X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘সভ্য সমাজে এগুলো হতে পারে না’

প্রভাষ আমিন
০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৩৮আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৩৮

প্রভাষ আমিন আমাদের চারপাশে প্রতিদিন অনেক অন্যায় হয়, অবিচার হয়; কিন্তু আমরা সব সময় ন্যায্য ও যথাযথ প্রতিবাদ করি না বা করতে পারি না। এই প্রতিবাদ না করার দুইটা কারণ হতে পারে। প্রথমত, এত অন্যায় হচ্ছে, প্রতিবাদ করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি বা খেই হারিয়ে ফেলছি।

দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদের ক্ষেত্রে আমরা ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ পদ্ধতি অবলম্বন করছি। মানে আমরা প্রতিবাদের একটা কমফোর্ট জোন বানিয়ে নিয়েছি। কোনও ঘটনায় মামলা থাকলেও আসামির নাম গোপন করছি। আবার কোথাও সন্দেহভাজনকেও অপরাধী সাব্যস্ত করে ধ্বংস করে দিচ্ছি।

চিত্রনায়িকা পরীমণির প্রতি হওয়া ভয়ংকর অন্যায়ের ব্যাপারেও যেন আমরা সেই কমফোর্ট জোনেই বিচরণ করেছি। গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের কান্নাও আমাদের স্পর্শ করে না। পরীমণি ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা। তবে পত্রপত্রিকা সূত্রে নাম জানলেও আমি পরীমণির কোনও সিনেমা দেখিনি। সে অর্থে তাকে চিনতামও না। ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ আনার পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে তাকে চিনেছি। পরীমণির মামলায় ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। কিন্তু বোট ক্লাবের ঘটনার দুই মাসের মাথায় গত ৪ আগস্ট পরীমণির বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। পরীমণির বিরুদ্ধে কোনও মামলা না থাকলেও র‌্যাবের অভিযানের ধরন দেখে মনে হচ্ছিল, তারা কোনও ‘মাফিয়া ডন’কে গ্রেফতার করতে গেছে। চার ঘণ্টার অভিযান শেষে বিপুল মদসহ র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দেওয়া হয়। মদ তার বাসায় ছিল নাকি র‌্যাব নিয়ে গিয়েছিল– সে বিতর্কে যাচ্ছি না। ধরে নিচ্ছি, পরীমণির বাসায় মদ ছিল। বাসায় অননুমোদিত মাদক রাখা অবশ্যই অন্যায়। কিন্তু বাসায় মদ রাখা একজন পরিচিত চিত্রনায়িকাকে তিন দফায় ৭ দিন রিমান্ডে নেওয়ার মতো বা জামিন না দিয়ে ২৭ দিন আটকে রাখার মতো অপরাধ নয় নিশ্চয়ই। অপরাধের মাত্রা আদালত বিবেচনা করবেন, বিচার করে তার শাস্তি দেবেন। কিন্তু বিচারের আগেই পুলিশ আর কয়েকটি মিডিয়া মিলে পরীমণির সঙ্গে যা করেছে, তা ভয়ংকর অন্যায়।

প্রতিবাদ একদম হয়নি, তা বলবো না, লন্ডন থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রতিবাদ করেছেন। পরে বাংলাদেশের সুশীলরাও বিবৃতি দিয়েছেন। শাহবাগে মিছিল-সমাবেশও হয়েছে। কিন্তু পরীমণির সঙ্গে হওয়া অন্যায়টা যত বড়, প্রতিবাদটা তত ব্যাপক ছিল না। সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করেছে শিল্পী সমিতি। এমনিতে বাংলাদেশে পেশাজীবীদের কেউ কোনও অপরাধ করলেও তার সংগঠন তার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম হয়েছে পরীমণির ক্ষেত্রে। শিল্পী সমিতি তার পাশে তো দাঁড়ায়ইনি, উল্টো অপরাধ প্রমাণের আগেই তার সদস্যপদ স্থগিত করেছে। আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর গণমাধ্যমের আচরণ দেখে মনে হতে পারে; পরীমণি বিরাট কোনও অপরাধী। অথচ চারপাশে প্রতিদিন কত অপরাধ হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে, ব্যাংক লুট হচ্ছে, টাকা পাচার হচ্ছে; তাদের অনেকেই সমাজে বুক ফুলিয়ে চলছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাই হয় না। মামলা হলেও পুলিশ তাদের ধরেও না; রিমান্ড তো অনেক পরের কথা। পুলিশের আচরণ দেখে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সব অপকর্ম, দুর্নীতি, অনিয়মের জন্য দায়ী একমাত্র পরীমণি।

মাদক মামলায় গ্রেফতারের পর পরীমণিকে তিন দফায় ৭ দিন (৪+২+১) রিমান্ডে নেওয়া হয়। বাসায় বেশ কয়েক বোতল মদ পাওয়া নিয়ে একজন চিত্রনায়িকাকে ৭ দিন ধরে কী জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তা জানায়নি পুলিশ। আদালতও চাহিবামাত্র রিমান্ড দিলেও জামিন নিয়ে সময় নিয়েছেন।

১৯ আগস্ট পরীমণির জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। এর বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। এই আদালত ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন রাখেন। পরদিন নির্ধারিত সময়ের আগেই জামিন শুনানি চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবী। কিন্তু এতে কোনও ফল না পেয়ে ২২ আগস্টের ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে ২৫ আগস্ট হাইকোর্টে আবেদন করেন পরীমণির আইনজীবী। পরদিন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল দেন। রুলে জামিন আবেদন শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। জামিন আবেদনের শুনানি দুই দিনের মধ্যে করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। এতেই নড়েচড়ে বসে নিম্ন আদালত। ৩১ আগস্ট শুনানি করে পরীমণিকে জামিন দেওয়া হয়। পরদিন ১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। পরীমণি মুক্তি পেলেও ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব নির্ধারিত তারিখে হাইকোর্টে রিটের শুনানি হয়। সেখানে হাইকোর্ট পরীমণির রিমান্ড বিষয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন। শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘রিমান্ডের উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিলো, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো কোনও সভ্য সমাজে হতে পারে না। রিমান্ড অতি ব্যতিক্রমী বিষয়।’ হাইকোর্ট বুঝলেও নিম্ন আদালত এই ব্যতিক্রমী বিষয়টি এতদিন বুঝতেই পারেননি।

বাংলাদেশে ‘বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড’ বলে গালভরা একটা টার্ম আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন বেআইনি কাজ করে, যখন কাউকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে বা গুম করে, তখন আমরা বলি বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড। কিন্তু বিচারের আবরণেও যে কত বড় অবিচার হতে পারে, পরীমণি তার উদাহরণ হয়ে থাকবেন।

এটা হলো ‘বিচার-অন্তর্ভুক্ত অবিচার’। এখানে পরীমণি একজন ব্যক্তিমাত্র নন। বলাই হয়, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। পুলিশ চাইলে যে কাউকে, যখন-তখন আটক করতে পারে, গ্রেফতার করতে পারে। মামলা, ওয়ারেন্ট, সার্চ ওয়ারেন্ট কিছুই কোনও বিষয় নয়। পরীমণির বাসায় র‌্যাব গিয়েছিল কোনও মামলা বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই। রাস্তাঘাটে পকেটে মাদক গুজে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। আগে গ্রেফতার, তারপর মামলা সাজানোর প্রথম বা শেষ উদাহরণ নিশ্চয়ই পরীমণি নন। আগেও এমন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। আর কিছু পাওয়া না গেলে পুরনো মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির জায়গা ঢুকিয়ে দেওয়া তো পুলিশের জন্য ওয়ান-টু ব্যাপার। আইনের সাধারণ নিয়ম হলো, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে, মামলা হলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অমুককে ধরা হবে। ধরার পর কারও বিরুদ্ধে হরিণের চামড়া, কারও বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দেওয়া হয়।

হাইকোর্টকে ধন্যবাদ। সব অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে এখনও আমাদের ভরসার জায়গা একটা আছে, এটা আমাদের আশ্বস্ত করে। পরীমণির জামিন হয়ে গেলেও তার আইনজীবীদের রিট এবং রুল নিষ্পত্তি হয়নি। রিমান্ডের ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও নিম্ন আদালত তা অনুসরণ করেনি। কেন করেনি, হাইকোর্ট নিশ্চয়ই তা জানতে চাইবেন। আশা করি, এ নির্দেশনা আরও কঠোরভাবে অনুসরণের নির্দেশনাও দেবেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি কতদিনের মধ্যে জামিন শুনানি করতে হবে, সে ব্যাপারেও হাইকোর্ট নির্দেশনা দেবেন বলেছেন। আশা করি ভবিষ্যতে আর কেউ পরীমণির মতো আইনি অবিচারের শিকার হবেন না। একটা সভ্য সমাজে, আইনের শাসনেই আমরা থাকতে চাই। যেখানে সব নাগরিক আইনি সুরক্ষা পাবেন, আইনের চোখে সবাই সমান হবেন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ