X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কিবোর্ড অথবা লিপির কথা

আশফাক সফল
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:০০আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:২৫

আশফাক সফল স্বাধীনতার আগেই বাংলাদেশে কম্পিউটার এসেছিল তৎকালীন পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে এবং সমসাময়িককালে আদমজী জুটমিলে। একাধিক সূত্রের মতে, পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে স্থাপিত কম্পিউটারটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম কম্পিউটার। স্বাধীনতার পরে একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে; যার মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিসংখ্যান ব্যুরো, আণবিক শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, বিভিন্ন ব্যাংক, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যদিও ষাটের দশকের শেষভাগ থেকেই বেশ কিছু ব্যাংক কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করে। স্বাধীনতার পর থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত খুবই সীমিত কম্পিউটারের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল আইবিএম ও এপল-ম্যাক কম্পিউটারের; বিশেষ করে ম্যাক কম্পিউটারের গ্রাফিক্যাল স্ক্রিনের কারণে প্রিন্ট ও উঠতি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এর বিশেষ কদর। অন্যদিকে আইবিএম ছিল বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অফিসে বিশেষ আকর্ষণ। আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে একাধিক অ্যাকাউন্টিং ও ব্যাংকিং সফটওয়্যার তৈরির কথা জানা যায়।

সেই সময়ের কম্পিউটারগুলোতে বাংলা লেখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। মূলত আস্কি (ASCII) কোডনির্ভর সেই কম্পিউটারগুলোতে সবকিছুই ছিল ইংরেজি নির্ভর। তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তখন কম্পিউটারের স্থানীয়করণ বা লোকালাইজেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষার কিবোর্ড ও ফন্ট (ডিসপ্লেতে বর্ণ দেখার জন্য বিশেষ কোড) তৈরি হচ্ছে। কারিগরি দিক থেকে আলোচনা করলে, কম্পিউটার কিবোর্ডের দুটি অংশ, একটি হলো ইন্টারফেস আর অন্যটি কিবোর্ডের  লে-আউট। ইন্টারফেস বহুলাংশে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং মাধ্যমে তৈরি হওয়া একটি সফটওয়্যার, যেটি কিবোর্ডের সঙ্গে কম্পিউটারের মূল ভাগের যোগাযোগ সমন্বয় করে। শুরুর দিকে কম্পিউটারের মেমোরি (memory) খুবই কম হবার কারণে (এখনকার মাঝারি মানের পিসির কয়েক হাজার ভাগের একভাগ ছিল মেমোরি সাইজ) কিবোর্ড ইন্টারফেস প্রোগ্রাম করা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। অনেক সময় দেখা যেত কিছুক্ষণ লেখালেখি করলে বা বড় কোনও ডকুমেন্ট প্রিন্ট করতে দিলে অনেক সময় নিতো। আধুনিক কম্পিউটারের সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিকোড (unicode)-এর ব্যবহার এই সমস্যা সমাধান করেছে অনেকাংশে। অন্যদিকে কিবোর্ডের লে-আউট যতটা না ডিজিটাল তার চেয়ে বেশি মেকানিক্যাল আর সাইকোলজিক্যাল।

কিছুটা ভেঙে বলা যাক, আধুনিক কম্পিউটারে আমরা যে কিবোর্ড দেখি, তার পূর্বসূরি হচ্ছে টাইপরাইটার। টাইপরাইটারের আমল থেকে যে লেআউট বাংলা কিবোর্ডে প্রচলিত, এগুলোর মাঝে মুনীর, লেখনী ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়। কিবোর্ডের লেআউট তৈরি করার সময় সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ-

এক. যে ভাষার জন্য কিবোর্ড লেআউট তৈরি করা হচ্ছে, সেই ভাষার প্রচলিত বা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দসমূহ লিখতে কতটা কম সময় লাগে। এই ক্ষেত্রে দেখতে হয়, যে ভাষার জন্য লে-আউট তৈরি করা হচ্ছে সেই ভাষায় কোন বর্ণের/অক্ষরের ব্যবহার কত বেশি। যে অক্ষরগুলোর ব্যবহার বেশি, সেগুলোকে মাঝের সারিতে সাধারণত রাখা হয়। এর ফলে ব্যবহারকারীকে অপেক্ষাকৃত কম আঙুল সরাতে হয়। এই কাজের সঙ্গে জড়িত ভাষার কতগুলো অক্ষর আছে।  অক্ষর বলতে বর্ণের (স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ)-এর পাশাপাশি যাবতীয় যুক্তাক্ষরকেও বিবেচনা করতে হয়।

দুই. বর্ণের সন্নিবেশ কতটা সহজ মনে রাখার জন্য। সাধারণভাবে ইংরেজি কোয়েরটি (QWERTY) কিবোর্ড লেআউট দিয়ে আমাদের কিবোর্ড সন্নিবেশের সঙ্গে পরিচয় হয়। কোয়েরটি নামকরণের কারণ এই কিবোর্ডের লেআউটে QWERTY এই ছয়টি বর্ণের অবস্থান প্রথমে। এই লেআউটের কিবোর্ডের অভ্যস্ততার কারণে ফনেটিক লেআউটের কিবোর্ড বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়; যেমন- অভ্র, রিদমিক, অক্ষর, অঙ্কুর, গুগল ইন্ডিক ইত্যাদি।

এ কথা ঠিক, বাংলা একাডেমি, যাদের মিশন হচ্ছে “বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির গভীরতম চর্চা ও উন্নত গবেষণা এবং বাঙালি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস (Intellectual History) রচনা ও তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।”; তাদের বাংলা ভাষার জন্য কিবোর্ডের প্রমিতকরণ নিয়ে রয়েছে পশ্চাৎপদতা। ভাষার গঠন, কথন, লিখন ও বুননকে সেখানে প্রমিতকরণ করা হচ্ছে, সেখানে ভাষার ডিজিটাল-রূপকে প্রমিতকরণের দায়িত্ব কিছুটা হলেও বাংলা একাডেমির ওপর বর্তায়। যেহেতু কিবোর্ড লেআউট তৈরির ক্ষেত্রে বর্ণ, অক্ষর ও শব্দ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রয়োজন; যেমন সাধারণ লেখালেখিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা অক্ষর কোনগুলো, যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে কি-স্ট্রোক-এর ধারাবাহিকতা, ইত্যাদি। তবে এই সংক্রান্ত গবেষণা ও উপাত্তের পরিমাণ প্রকৃত অর্থে শুধু বাংলা একাডেমি নয়, সমগ্র বাংলাদেশেই কম। অবশ্য এ কথা স্বীকার করতেই হবে, কিছু প্রমিত বাংলা ফন্ট তৈরিতে বাংলা একাডেমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা প্রশংসনীয়।

এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন “বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল” ২০০৫ সাল নাগাদ জাতীয় পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য “জাতীয় কিবোর্ড”  নামে একটি লেআউট ও ইন্টারফেস তৈরি করে। গঠনগত দিক থেকে “জাতীয় কিবোর্ড” অনেকাংশে মিলে যায় “বিজয়” কিবোর্ডের সঙ্গে। (মূলত কিবোর্ডের একই  key-এর মাঝে বর্ণমালার পাশাপাশি দুটো বর্ণকে রাখার ধারণা থেকে এই মিলগুলো আসে; যেমন কিবোর্ডে “j” key চাপলে “ক” এবং শিফট ধরে “j” চাপলে “খ” লেখা হয়)। এই ধারণাটা বেশ সহায়ক কিবোর্ডে বর্ণের সন্নিবেশ মনে রাখার জন্য। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ধারণা সাংঘর্ষিক, বিশেষ করে যখন বহুল প্রচলিত শব্দগুলোকে ভিত্তি করে লেআউট তৈরি করার প্রচেষ্টা ছিল। যেমনটা দেখা গিয়েছিল “শহীদলিপি” কিবোর্ড তৈরির ক্ষেত্রে।
উল্লেখ্য, “শহীদ-লিপি” কিবোর্ড তৈরির সময় প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ সেই সময়ের ম্যাক কম্পিউটারের সম্পূর্ণ ইন্টারফেসের বাংলায় ডিসপ্লেও তৈরি করেছিলেন, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম অপারেটিং সিস্টেমের লোকালাইজেশন। উল্লেখ্য, সমসাময়িককালে (১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সালে) প্রকৌশলী মাইনুল ইসলাম উদ্ভাবিত “মাইনুলিপি” নামে একটি ফন্ট-এর কথা জানা যায়, যার সাহায্যে ম্যাক কম্পিউটারের সঙ্গের কিবোর্ড দিয়েই বাংলা লেখা সম্ভব হতো। আর ১৯৮৮ সালে তৈরি হয়েছিল “বিজয়” কিবোর্ড, যা ছিল ইউনিকোডভিত্তিক “অভ্র” ফনেটিক কিবোর্ড আসার আগে পর্যন্ত সবথেকে জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত কিবোর্ড। এই কিবোর্ডর প্রবক্তা ছিলেন জনাব মোস্তাফা জব্বার (বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী)।

“জাতীয় কিবোর্ড” লেআউট বেশ তৈরি করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ কথা কোনও প্রকার জরিপ না চালিয়ে বলা যায়, “জাতীয় কিবোর্ড”-এর সঙ্গে আমজনতা যতটা পরিচিত তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয় “বিজয়” বা “ইউনিজয়”। ব্যক্তিগতভাবে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমার জানা আছে, দাফতরিক ভাষা হিসাবে বাংলা যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি “বিজয়” কিবোর্ড জনপ্রিয়। আর অপেক্ষাকৃত তরুণদের কাছে “ফনেটিক” লে-আউট আরও জনপ্রিয়।

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের কাছে আরেকটি জনপ্রিয় কম্পিউটিং মাধ্যম হচ্ছে মোবাইল কম্পিউটিং। মোবাইল কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রেও ফনেটিক কিবোর্ডগুলোকে বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কোনও প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ফোনেটিক কিবোর্ড ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করতে পারে ব্যবহারকারীরা। এছাড়া একাধিক লেআউট মনে রাখতে হয় না বিধায় ব্যবহারকারীদের কাছে ফোনেটিক কিবোর্ডের জনপ্রিয়তা দিনের পর দিন বাড়ছে।

পরিস্থিতির বিচারে, বাংলায় আদৌ কোনও জাতীয় কিবোর্ড লেআউট বা আলাদা প্রমিত কিবোর্ডের প্রয়োজন আছে কিনা সেই প্রশ্ন করা যেতেই পারে। ব্যবহারকারীদের দিক থেকে চিন্তা করলে হয়তো প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি এবং ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক বা মুক্ত সফটওয়্যার গ্রুপগুলোর সহযোগিতায় বাংলা ভাষা আজ প্রায় সব ধরনের কম্পিউটিং ডিভাইসে ব্যবহার করা সম্ভব। ভাষা আন্দোলনের সাতটি দশক পরে এসে বাংলা ভাষার ডিজিটালাইজেশনে এই অর্জন কম কীসে?

লেখক: ব্লগার ও আইটি প্রফেশনাল

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ