X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সমাবেশের সঙ্গে ধর্মঘট ফ্রি

প্রভাষ আমিন
০৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:০৪আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:০৮

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। ধারাবাহিকভাবে বিভাগীয় সম্মেলনের মাধ্যমে রাজপথে শোডাউন করছে বিরোধী দল বিএনপি। ১০টি বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যে চারটি এরইমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সবসময় চাই, রাজনীতির জবাব যেন রাজনীতি দিয়েই দেওয়া হয়। রাজপথে বিএনপির শোডাউনের জবাব আওয়ামী লীগ রাজপথে শোডাউন দিয়েই দিচ্ছে। গত ২৯ অক্টোবর রংপুরে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ছিল। একই দিনে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে পুরনো বাণিজ্যমেলার মাঠে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে। দলের সম্মেলন সাধারণত কোনও ছোট জায়গায় করা হয়। কিন্তু রাজপথে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকেই জনসভায় রূপ দেয় আওয়ামী লীগ। এমনিতে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের দিন গণমাধ্যমের অনেকটা জুড়েই থাকে বিএনপির খবর। কিন্তু রংপুরে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের দিনেই ঢাকা জেলার সম্মেলন করে আওয়ামী লীগও সেদিন গণমাধ্যমে বড় ভাগ বসায়। রাজনীতির জন্য এটা শুভ বার্তা।

বিরোধী দলের সমাবেশের জবাব সরকারি দলও সমাবেশ দিয়েই দিচ্ছে, এটা ভালো লক্ষণ। দুই দলই জনগণের কাছে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবে। সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ দিয়ে বিএনপির এই দফার কর্মসূচি শেষ হবে। আর আগামী ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ, কর্মসূচি আরও বাড়বে। বিএনপির সমাবেশে যদি এক লাখ লোক আসে, আওয়ামী লীগ চেষ্টা করুক দুই লাখ লোকের সমাবেশ করতে। পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জনগণের ভোগান্তি হবে। তবে এটুকু দুর্ভোগ মেনে নিতে আমরা তৈরি। তারপরও রাজনীতিতে যেন আর আগুন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, হরতাল, অবরোধ ফিরে না আসে। রাজনীতি যেন সুস্থ ধারায়ই চলমান থাকে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতে বড় সংকটের মুখোমুখি। রাজনীতি যেন তা স্থবির করে না দেয়। সংকটের ঘোলাপানিতে যেন কেউ মাছ শিকারের সুযোগ না পায়।

সমাবেশের জবাব সমাবেশ দিয়েই দেওয়ার এই উদ্যোগের জন্য আওয়ামী লীগ অবশ্যই ধন্যবাদ পাবে। কিন্তু পুরো ধন্যবাদ তাদের দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, নিজেদের সমাবেশ বড় করার পাশাপাশি বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম ঠেকানোর অপকৌশলগুলোও চালিয়ে যাচ্ছে সরকারি দল। বিএনপি তাদের ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশের প্রথমটি অর্থাৎ ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পেলো গ্রাউন্ডে মোটামুটি নির্বিঘ্নে করতে পেরেছিল। তবে সেই সমাবেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর বিতর্কিত স্লোগান ও বক্তব্যে হারিয়ে গিয়েছিল সমাবেশের সাফল্য। তবে বিএনপির চট্টগ্রামের সমাবেশে লোকসমাগম দেখে টনক নড়ে সরকারি দলের। তারপর থেকেই বিএনপির সমাবেশে বাগড়া দেওয়ার কৌশল নিয়ে মাঠে নামে সরকারি দল।

ময়মনসিংহে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে লোক আটকানোর চেষ্টা হলেও এরপর আর কোনও লুকোছাপা করেনি। খুলনা আর রংপুরে সমাবেশের পথ ধরে এসেছে পরিবহন ধর্মঘট। ৫ নভেম্বর বরিশালে বিএনপির সমাবেশকে সামনে রেখেও একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি করছে সরকারি দল। এ যেন বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে পরিবহন ধর্মঘট ফ্রি। পরিবহন বিশেষজ্ঞ না হলেও এটা বলে দেওয়া যায়, বিএনপির আগামী বিভাগীয় সমাবেশগুলোর সঙ্গেও অবধারিতভাবে আসবে দুদিনের পরিবহন ধর্মঘট। অবশ্য বিএনপিও সরকারের কৌশলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে ভালোভাবেই। তারাও নির্ধারিত সময়ের আগেই সমাবেশস্থলে পৌঁছে যান।

অনেকে শুকনো খাবার, পলিথিন, চট নিয়ে সমাবেশে যোগ দিতে যান। সমাবেশের দুদিন আগে থেকেই তারা পৌঁছে যান শহরে। আগের রাত থেকেই সমাবেশস্থলে বা আশপাশে যেখানে পারেন শুয়ে বসে কাটিয়ে দেন সময়। বরিশালে এখন দুদিন আগে থেকে আবাসিক হোটেলে তল্লাশি, ছাত্রলীগের মহড়া দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।  

বিএনপির সমাবেশের সময়েই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা নিয়ে জনগণের সঙ্গে একটা চমৎকার ‘চোর-পুলিশ খেলা’ চলে। সবাই সবকিছু বোঝেন, দেখেন; কিন্তু ভান করেন যেন কিছুই হয়নি। বিএনপির সমাবেশের সময় হলেই সংশ্লিষ্ট জেলার পরিবহন মালিকদের নানা দাবির কথা মনে পড়ে। তারা বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে তারিখ মিলিয়ে ঠিকঠাক দুদিনের পরিবহন ধর্মঘট ডাকে। দাবি আদায় না হলেও বিএনপির সমাবেশ শেষেই ধর্মঘট শেষ হয়ে যায়। সবচেয়ে মজা হলো, মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি বন্ধের দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হলেও সেই ধর্মঘটে নছিমন করিমনও বন্ধ থাকে। পরিবহন ধর্মঘটে বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম হয়তো কিছুটা কম হয়। কিন্তু সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বিএনপি যে বিভাগে সমাবেশ ডাকে, সেই বিভাগের সবাই তো আর বিএনপি করে না। অনেকে আওয়ামী লীগও করে। রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পৃক্ততা নেই, এমন মানুষও থাকেন। কিন্তু দুর্ভোগ পোহাতে হয় সবাইকে। কত মানুষের পরীক্ষা থাকে, জরুরি কাজ থাকে, অসুখ-বিসুখ থাকে। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট সবাইকে ভোগায়। এমনিতে সরকারের দায়িত্ব হলো, সাধারণ মানুষের চলাচলের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা। কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু সরকারি দলের নেতারা নির্বিকারভাবে বলেন, পরিবহন নেতারা ধর্মঘট ডাকলে আমরা কী করবো।  কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে, পরিবহন ধর্মঘটের পক্ষে যুক্তি দেন, বিএনপির ভাঙচুরের ভয়ে পরিবহন মালিকরা গাড়ি চালান না। কিন্তু মজাটা হলো, পরিবহন মালিকরা কখনও এই যুক্তি দেন না। তারচেয়ে বড় কথা, এখন পর্যন্ত বিএনপির চারটি বিভাগীয় সমাবেশের কোথাও ভাঙচুর বা অঘটন ঘটেনি। সরকারি দলের নেতারা যদি ভাবেন, জনগণ বোকা, পরিবহন ধর্মঘটের পেছনে কারা সেটা তারা বোঝেন না, তাহলে বড় ভুল হবে।

এভাবে বাধা দিয়ে সরকারি দল আসলে বিএনপির আন্দোলনকে চাঙাই করছে। বাধার কারণে কিছু লোক হয়তো কম আসছে। কিন্তু যারা শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আসছে, তারা কিন্তু ফিরে যাচ্ছে তুঙ্গস্পর্শী আত্মবিশ্বাস আর অদম্য মনোবল নিয়ে। তারচেয়ে বড় কথা, নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে পারলে বিএনপি কাভারেজ পেতো একদিনের। আর সরকারি দলের বাধার কারণে মোটামুটি চারদিন আলোচনার কেন্দ্রে থাকছে বিএনপির সমাবেশ। সাধারণ মানুষের সহানুভূতিও পেয়ে যাচ্ছে তারা।

শুরুতে আওয়ামী লীগকে দেওয়া ধন্যবাদ কিছুটা ফিরিয়ে নিলেও পুরোটা নেওয়া যাচ্ছে না। কিছুটা ধন্যবাদ তারা পাবেন। বিএনপি এখন যেভাবে বিভাগে বিভাগে সমাবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে, একবছর আগেও সেটা অকল্পনীয় ছিল। সরকারের বিরুদ্ধে তারা কথাও বলতে পারছে মন খুলে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, আন্দোলনে বাধা দেওয়া হবে না। বিএনপির আন্দোলন বিএনপি করুক। তাদের সমাবেশ ছোট রেখে তো আওয়ামী লীগকে বড় করা যাবে না। আওয়ামী লীগ এমনিতেই বড় দল। আওয়ামী লীগ নিজেদের উন্নয়নের কথা বলুক, নিজেদের অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে থাকুক, জনগণের আরও কাছে থাকুক। রাজনীতির মোকাবিলা হোক রাজনীতি দিয়েই। তাতেই সবার মঙ্গল।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ