X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেজরিওয়ালের উন্নয়ন আর আমাদের ‘উন্নয়ন’

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:০৩আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:০৫

ডা. জাহেদ উর রহমান দিল্লি বিধান সভার এবারের নির্বাচনি প্রচারণা এবং এর ফলের একটা বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে বলে বিশ্বাস করি। বর্তমান পৃথিবীতে যেসব দেশে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ বা ‘পরিচয়বাদী রাজনীতি’র জোয়ার বইছে, তার মধ্যে ভারত একেবারে সামনের সারিতে। গণতান্ত্রিক ও অবাধ নির্বাচনি ব্যবস্থার মধ্য থেকেই এই রাজনীতির উত্থান হচ্ছে। এই রাজনীতি গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী নানা গণতান্ত্রিক দেশেই।
এই নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিজয় প্রমাণ করে সারা পৃথিবীতে ভয়ঙ্করভাবে প্রভাব রাখা ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্সে’র জোয়ারের বিপরীতে দাঁড়িয়েও নির্বাচনে জেতা যায় এবং সেজন্য হার্ডকোর আইডেন্টিটি পলিটিক্সের বিপরীতে কোনও সফট আইডেন্টিটি পলিটিক্স করারও দরকার হয় না। এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে আলাদাভাবে লিখবো। এই কলামে লিখছি এবারের দিল্লি নির্বাচনে ভীষণ আলোচিত ‘উন্নয়ন’ শব্দটি নিয়ে।

সাদা চোখে দেখতে গেলে দেখা যাবে, দিল্লির বহুল আলোচিত বিধান সভা নির্বাচনে উন্নয়ন জয়ী হয়েছে। বিজেপি তার সাম্প্রতিক কৌশল অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’-এর কার্ড দিল্লিতেও খেলতে চেয়েছিল। মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ভারতের বিখ্যাত ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ মতে, কেজরিওয়াল দিল্লির জন্য তার করা উন্নয়নকেই এই নির্বাচনে জনগণের কাছে ‘বিক্রি’ করেছেন। খুব সচেতনভাবে বিজেপির খেলা ধর্ম কার্ডের পাল্টা কার্ড খেলেননি।

নির্বাচনের পর অনেক এক্সিট পোল  ঘোষণা করেছিল—কেজরিওয়াল বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। সব এক্সিট পোল তাদের জরিপে যাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল তাদের জিজ্ঞেস করেছিল কেন তারা কেজরিওয়ালকে ভোট দিয়েছিলেন। সারা ভারতে বিজেপি যা করছে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা একটা ‘অ’প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে। প্রধান কারণ হিসেবে ভোটাররা উল্লেখ করেছেন, কেজরিওয়ালের গত পাঁচ বছরে নেওয়া নানা কর্মসূচির কথা।

দিল্লির সব বাসিন্দার সুবিধার্থে মাসে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, ২০ হাজার লিটার পর্যন্ত পানি ফ্রি করে দিয়েছেন। কেজরিওয়াল নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নারীদের জন্য সরকারি বাস ভ্রমণ ফ্রি করেছেন। মেট্রোরেলেও তেমনই করতে চেয়েছিলেন। মেট্রো কর্তৃপক্ষের বাধায় পারেননি। দিল্লিতে বাসে ‘নির্ভয়া’র বিভৎস ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সরকারি বাসে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মার্শাল নিয়োগ দিয়েছেন। রাস্তায় রাস্তায় সিসিটিভি বসিয়েছেন।

রাজ্য সরকারি হাসপাতালে অনেক ডাক্তার নিয়োগ দিয়েছেন, সেবার মান বাড়িয়েছেন। বাড়িয়েছেন বেডের সংখ্যাও। মহল্লায় মহল্লায় ক্লিনিক খুলে চিকিৎসা পরিষেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন। এগুলোয় একেবারে বিনা খরচে ওষুধসহ চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই মহল্লা ক্লিনিকগুলো জনগণের কাছে কেন্দ্র সরকারের আয়ুষ্মান হেল্থ কার্ডের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী বলে মনে হয়েছে। এসবের পাশাপাশি তিনি নজর দিয়েছেন সরকারি স্কুলগুলোর দিকে। অতিশি মারলেনার পরিচালনায় দিল্লির স্কুলে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলগুলোয় শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঘরে বসে মানুষ যেন বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা পেতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দালালদের দৌরাত্ম্য প্রায় বন্ধ করে দিতে পেরেছেন।

‘উন্নয়ন’ শব্দটি বর্তমান বাংলাদেশেও সবচেয়ে বহুলশ্রুত শব্দগুলোর একটি। কোনও সরকার যদি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকে, তাহলে সেই সরকারকে কোনও একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে হয় ক্ষমতায় থাকার যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য। বর্তমান সরকারের সেই ন্যারেটিভ হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। যেটা নানা কালে নানা দেশে এই ধরনের সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে দেশে দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাহীনতা, মৌলিক মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, এমনকি নির্বাচন ব্যবস্থার অগ্রহণযোগ্যতা সব আলোচনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে উন্নয়নের গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে।

আমাদের দেশের উন্নয়নের একটা ধরন আছে। দীর্ঘকাল থেকেই বর্তমান সরকারের একটা প্রবণতা হচ্ছে খুব বড় বড় কিছু ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করে সেগুলোকে উন্নয়ন হিসেবে দেখানো।  এটার মানেই কি উন্নয়ন? মোটেও না। কিন্তু এই ধরনের সরকার এটাকেই উন্নয়ন হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে চায় দুটি কারণে। ‘অ’প্রধান কারণটি হলো—এই উন্নয়ন চোখে দেখা যায়; বিরাট সব ভৌত অবকাঠামো দেখে মানুষ মোহিত হয়। কিন্তু প্রধান কারণটা হলো–এই উন্নয়ন থেকে ইচ্ছেমতো দুর্নীতি করা যায়। বাংলাদেশের এমন সব মেগা প্রজেক্ট করতে গিয়ে যৌক্তিক ব্যয়ের ৪/৫ গুণ বেশি খরচ করে দুর্নীতির খবর এখন আমাদের খুবই গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই কারণেই এই দেশের বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে শিক্ষা, চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রগুলোয় সরকারের বরাদ্দ প্রয়োজনীয় বরাদ্দের তুলনায় অনেক কম। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বরাদ্দের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এই দুই ক্ষেত্রে বরাদ্দ জিডিপির শতাংশ হারে প্রতি বছর কমছে। অথচ দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উন্নয়নে এই দুটি ক্ষেত্র খুব গুরুত্ব পেয়েছিল। এই দুটি ক্ষেত্রে অর্থব্যয় জনগণকে একেবারে সরাসরি সুবিধা দেয়। তেমনি বিনা পয়সায় পানি-বিদ্যুৎ দেওয়া, সরকারি বাসে নারীদের ফ্রি ভ্রমণের সুযোগ দেশের দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেকটা সহজ এবং নিরাপদ করে তোলে। দেশের চিকিৎসা সেবা কিংবা শিক্ষার উন্নয়ন, কিংবা জনগণকে বিদ্যুৎ-পানির একটা ন্যূনতম পরিমাণ ফ্রি দেওয়া মানে কি উন্নয়ন নয় তাহলে?

আসলে এসব প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সরকারের যে বাজেট খরচ হয়, সেটা সরাসরি খরচ হয় রাজস্ব বাজেট থেকে। সেবা খাতে সরকারি কর্মীদের বেতন এবং জনগণকে ইউটিলিটির জন্য দেওয়া ভর্তুকির টাকা সরাসরি তার টার্গেটের কাছে পৌঁছে যায় বলে এই টাকায় দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। ওদিকে প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় করা যায় খুব সহজে।

কেজরিওয়াল নির্বাচনে জেতার পথে খুব বড় ভূমিকা রেখেছে জনগণ বিশেষ করে নারীদের জন্য শহরকে নিরাপদ করতে নেওয়া নানা পদক্ষেপ। এটাও কি উন্নয়ন না? তিনি তার রাজ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দালালিসহ নানা রকম দুর্নীতির পথ বন্ধ করেছেন কঠোর হাতে। এটাও কি উন্নয়ন নয়? অনেকে বলবেন, না। আসলে এটাও উন্নয়ন, খুব গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন। শ্রদ্ধেয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’ বইতে মানবজীবনের নানা ডাইমেনশন উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করে উন্নয়নের সংজ্ঞায়ন করেছেন। ভৌত অবকাঠামো আর কিছু অর্থনৈতিক উন্নতিকে উন্নয়ন বলে সংজ্ঞায়ন করা পৃথিবীতে বাতিল হয়েছে বেশ আগেই। ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’-এর আলোকে উন্নয়ন প্রসঙ্গে একটা বিস্তারিত লেখা লিখবো মিগগিরই।

কেজরিওয়াল তার রাজ্যে যা যা করেছেন, সেটাকে একবাক্যে বলা যায়, তিনি একটা ওয়েলফেয়ার স্টেইটের আদলে তার রাজ্যটিকে গড়তে চান। দিল্লি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, ভারতের রাজ্য, এমনকি তার রাজ্যটির ক্ষমতা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের  চেয়ে কিছু কিছু দিক থেকে আরও কম। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই মানুষটি চেষ্টা করেছেন।

একটি রাজনৈতিক দল কী করলে জনগণের মন জিতে নিতে পারে, এমনকি ধর্মভিত্তিক প্রচণ্ড পরিচয়বাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করতে পারে, তার একটি অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করলেন কেজরিওয়াল। তবে, এই আলোচনা সেই রাষ্ট্রেই প্রযোজ্য, যে রাষ্ট্রের জনগণের হাতে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার গঠন করার ক্ষমতা আছে। সেই বিবেচনায় এই কলামটি এই দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে হয়তো অর্থহীন।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমএনইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাগেরহাটে কৃষককে পিটিকে হত্যা
বাগেরহাটে কৃষককে পিটিকে হত্যা
একসঙ্গে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
একসঙ্গে ৭৩ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
চীনে রুপা জিতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুকান্ত ও নয়ন
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ