X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হিংসাকে হারানোর রাজনীতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২০ অক্টোবর ২০২১, ১৫:৫৭আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২১, ১৯:১০

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মহাশূন্যে প্রথম ছায়াছবির শুটিং শেষ করে রাশিয়ার একটি সিনেমা নির্মাতা দল নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। মহাশূন্যে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী নিয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবনাও এগিয়ে চলছে। বিমান সংস্থাগুলো জানাচ্ছে তারা কত দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষকে পৌঁছে দিতে পারবে। বিশ্বব্যাপী বড় গণমাধ্যমে এখন এগুলো বড় খবর। মানুষে মানুষে এই যে নৈকট্য স্থাপনের প্রচেষ্টা, উল্লাস, আনন্দ তখন আমরা আমাদের দেশে হিন্দুপাড়া খুঁজছি জ্বালিয়ে দিতে, লুট করতে।  

রাজনৈতিক কারণে সংঘাত আমাদের বহু দিনের চেনা। সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার ইতিহাসও প্রাচীন। কিন্তু এবার হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার সময় যেভাবে ধর্মকেন্দ্রিক অসহিষ্ণুতা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো তার বিচার আইনি পদ্ধতিতে না হলেও ইতিহাস এর বিচার নিশ্চয়ই করবে। কারণ, ইতিহাস কোনোকালেই প্রশ্ন ও বিচারের ঊর্ধ্বে ছিল না।

এটা ঠিক হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া নয়। সরাসরি হিংসার উল্লাস। একটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পিত সহিংসতা। বহুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে আমরা যত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছি, তত দ্রুতই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি সেই জায়গা দখলে নিচ্ছে। এবং এটা হয়েছে রাজনীতির কারণেই। যাদের আমরা উদারনৈতিক বলে জানতাম সেসব রাজনৈতিক দলও এখন ধর্মাশ্রয়ী হচ্ছে, ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বন্ধু হয়ে উঠছে। রাজনীতির এই তালেবানিকরণ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা ভাবতে পারছেন না কেউ। তবে বুঝতে পারছে ১৯৭১-এ যে আদর্শ আর স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করেছিল মানুষ, তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের কথা আমরা দিন রাত বলছি। কিন্তু উন্নয়ন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশ যদি আমাদের সাধনা হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতাকে দূরে সরিয়ে রেখেই এগোতে হবে।

শাসক দল, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে নিজেকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে আওয়ামী লীগকে। সে কেন তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত হতে পারে না, কেন প্রতিরোধ করতে পারে না, কেন তার ভেতরে মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা জায়গা পেয়ে যায়, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে নিজেকেই।

টানা ১২ বছর দল ক্ষমতায়, তাহলে মৌলবাদী শক্তির এই বাড়বাড়ন্ত হয় কী করে, সে জিজ্ঞাসার সঙ্গে এটাও জানা দরকার, দলের ন্যারেটিভ কেন আজ তরুণ মনকে প্রভাবিত করতে পারছে না। কথাটা এ কারণে বলা যে কুমিল্লা, নোয়াখালী, রংপুরে যে হামলাগুলো হয়েছে তাতে অংশ নেওয়া বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ২৫। এখন যার বয়স ১৮, ১২ বছর আগে ছিল ৬ বছর, এখন যার বয়স ২৫, ১২ বছর আগে ছিল ১৩ বছর। দল ১২ বছর ধরে ক্ষমতায়, অথচ তারুণ্যের মনোজগৎ দখলে নিলো মৌলবাদী গোষ্ঠী?

কে কোন রাজনীতি করবে সেটা তাদেরই বিষয়, কিন্তু প্রত্যাশা থাকে মানুষের। বাংলাদেশের সমাজ যখন অনিশ্চয়তা এবং হিংসার আবর্তে, তখন রাজনীতির কাছে আশ্রয় চায় আক্রান্তরা। আজ আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা টালমাটাল। বলতে গেলে নৈরাজ্য নেমে এসেছে গোটা দেশে। পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের ওপর জুলুম চলছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, সব ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, লুট করা হয়, তখন অনেক স্থানে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সব জায়গার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আক্রমণকারীরা সশস্ত্র হয়ে এসেছিল। শুধু লাঠি নয়, সূক্ষ্ম ধারালো অস্ত্রও ছিল তাদের সঙ্গে।  

হিন্দুদের ওপর আঘাত নতুন নয়। তবে গত কয়েক বছরে এই হিংসা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই অনেক জায়গায় অসহায় পড়ছেন মৌলবাদীদের দাপটের কাছে। তালিবানি কায়দায় এরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জ্বালিয়েছে, এবার করলো কুমিল্লা, ফেনী ও রংপুরে। প্রতিবার তাদের সাফল্যে তারা উজ্জীবিত হচ্ছে আর বাকি সবাই নীরব দর্শক হয়ে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে।  

ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু দেখা যায়, স্বাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা বরাবর মুসলমানদের মধ্যে ছিল। যারা লেখাপড়া করেন তারা জানেন, ইসলামি সভ্যতায় যুক্তিবাদী নেতৃত্বের অভাব ছিল না কখনোই। আধুনিককালেও স্যার সৈয়দ আহমেদ, কাজী আব্দুল ওদুদের মতো অনেকে নিজেদের উদারনৈতিক হিসেবেই পরিচিত করেছিলেন। এই যুক্তিবাদীরা শরিয়তকেও অন্ধভাবে অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। সেই মুক্তমনে এক ভয়াবহ সংকট এসেছে আজ। অন্ধত্ব, পশ্চাৎপদতাকেই পুঁজি করছে সহিংস ধর্ম ব্যবসায়ীরা।

রাজনীতি আমাদের সবটা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এবার সবাই চায় সেই হিংসাকে হারানোর রাজনীতি। পরিস্থিতি বদলাতে বদলাতে এমন হয়েছে যে উদার মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বারবার হামলার শিকার হলেও সমাজে মোল্লাতন্ত্রবিরোধী সুর কমে আসছে। যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিপরীত যুক্তি নেই এদের, সরাসরি খুন।

এমনটা ছিল না আমাদের চারপাশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এগিয়ে না গিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। বিভাজিত হতে হতে এমন হয়েছি যে ধর্ম ও রাজনীতি এসবের বাইরে গিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারছি না আমরা। রাজনীতি আমাদের সুস্থ সমাজ গঠনের স্তম্ভ। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে সমাজ। রাজনীতিকেরা বিভিন্ন দল করেন, আবার সমাজের মানুষের পাশে দাঁড়ান দল-মত বিবেচনা না করেই। কিন্তু সেটা নেই এখন। ব্যক্তি, দল নির্বিশেষে শুভচিন্তার উন্মেষের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের, সম্প্রীতির বাতাবরণ বজায় রাখার রাজনীতিটা আবার ফিরবে, সেই বিশ্বাস করতে মন চায়। আশা করি আয়নায় মুখ দেখবেন সবাই।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ