X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ সড়ক কি কথার কথা!

রেজানুর রহমান
২২ অক্টোবর ২০২২, ১০:৪৫আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ১০:৪৫

আজ জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে র‍্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনারসহ নানান আয়োজন থাকবে। নিরাপদ সড়ক, বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অনেকেই সুন্দর সুন্দর কথা বলবেন। কথা শুনে মনে হবে বাংলাদেশে কাল থেকে হয়তো আর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে না। ‘পাখির মতো’ মানুষ মারা যাবে না। কিন্তু এটা কি বাস্তব? আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি কাল থেকে দেশের কোথাও আর সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের নির্মম মৃত্যু হবে না। সড়ক পথের যাত্রা কাল থেকে অনেক আনন্দের হবে। এর আইন মানবো, একই সঙ্গে সড়কের আইন ভঙ্গকারীরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা পাবে, জোর দিয়ে বলতে পারি কি এসব কথা? বোধকরি না। তবু আজ জাতীয়ভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হবে, এটাই বড় কথা।

একটি স্লোগান বোধকরি সবাইকেই ভাবায়– সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু একটি পরিবারের কান্না। আমরা প্রতিদিন করোনায় কতজনের মৃত্যু হলো সেটি নিয়ে অনেক আলোচনা করি। কিন্তু বাস্তবতা সত্য হলো, করোনার চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন উপলক্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি স্লোগান উল্লেখ করতে চাই। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চালাবেন না। ঘুম ঝিমুনি ভাব যখন আসে, গাড়ি চালাতে নেই তখন। ধূমপান যানবাহনে নিষিদ্ধ সবাই জানেন। জেব্রা ক্রসিং করলে ব্যবহার নিশ্চিত হবে নিরাপত্তা সবার, গতিসীমা মেনে চলি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি। রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী রাখবো না, যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবো না। ওভারলোড নেবো না। রাস্তার ক্ষতি করবো না। সেতু বা রাস্তার বাঁকে ওভারটেক করবো না। আইন মেনে সবাই চলি নিরাপদে ঘরে ফিরি। চালকের হাতে মোবাইল ফোন, মৃত্যুঝুঁকিতে সবার জীবন।

প্রিয় পাঠক, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে উপরে যে স্লোগানগুলো উল্লেখ করা হলো তার একটিও সড়কে সেভাবে গুরুত্ব পায় না। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি চালাবেন না- এটি এবারের জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান। কিন্তু সারা দেশে এই যে লক্ষ লক্ষ গাড়ি চলাচল করে সব গাড়ির কি বৈধ কাগজ আছে? খোঁজ করলে দেখা যাবে অনেক গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই। উপরন্তু ফিটনেসবিহীন অসংখ্য গাড়ি দেশের বিভিন্ন রাস্তায় প্রকাশ্যে চলাচল করে। কীভাবে সম্ভব? ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’ বলে একটি কথা আছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারণে সড়কে অবাধে চলাচল করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের গাড়িগুলোই সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ঘুম ঝিমুনি ভাব যখন গাড়ি চালাতে নেই তখন’। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই স্লোগানটি গুরুত্বসহ আলোচনার দাবি রাখে। প্রায় এক বছর আগে রাতের বাসে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যাচ্ছিলাম। বেশ জনপ্রিয় কোম্পানির বাস। যাত্রীতে পরিপূর্ণ। গাবতলী থেকে রাত সাড়ে ১০টায় বাস ছাড়লো।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা অতিক্রম করে বাস ছুটে চলছে চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রা মোড় পেরিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে বাস ছুটছে। হঠাৎ দেখি ড্রাইভার ঘুমে ঢুলছেন। ভয় পেয়ে বললাম ড্রাইভার সাহেব আপনি কি ঘুমাচ্ছেন? বাসের ড্রাইভার আমার প্রতি রুষ্ট হয়ে বললেন, ভাই ডিস্টার্ব করছেন কেন? এই রাস্তা আমার অনেক চেনা। চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালাতে পারবো। আর ডিস্টার্ব করবেন না। বলা বাহুল্য, বগুড়া পার হয়ে মহাস্থানগড়ের একটু সামনে বাসটি রাতের অন্ধকারে একটি প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের মৃত্যু।

জেব্রা ক্রসিং করলে ব্যবহার, নিশ্চিত হবে নিরাপত্তা সবার। এই স্লোগানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পথচারীদের অনেকে তা মানেন না। সামনেই হয়তো ওভারব্রিজ আছে। ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে ব্যস্ত সড়কে দৌড় দিয়ে পার হতে চায় অনেকে। ফলে প্রায়শই কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটে।

গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি। এই গুরুত্বপূর্ণ স্লোগানটি অনেক চালকই মানেন না। রাস্তা ফাঁকা পেলেই ইচ্ছেমতো গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। ভাবটা এমন, আকাশ উড়ে চলে যাবেন। বাইরের দেশে হাইওয়েতে গতিসীমা লঙ্ঘনকারী যানবাহনের জন্য তাৎক্ষণিক জরিমানা করার প্রযুক্তিগত কাঠামো আছে। চালক রাস্তায় নির্ধারিত গতিসীমা ভঙ্গ করলেই নির্দিষ্ট জরিমানা গুনতে হবে। আমাদের দেশে এই ধরনের কোনও নিয়ম না থাকায় হাইওয়েতে অধিকাংশ চালক বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটান।

 রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী রাখবো না, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবো না। সড়কে এই নিয়ম অনেকেই মানেন না। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনেকে ব্যস্ত রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী রেখে দেন। এর ফলে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়।

ওভার লোড নেবো না, রাস্তার ক্ষতি করবো না। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে এই স্লোগানটি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। একটি রাস্তারও জীবন আছে। কি পরিমাণ ভার রাস্তাটি বহন করতে পারবে তার নিরিখে যানবাহন, বিশেষ করে ট্রাকে পণ্য পরিবহনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সড়ক পথে এই নিয়ম মানা হয় না মোটেও। চলন্ত ট্রাকের চাপায় পিষ্ট মায়ের পেট চিড়ে শিশুর জন্মের সেই অলৌকিক কাহিনির ঘাতক ট্রাকটি ছিল ওভারলোড। দেশে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ওভারলোডেড ট্রাক। অথচ এই নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই।

সেতু বা রাস্তার বাঁকে ওভারটেক করবেন না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এই স্লোগানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারী যানবাহন চালকেরা এই বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চান না।

চালকের হাতে মোবাইল ফোন, মৃত্যুঝুঁকিতে সবার জীবন। এই স্লোগানটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারলেও কার্যত অধিকাংশ চালক এই সতর্কতাটি মানতে আগ্রহী নন। আবারও দূরপাল্লার একটি বাসের কথা উল্লেখ করি। রাতের বাসে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। ড্রাইভার মাঝে মাঝেই মোবাইলে কথা বলছিল। একটা সময় দেখলাম বাম ঘাড় উঁচু করে কানের সাথে মোবাইল জড়িয়ে নিয়ে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছেন। প্রতিবাদ করলাম। কাজ হলো না। ড্রাইভার মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ভাই আমার কাজ আমাকে করতে দেন তো। কথায় আছে, যার কাজ তারই সাজে অন্য লোকের লাঠি বাজে। বাসের ড্রাইভার জানেন কীভাবে বাস চালাতে হয়। তাই বলে কানের কাছে মোবাইল নিয়ে রাতের রাস্তায় বাস চালাবেন?

সীতাকুণ্ডের সেই মর্মান্তিক ঘটনাটির কথা মনে পড়ছে। বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরছিলেন পাঁচ ভাই। একটি পিকআপ ভ্যান তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় পাঁচ ভাইয়ের। চলন্ত ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মায়ের বুক চিড়ে জন্ম নেওয়ার সেই শিশুটির কথাও নিশ্চয়ই আমরা ভুলিনি। এরকম আরও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসহায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় ‘পাখির মতো’ মানুষ মারা যাচ্ছে। এভাবে আর কতদিন? সড়ক কবে নিরাপদ হবে মানুষের জন্য?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ