X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহামারির আগুনে ‘গুজবের ঘি’

মনিরা নাজমী জাহান
৩০ মার্চ ২০২০, ১৪:৩৬আপডেট : ০১ মে ২০২০, ১৩:৩১

মনিরা নাজমী জাহান ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি মহামারির সময় গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করার প্রমাণ আমরা পাই। একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখবো, একটি কুচক্রী মহল ইচ্ছাকৃত অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা একটি দেশে অথবা সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্বংস করার জন্য গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো সমাজে ছড়িয়ে থাকে। সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যান যথার্থই বলেছেন, ‘প্রতিটি গুজবেরই শ্রোতা থাকে।’
সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হলো, গুজব কী? কোন বিষয়টিকে আমরা গুজব নামে অভিহিত করবো? গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যানের মতে, গুজব বলতে সেই সমস্ত বিশ্বাসকে বোঝায় যে সমস্ত বিশ্বাস কোনও প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তা মানুষের কথার মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। তবে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই গুজব বিস্তারের মাধ্যমেও এসেছে পরিবর্তন। এখন মানুষের মুখে মুখে ছড়ানোর পরিবর্তে গুজবের মাধ্যম হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া।

এরপরে যে বিষয়গুলো আমাদের জানা প্রয়োজন তা হলো এই গুজব বিষয়টি কোনও বৈশিষ্ট্যের কারণে সমাজে এমন ভয়ানক ধ্বংসলীলা চালাতে পারে? কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই গুজব ছড়ানো হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রবন্ধগুলোর দিকে। 

মনোবিজ্ঞানী যমুনা প্রসাদ, যিনি উত্তর ভারতে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ার গুজবের বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণা শেষে মনোবিজ্ঞানী যমুনা প্রসাদ গুজবের উৎপত্তি ও সংক্রমণের বিষয়ে সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। সেই তত্ত্বে তিনি গুজবের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, যে বৈশিষ্ট্যগুলো সমাজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। তিনি এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন—

১. গুজবটি অবশ্যই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করবে।

২. গুজবটি একেবারেই অপরিচিত ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট হবে।

৩. গুজবে যে ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত দেখানো হবে তার অনেক বিষয় অজানা রাখা হবে।

৪. এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হবে, যা যাচাইযোগ্য নয়।

৫. কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য গুজবটি সমাজে ছড়ানো হবে।

আমরা যদি সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এই ঘটনাটি কেন্দ্র করে যেসব গুজব ছড়ানো হয়েছে, সেই গুজবগুলোর মধ্যেও উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান।

মনোবিজ্ঞানী রবার্ট এইচ ন্যাপ তার ‘সাইকোলজি অব রিউমার’ নামক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, গুজবকে কেন ছড়ানো হয় অথবা গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্য কী? তিনি ভ্রান্ত আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছড়ানো গুজবকে ৩টি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমটি হচ্ছে ‘পাইপ ড্রিম রিউমার’, অর্থাৎ যে শ্রেণির গুজব মূলত ছড়ানো হয় ভালো কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। এই শ্রেণির গুজবে গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি চান গুজবটি যেন সত্যি হয়। কারণ, এই ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে থাকে ভালো কোনও উদ্দেশ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান সময়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে থানকুনি পাতা খেলে করোনাভাইরাস মারা যায়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘বুগি রিউমার’, যেটা ছড়ানো হয় সমাজে আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্দেশ্যে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, করোনাভাইরাস নিয়ে অডিও ক্লিপের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রকারের গুজব ছড়ানোর দায়ে ইফতেখার মোহাম্মদ আদনানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সর্বশেষ প্রকার হচ্ছে ‘ওয়েজ ড্রাইভিং এগ্রেশন রিউমার’। মূলত এই প্রকার গুজব ছড়ানো হয় প্রতিপক্ষকে ক্ষতি বা ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে একটি বিভিন্ন ধর্মের গোত্রের কিছু মানুষ একে অপরকে দোষারোপ করছেন।

একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি মহামারি এবং বিপর্যয়ের সময় এই ধরনের গুজব ছড়ানো হয় এবং প্রতিটি মহামারিতে ছড়ানো গুজবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রায় একই ধরনের। যেসব কারণে মহামারির সময়ে গুজব ছড়ানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে নিজেকে জাহির করার মানসিকতা অর্থাৎ যে বা যিনি গুজব ছড়ান, তার উদ্দেশ্য থাকে সমাজের কাছে জাহির করা যে তার কাছে এমন তথ্য আছে, যার নাগাল চাইলেও কেউ পাবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সম্প্রতি ইউটিউবার ডানা অ্যাশলি তার পোস্ট করা ভিডিও মাধ্যমে এই গুজব ছড়ান যে চীনের উহান শহরে ফাইভজি মোবাইল প্রযুক্তি চালুর কারণে করোনা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য লক্ষ করা যায়, (যেসব গুজবে আতঙ্ক ছড়ানো হয়, সেসব গুজবের ক্ষেত্রে) গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি আসন্নও বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে গুজবটি সমাজে ছড়িয়ে দেয়। সর্বশেষ যে বিষয়টি দেখা যায় তা হলো গুজব ছড়ানো ব্যক্তিটি নিজেই আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে গুজবটি ছড়িয়ে ফেলে।

শুধু যে মহামারির সময় গুজব ছড়ানো হয় তা কিন্তু নয়; বরং কখনও কখনও একটি সংক্রামক ব্যাধি গুজব হওয়ার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক চার্লেস রোজেনবার্গ তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি সংক্রামক ব্যাধি মহামারি হওয়ার পেছনে গুজব কীভাবে কাজ করে।  তিনি দেখিয়েছেন তিনটি ধাপে মূলত এই কাজটি হয়। প্রথম ধাপে দেখা যায় মহামারিকে কেন্দ্র করে এক ধরনের উদাসীনতা সৃষ্টি করা হয় বা বিষয়টিকে হালকা করে দেখার প্রবণতা সৃষ্টি করা হয়। যেমনটি করা হয়েছে আমাদের দেশে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে ছড়ানো হয়েছে, এই ভাইরাসটি চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের যেহেতু চীনের সঙ্গে দূরত্ব অনেক, তাই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

যেহেতু একটি মহামারি খুব স্বাভাবিকভাবেই পুরো সমাজের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, তাই দ্বিতীয় ধাপে বোঝানো হয় যে এই মহামারির বিষয়টি দৈব বিষয় এবং এর সমাধানও দৈব সূত্রে পাওয়া যাবে। করোনা মহামারির সময় আমরা দেখেছি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, গোমূত্র পান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে প্রতারণা ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় ধাপে আরেকটি বিষয় ঘটে, তা হলো ধর্ম-বর্ণ জীবনযাত্রার ধরনকে কেন্দ্র করে পরস্পরকে দোষারোপ।  ১৪শ’ শতকে যখন প্লেগ ইউরোপে মহামারি আকার ধারণ তখন হঠাৎ ইহুদিদের দোষারোপ করা হয় যে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এই প্লেগ ছড়িয়েছে। সম্প্রতি করোনাকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি কখন বলা হচ্ছে বিশেষ ধর্ম আক্রান্ত হবে না, কখনও বলা হচ্ছে বিশেষ কারও খাদ্যাভ্যাসের কারণে হচ্ছে ইত্যাদি। এমনকি এখন আমেরিকা করোনাভাইরাসের জন্য চীনকে দোষারোপ করছে।

এই ধাপে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ঘটে, তা হলো অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। এই ধাপে কিছু ব্যবসায়ী মিথ্যা প্রচারণা বা মজুত করে বিশেষ কোনও দ্রব্যের দাম বাড়ানোর কূট চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারি আকার ধারণ করে তখন নির্দিষ্ট কিছু ওষুধকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সম্প্রতি আমরা দেখেছি করোনাভাইরাসের সময় মাস্ক, স্যানিটাইজারকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটতে।

সর্বশেষ ধাপে যেটি ঘটে তা হলো সরকার দ্বারা আরোপিত স্বাস্থ্য বিষয়ক নিয়মনীতিতে জনগণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যেমন বিদেশফেরতদের প্রবেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি অনেকেই বিভিন্ন কারণে স্বাস্থ্য বিষয়ক নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেননি। এমনকি অনেক দেশে যখন লকডাউন বা কারফিউ দেওয়া হয়েছে, তখন দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া মহামারির সময়ে সমাজের জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সর্বোপরি বলা যায় ইতিহাসের প্রাচীনকাল থেকেই গুজবের সঙ্গে মহামারির নিবিড় সম্পর্ক। একটি সংক্রামক ব্যাধি মহামারিতে পরিণত হওয়ার বিষয়ে গুজব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মহামারির সময় আতঙ্কিত না হলে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং মহামারি সংক্রান্ত যে কোনও খবর প্রচারের আগে চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অবশ্যম্ভাবীভাবে সত্য যে একা সরকারের পক্ষে মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের দায়িত্বশীল আচরণ পারে মহামারির ভয়াবহতা রুখে দিতে।

লেখক: শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
ধানক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে বুনো হাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
কোনও রান না দিয়ে ৭ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ইন্দোনেশিয়ার বোলারের বিশ্ব রেকর্ড
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
রাজধানীতে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীসহ নিহত ২
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
ঢামেক হাসপাতালে কারাবন্দীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ