X
বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের শূন্য হাত, রিক্ত ঈদ

কবির হোসেন
২১ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৫৬আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৪০

বঙ্গবাজারে চলতি মাসের শুরুতেই বিকিকিনি শুরু হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ক্রেতাদের উপস্থিতিতে রমরমা হয়ে উঠছিল ঈদের বাজার। ঈদ ঘিরে কত স্বপ্ন ছিল ব্যবসায়ীদের মনে। সন্তানদের ঈদের কেনাকাটা করা, স্বজনদের ঈদ উপহার দেওয়া, অসহায়দের সাহায্য করা, জাকাত দেওয়া, ঋণ পরিশোধ করা। কিন্তু এসবের কোনও কিছুই হলো না এবার। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী। এখন তারা নিজেরাই অন্যের সাহায্য পেতে দিন গুনছেন।

বঙ্গবাজারে আগুন (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

রাজধানীর বঙ্গবাজার এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে প্রায় চার হাজার দোকান। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সসহ মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, এনেক্সকো টাওয়ার, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের এসব দোকানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় তিন হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির দাবি অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকার। ঈদের আগে এই ব্যবসায়ীদের অনেকে ঢাকার বাসা ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন শূন্য হাতে।

মঙ্গলবার ( ১৮ এপ্রিল) সরেজমিন বঙ্গবাজারে গেলে দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এখনও নির্বাক। শোকে, হতাশায় পাথর হয়ে গেছেন অনেকে। ঈদকে সামনে রেখে নেই কোনও আনন্দ, উত্তেজনা।

আগুনে পুড়ে ছাই বঙ্গবাজার (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

দশ বছর বয়সে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থেকে বঙ্গবাজারে কাজের সন্ধানে আসেন ফিরোজ আলম টুটুল। একসময় কাজও পান। পরে টানা ১৯ বছর বঙ্গবাজারের বিভিন্ন দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘদিনের ব্যবসার অভিজ্ঞতা নিয়ে পাঁচ বছর আগে নিজেই বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটের নিচতলায় দোকান ভাড়া নেন বাৎসরিক এক লাখ ৩২ হাজার টাকা দিয়ে। ফারহানা গার্মেন্টস নামে দোকানে টি শার্ট, শীতের হুডি, সুইপ শার্ট, পলো শার্ট বিক্রি করতেন ফিরোজ। নিজে ব্যবসা দেওয়ার দুই বছরের মাথায় বিয়েও করেছিলেন। একমাত্র মেয়ে ফারহানা (১২ মাস)। সব মিলিয়ে ভালো সংসার চলছিল। অগ্নিকাণ্ডে সব হারিয়েছেন তিনি। তারই পুড়ে যাওয়া দোকানের ভিটায় চৌকি বসিয়ে কিছু কাপড় বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। সেখানে ক্রেতা নেই, অলস সময় কাটাচ্ছেন এই বিক্রেতা।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যবসা শুরু করার পর পর দেশে করোনা বাড়লো। তখন একবার দোকান বন্ধ, আরেকবার খোলা এভাবে মাসের পর মাস চালিয়ে চাচ্ছিলাম। তারপরও ভালোই চলছিল। এখন তো আমার আর কোনও কিছুই নাই। যা ছিল সব আগুন কেড়ে নিলো। রমজান এলে দোকানে ৭ থেকে ৮ জন প্রতিদিন এক হাজার দেড় হাজার টাকার ইফতার করেছি। এখন নিজেই মসজিদে গিয়ে ইফতার করি। ঈদে কাকে কী দেবো, নিজের ১২ মাসের সন্তানকেই এখনও কিছু দিতে পারিনি। বাবা-মা, বউ, স্বজন তাদের কথা পরে। যে অবস্থা হয়েছে নিজে খেয়েই বাঁচতে পারবো না।'

আগুনে পুড়ে ছাই বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের আহাজারি (ছবি: নাসিরুল ইসলাম)

কাঠের মার্কেটে আদর ফ্যাশন ও যৌথ এন্টারপ্রাইজ নামে নিচতলায় দুটি দোকান ছিল বিক্রমপুরের মো. রাকিবের। ১৭ বছর অন্যের দোকানে চাকরি করেছেন তিনি। পরে চাকরি ছেড়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন নিজের দুটি প্রতিষ্ঠান। ছেলেদের শার্ট বিক্রি করতেন তিনি। ঈদ সামনে রেখে ৩০ লাখ টাকার মালামাল তার দুই দোকানে মজুত করেছিলেন। আগুনে দুই দোকান পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেলো।

রাকিব পাগলপ্রায় অবস্থায় বঙ্গবাজারের চারদিকে ঘুরছেন যদি কোনও সহায়তা মেলে সে আশায়। তিনি বলেন, ‘ইসলামপুরে আমার ৪০ লাখ টাকা দেনা আছে। ঈদ মৌসুম শেষ করে দেনা পরিশোধ করতে পারতাম। এভাবেই তো আমরা ব্যবসা করি। এরইমধ্যে আগুনে আমার সব চলে গেলো। আমার যৌথ পরিবার, সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। দুই দিন পরে ঈদ, আমাদের ঈদটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। আরও তিন ভাই-বোন আছে সবাই আমার ছোট। স্ত্রীসহ আমার ছয় মাসের একটি মেয়ে আছে। বংশালে ১৫ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতাম। ভাড়া কোথায় থেকে দেবো এখন। পরিবারকে শূন্য হাতে গ্রামে পাঠাতে হবে।’

বঙ্গবাজারে আগুন

‘আমার সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আয় হতো ৫০ হাজার টাকা। চারজন কর্মচারী ছিল। তাদের বেতন দিতাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। ঈদে সব আত্মীয়স্বজনকে কাপড় দিতাম। মানুষকে সাহায্য করতাম। এবার আমি সাহায্য খুঁজছি। আগুন আমাকে ফকির বানিয়েছে।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বলছিলেন রাকিব।

বঙ্গবাজারে আরেকজন ব্যবসায়ী মো. জুয়েল হোসেন। কাঠের মার্কেটের ওপরে-নিচে ‘সাব্বির অ্যান্ড ফাতেমা ফ্যাশন’ নামে চারটি দোকান ছিল তার। চারটি দোকানেই বাচ্চাদের বিভিন্ন কাপড় বিক্রি করতেন। আগুনে দোকানগুলোর ৬০ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে জানিয়ে জুয়েল বলেন, 'আমার পাঁচ জন কর্মচারী ছিল। এ দোকানগুলো থেকে আমার প্রতি মাসে দেড় লাখ টাকা আসতো।  আমার আজ হাত পাততে হচ্ছে মানুষের কাছে। আল্লাহ চাইলে সবই করতে পারে। স্বজনরা দুই হাজার, তিন হাজার করে টাকা বিকাশে পাঠাচ্ছে। ঈদ আসলে ঢাকায়, গ্রামের বাড়িতে আগে থেকেই লোকজনকে নগদ টাকা, কাপড় বিলিয়ে দিয়েছি। দেওয়ার সামর্থ্য ছিল। এখন এগুলো স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছু না। ভাই-বোন আছে, আরভী নামে আমার দেড় বছরে একটি বাচ্চা আছে। ঈদ তো পরের কথা, তাদের নিয়ে সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবো বুঝে উঠতে পারছি না। নতুন করে ব্যবসা দিতে চাইলেও নগদ টাকা দরকার। কে দেবে টাকা! দেনাই আছে অনেক।'

বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে চৌকি বিছিয়ে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা (ছবি: ফোকাস বাংলা)

বঙ্গবাজারে ‘মায়ের দোয়া’ গার্মেন্টস নামে একটি দোকানে গেঞ্জির ব্যবসা করতেন চাঁদপুরের মো. ইয়াসিন। অগ্নিকাণ্ডে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের মতো সব হারিয়ে পথে বসেছেন তিনিও। তার মতে, যারা অন্যের দোকানে চাকরি করে পরে নিজেই ব্যবসা দিয়েছেন, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আগুনে। তার দোকানে ১২ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সবই আগুনে পুড়ে কয়লা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পরিবারের ১২ জন সদস্য রয়েছে সবাই আমার ওপরে চলে। আমার দুটি মেয়ে জান্নাত আরা ইমরোজ (৫) ও তাসনিয়া (১৮ মাস)। মেয়ে দুটিকে বাবা হিসেবে ঈদে কিছু দেওয়ার আমার সামর্থ্য নেই। এরমধ্যে বাসা ভাড়া আছে। ঢাকায় এখন থেকে কী করবো। খালি হাতে পরিবার নিয়ে গ্রামে যেতে হবে।'

বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে বসে পণ্য বিক্রির চেষ্টা ব্যবসায়ীদের (ছবি: ফোকাস বাংলা)

কাঠের মার্কেটে মিম ফ্যাশন নামে একটি দোকান কাজ করতেন ১৮ বছরে রেদোয়ান। তিন বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছেন। এরপর থেকে নানা-নানির কাছে থেকেই বড় হয়েছে রেদোয়ান। দোকানে কাজ করে প্রতি মাসে ৯ হাজার টাকা পেতেন। অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু হারিয়েছে তার মহাজন। এরপর থেকে অসহায় হয়ে বঙ্গবাজারের চারপাশ ঘুরছেন তিনি।  রেদোয়ান বলেন, 'আমার বাবা-মা নেই। নানা-নানি থাকেন রামগঞ্জে। বড় ভাই সাইফুল ইসলাম রামগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে পড়েন। বেতন পেলে আমার খরচ রেখে ভাইয়ের জন্যও পাঠাতাম। নানা-নানিকে দিতাম। এবার তো মহাজনের কিছু নেই। আমাকে কোথা থেকে দেবে।'

গত ৪ এপ্রিল ভোর ৬টায় আগুন লাগে বঙ্গবাজারে। টানা ৬ ঘণ্টা আগুন ধরার পর ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ওইদিন বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে পুরোপুরি নেভাতে সময় লাগে প্রায় তিন দিন।

/এফএস/এমওএফ/
টাইমলাইন: বঙ্গবাজারে আগুন
২১ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৫৬
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের শূন্য হাত, রিক্ত ঈদ
০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০৫
০৫ এপ্রিল ২০২৩, ২৩:০০
০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:১৯
সম্পর্কিত
রাজধানীর ফিটনেসবিহীন গাড়ি স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত
এডিসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি: তাপস
ঢাকায় চলবে না ব্যাটারিচালিত রিকশা
সর্বশেষ খবর
একসঙ্গে ৪ সন্তানের জন্ম দিলেন এক নারী
একসঙ্গে ৪ সন্তানের জন্ম দিলেন এক নারী
জরুরি সেবার যানবাহন ছাড়া হর্ন বাজানো নিষেধ: ওবায়দুল কাদের
জরুরি সেবার যানবাহন ছাড়া হর্ন বাজানো নিষেধ: ওবায়দুল কাদের
উদ্ভাবনে কৃষকরা উপকৃত হবেন, ফসলের উৎপাদন বাড়বে: কৃষিমন্ত্রী
উদ্ভাবনে কৃষকরা উপকৃত হবেন, ফসলের উৎপাদন বাড়বে: কৃষিমন্ত্রী
‘জিম্মিকালে মৃত্যুর দুয়ারে বসে ৩৩ দিনরাত কাটাতে হয়েছে’
ঘরে ফেরা এমভি আব্দুল্লাহর নাবিক‘জিম্মিকালে মৃত্যুর দুয়ারে বসে ৩৩ দিনরাত কাটাতে হয়েছে’
সর্বাধিক পঠিত
সোনার অলংকার কেনাবেচায় নতুন হার নির্ধারণ
সোনার অলংকার কেনাবেচায় নতুন হার নির্ধারণ
নিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আত্মসাৎনিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
পেঁয়াজ আমদানি শুরু
পেঁয়াজ আমদানি শুরু
একীভূত হতে পারে কেউ পাস না করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
একীভূত হতে পারে কেউ পাস না করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল