলক্ষে তিনি দোকানে ৩০ লাখ টাকার মালামাল তুলেছিলেন, কিছু মালামাল বিক্রি করেছিলেন। বাকি সব শেষ হয়ে গেছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় তাসনিয়া ফ্যাশনের মালিক রুবেল মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রাত ২টার দিকে দোকান বন্ধ করে নবাবপুরের বাসায় ফেরেন। ভোরে খবর পেয়ে দ্রুত মার্কেটে এসে দেখেন আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমে স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে মালামাল বের করার চেষ্টা করেন। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়লে আর ঢুকতে পারেননি। দোকান থেকে সরিয়ে রাখা কিছু মালামালের কাছে বসেই কাঁদছিলেন তিনি।
রুবেল মিয়া বলেন, ‘গুদামে ৪০ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে। গুদামের দরজার কাছেও যেতে পারিনি।’ এই ব্যবসায়ীর মনেও সন্দেহ কেউ না কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ফায়ার সার্ভিস বলেছে মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া এমন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে যে কোনও ছোট্ট দুর্ঘটনায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সবগুলোবিষয় খতিয়ে দেখছি। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনও কারণ আছে সেটাও দেখা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এর আগে বঙ্গবাজারে একটি বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গত রাতে হাজারীবাগের ট্যানারিতেও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। সুরিটোলায় গুদামে আগুন লেগেছে। সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ও নিউমার্কেটের পাশের শিরিন ম্যানশনে বিস্ফোরণের ঘটনা দুটোতেও মামলা নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবাজারের ঘটনায় পুলিশ কমিটি না করলেও তদন্তকাজ চালিয়েছে।’
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে র্যাবের ঢাকার ব্যাটালিয়নগুলোর টহল দল ও সাদা পোশাকে র্যাব সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করে। উক্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনও ধরনের নাশকতা রয়েছে কিনা- এ বিষয়েও র্যাবের গোয়েন্দারা কাজ করছেন।’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নাশকতা মনে করলে আগে দেখতে হবে, এ ঘটনায় কে বা কারা লাভবান হচ্ছে। আর যদি কেউ লাভবান না হয় তাহলে এটা নাশকতা নয়। তবে শুনেছি কিছুদিন আগে ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকে কেউ এমন করেছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে।’
প্রায় সবগুলো ঘটনায় ভোরের দিকে এমন আগুন লাগার ঘটনা ‘অস্বাভাবিক’ মনে করেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘নাশকতা হলে এক সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা বড় ধরনের আগুনের উৎপত্তি হয়। তেমন কোনও আলামত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আর মার্কেটগুলো যখন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়, তখন কোন কোন বিষয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। ভবন, ফায়ার অ্যারেজমেন্ট নাকি ইলেকট্রিক সরঞ্জাম বিষয়ে? কোন ঝুঁকিতে আছে সেটা ক্লিয়ার থাকতে হবে।’ আর কোনও ঘটনা ঘটলেই রাজনৈতিক লোকরা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেন। সেটা তাদের রাজনৈতিক চাল বলে মনে করেন তিনি।
শনিবার (১৫ এপ্রিল) ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে রাজধানী নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিট নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে সকাল ৯টা ১০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণের তথ্য জানায়। তবে এখনও আগুন নেভেনি। পুরোপুরি আগুন নেভাতে আরও কিছু সময় লাগবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।