X
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫
২৪ বৈশাখ ১৪৩২

কীভাবে সংবিধান সংস্কার করা দরকার?

তাহসিন মাহমুদ
০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৩:৫৯আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৩:৫৯

সংবিধান আদালতের ঊর্ধ্বে। সংবিধানের মৌলিক বিষয় পরিবর্তন করার বিতর্কহীন উপায় হলো, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অনুমতি নিয়ে সংস্কারের এখতিয়ার পাওয়া একটি সংসদ এই সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আনবে। এরপর এই সংস্কারের প্রস্তাবগুলোকে জনগণের গণভোটের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে তারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে।

এই উপায়ের বাইরে অন্য কোনও উপায়ে, বা নির্বাহী আদেশে সংবিধানের মৌল কাঠামোর কোনও মৌলিক বিষয়ের সংস্কার করা হলে, সেটা আদালতের সংশোধনীর এখতিয়ারে চলে যায়। যেমনটা আমরা বেশ কিছু সংশোধনীর ক্ষেত্রে দেখেছি, যে আদালতের সিদ্ধান্তেই সেগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সংস্কারের এখতিয়ার আছে এমন পার্লামেন্টের সংসদ সদস্যরা- (যে পার্লামেন্টকে গণসংহতি আন্দোলন এবারে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ নামে ডাকতে চাইছে, এবং সেই হিসেবে আগামী নির্বাচন করতে বলছে)- যদি সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের কাঠামো পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন, এবং জনগণের গণভোটের মাধ্যমে সেই পরিবর্তনে সম্মতি নেন- তাহলে সেই মৌলিক বিষয়টাকে আবার আদালতের সংশোধনী আকারে পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না।

বরং আদালত একে তখন সুরক্ষা দেয়। কেবলমাত্র আবার নির্বাচিত কোনও সংবিধান পরিষদ/গণপরিষদ একে পরিবর্তন করতে পারে- তাও জনগণের গণভোটে সম্মতির সাপেক্ষে।

একারণেই যৌক্তিক দাবি হলো, সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করা এবং গণভোটের মাধ্যমে তাতে জনগণের সম্মতি নেওয়া। মানে, আগামী সংসদটাই হবে এই সংবিধান সংস্কার পরিষদ, যে সংসদের কিনা সংবিধান সংস্কারের আলোচনা করার এখতিয়ার আছে/ম্যান্ডেট আছে। এবং সংসদে সংস্কারের এই আলোচনার পর যে প্রস্তাবগুলো আসবে, তার কোনোটিতে গণভোটের সময় জনগণ সম্মতি না দিলে, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য একমত হলেও সেই প্রস্তাবটি গৃহীত হবে না।

এখন এই আগামী সংসদ তথা সংবিধান সংস্কার পরিষদ কোন সংস্কারগুলো অতি অবশ্যই করবে?

তারা ওই সংস্কারগুলো অবশ্যই অবশ্যই করবে যেসব বিষয়ে সংস্কারের বাধ্যবাধকতার কথা জুলাই চার্টার বা ন্যাশনাল চার্টারে উল্লেখ থাকবে এইভাবে যে, এই এই সংস্কারের ব্যাপারে দলগুলো একমত হয়েছে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই সংস্কার করার অঙ্গীকার করেছে। এবং এই সময়ের মধ্যে এই সংস্কারগুলো করার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে।

 

আর এই মুহূর্তে দলগুলো যেসব সংস্কারের বিষয়ে একমত নয়, সেই সংস্কারগুলো ক্ষমতায় এসে করবে বলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে জনমত গঠন করবে। জনগণ যে দলের প্রস্তাবে কনভিন্সড হবে তাকেই ভোট দিবে।

অর্থাৎ, জুলাই চার্টারের সংস্কারগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতেই হবে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন। এর বাইরের অন্য সংস্কারগুলো নির্ভর করবে একইসাথে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন ও গণভোটে পাস হওয়ার ওপর।

সংবিধান সংস্কার পরিষদ, সংসদে সংস্কার প্রস্তাব আনা ও গণভোট বিষয়ে এক এক করে আসি।

প্রথম প্রশ্ন, কেন এই সংবিধান সংস্কার পরিষদের দাবি? এমনিতে নর্মাল/রেগুলার সংসদ বা গণপরিষদই তো এটা করতে পারে!

উত্তর হলো-

১. না, রেগুলার সংসদ কেবল সংশোধনী আনতে পারে। মৌলিক বিষয় পাল্টাতে পারে না।

২. রেগুলার সংসদের জনগণের কাছ থেকে সংবিধান সংস্কারের ম্যান্ডেট নেওয়া থাকে না। কিন্তু সংবিধান সংস্কার পরিষদের এই ম্যান্ডেট নেওয়া থাকবে। অর্থাৎ সংবিধানের মৌলিক বিষয় পরিবর্তনের জন্য এই সংসদ আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অনুমতি নেবে। আর নির্বাচনের পর সংসদ থেকে আসা প্রস্তাব পাসের জন্যও গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমতি নেবে।

৩. গণপরিষদ এটা করতে পারে, কিন্তু গণপরিষদের প্রয়োজন হয় সংবিধান নতুন করে লেখার জন্য। বাংলাদেশের সংবিধান নতুন করে লেখার জন্য একটা রিপ্রেজেন্টেটিভ গণপরিষদের যে আকার-আকৃতি-কলেবর হতে হবে- সেটা এখনকার সময়ের জন্য অ্যারেঞ্জ করা প্রায় অসম্ভব এবং সময়সাপেক্ষ।

আরেকটা কথা হলো, সংবিধান নতুন করে লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদের আর কী কী এখতিয়ার থাকবে, গণপরিষদ সদস্যরা সংবিধান রচনা ছাড়া আর কোনও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবেন কিনা, করলেও কোনটা করবেন সেটা স্পষ্ট নয়।

তারপর, সম্পূর্ণ সংবিধান নতুন করে লেখার দায়িত্ব নিলে এই গণপরিষদ একইসাথে কীভাবে সরকার চালাবে সেটা স্পষ্ট নয়। তারপর কত সময়ের মধ্যে সংবিধান লেখার কাজ শেষ হবে এবং সেই সময়টুকু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব এই সংসদ কতটুকু পালন করবে- সেটা স্পষ্ট নয়।

৪. গণঅভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট ছিল সংবিধানসহ রাষ্ট্র সংস্কার। সেই সংস্কার কাজের সবকিছুই নির্বাহী আদেশে করা যাবে না। বিশেষত সংবিধানের মৌলিক বিষয়ের সংস্কার কোনোভাবেই নির্বাহী আদেশে বা রেগুলার সংসদ দিয়ে করা যাবে না।

 

সব মিলিয়ে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জায়গা থেকে- আগামী নির্বাচন সংবিধান সংস্কার পরিষদের নির্বাচন হিসেবে করাটাই হলো সবচেয়ে এফিশিয়েন্ট প্রস্তাব।

এই প্রস্তাব অনুযায়ী:

১. জুলাই গণঅভ্যুত্থান ম্যান্ডেট দিয়েছে সংবিধান সংস্কারের জন্য।

২. জুলাই চার্টার ম্যান্ডেট দিবে কত সময়ের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে অবশ্যই সংস্কার হবে- সেটা নির্ধারণের জন্য।

৩. সংবিধান সংস্কার পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ম্যান্ডেট দেবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলো আনার জন্য।

৪. গণভোটে জনগণের সম্মতি সংবিধান সংস্কার পরিষদের প্রস্তাবকে ম্যান্ডেট দেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য।

৫. আর এই ৪টা ম্যান্ডেটের মধ্য দিয়ে যেসব সংস্কার আনা হবে, সেটার সুরক্ষা দেবে আদালত। অন্তত ২, ৩ ও ৪ নম্বর ম্যান্ডেট দিয়েই কেবল আবার সংস্কার করা যাবে সেই সংবিধানের।

মোটকথা, শহীদের আত্মত্যাগে পাওয়া এই সংবিধান সংস্কারের সুযোগকে কাজে রূপান্তরিত করে, সেই সংস্কার করা সংবিধানটাকে একইসাথে ইতিহাস, আইন, আদালত ও জনগণের মাধ্যমে প্রোটেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যই এই প্রস্তাব- ‘আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদের নির্বাচন’।

আসেন নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন হই। সিরিয়াস বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি এবং আলাপগুলো ছড়িয়ে দেই।

লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ‘স্পষ্ট ও বাস্তব’, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ‘স্পষ্ট ও বাস্তব’, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
মহানির্বাণ
মহানির্বাণ
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
কক্সবাজার পৌর এলাকা থেকে দৈনিক ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে
কক্সবাজার পৌর এলাকা থেকে দৈনিক ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে
সর্বশেষসর্বাধিক