X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
১৭ এপ্রিল ২০২০, ১৪:২৭আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২০, ১৪:২৮

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল পালন করা হয়। আজ সমগ্র বিশ্ব করোনাভাইরাসের সংক্রমণে শঙ্কিত। বাংলাদেশেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে। তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে জনসমাগম বন্ধ করা হয়েছে। সারাদেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সংকটময় সময়ে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মতো মুজিবনগর দিবস পালনও সীমিত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে ও বিদেশে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
আশা করি, বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনার এই দুর্যোগ অতিক্রম করতে সক্ষম হবে।
বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম আর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি পায় স্বাধীন রাষ্ট্র, আমাদের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন আর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা শপথগ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, এসবই এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা।

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। মার্চের ৩০ তারিখে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লিতে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী এমএনএ এবং এমপি এদের নিয়ে একটি গোপন স্থানে অধিবেশন আহ্বান করেন। এরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাঁদের ওই অধিবেশনের আইনগত ভিত্তি ছিল। এরাই গণপরিষদ গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অধিবেশনে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যও নিযুক্ত করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ওই দিনই (১০ এপ্রিল) তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। এভাবে ১০ এপ্রিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এদিনই  মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক হয় এবং এরপর প্রতিদিনই তারা সভায় মিলিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং উপস্থিত জনগণের সামনে মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ করেন। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১১ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা ১৪ এপিল প্রকাশ্যে শপথগ্রহণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রবল বোমাবর্ষণ করে। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে।

অন্যান্য প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ তৈরি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি। শপথগ্রহণের স্থান গোপন রেখে সাংবাদিকদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে সবই ঠিক ঠিক সম্পন্ন করেছিলেন বাংলাদেশের অকুতোভয় দেশপ্রেমিক সৈনিকরা। যার ধারাবাহিকতায় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল।

সেদিন ছিল শনিবার। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া পাহারায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালির উপচে পড়া ভিড় চারদিকে। ঐতিহাসিক স্বাধীনতার মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬টি চেয়ার। অনুষ্ঠানের প্রবেশ পথে বাংলায় লেখা ‘স্বাগতম’।

স্থানীয় সময় ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাঁর পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান ও জেনারেল এম এ জি ওসমানী।

অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, গিতা ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিবর্গ ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথগ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের রাষ্ট্রীয় কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। পাক শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই ঘোষণা করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের মন্ত্রিসভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। শপথগ্রহণের পর পরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিলো। …পৃথিবীর মানচিত্রে আজ নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো এবং তা চিরদিন থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যা করছি সবই শেখ মুজিবের নির্দেশে। তবে তিনি কোথায় আছেন বলবো না।’ আরও বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।…স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোনও জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।’

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। তিনি জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল, সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তার সঙ্গে আমাদের চিন্তার যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম, বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাকিস্তানি বাহিনী বলুক, এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ, আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি তা অস্বীকার করে; তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি, তিনি দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তখন হানাদাররা বলে বসবে, তিনি বন্দি আছেন।

এ অনুষ্ঠান থেকে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।

আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা/জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি স্লোগান। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়। অনুষ্ঠানের পর কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সংবাদ পরিবেশন করেন।

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুদ্রিত রয়েছে। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের ভিত্তি। মুজিবনগরে বাংলাদেশের এই প্রথম সরকার গঠনের প্রাক্কালে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল তার ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান”।

ঘোষণাপত্রের নবম অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য, সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং উহা দ্বারা পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।”

ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘এতদ্বারা আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নে ক্ষমতার অধিকারী।

ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের মাটিতে বসেই। নতুন সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম স্থান পায়। এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ও দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি নয় মাস মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে মহামূল্যবান বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র যুদ্ধ আর আত্মত্যাগে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান দখল করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। তাই ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার ধারাবাহিকতায় গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক সরকার বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘ্নে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এ সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায়, কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন-কাঠামো। এই সরকারের বৈশিষ্ট্য ছিল যে কলকাতায় অবস্থান করলেও এর কর্তৃত্ব গোটা বাংলাদেশেই ছিল, বিশেষ করে মুক্ত এলাকায় (রৌমারি, বেলোনিয়া ইত্যাদি)। আওয়ামী লীগের মতাদর্শ এবং নির্বাচনি ঘোষণা (Manifesto) অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল সংসদীয় পদ্ধতির। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করতে মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে বহু প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করতে হয়েছিল। মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রায় দুই সপ্তাহ পরই পাকিস্তানি বাহিনী মুজিবনগরে আক্রমণ চালায়। এ জন্য মুজিবনগর প্রশাসনকে সুবিধাজনক মুক্তাঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সব কাজকর্ম বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের নামেই পরিচালিত হতো। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় যুদ্ধের ক্যাম্প অফিস হিসেবে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি ব্যবহৃত হয়। মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথগ্রহণের পর ১৮ এপ্রিল প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের দফতর বণ্টন করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত হয়।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, অনেকে ইচ্ছাকৃত এটাকে অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার বলার চেষ্টা করেন। মূলত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’-এর ঘোষণাপত্র পাঠের সময় থেকে তা কার্যকর হয় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর থেকে।’ এই সরকার হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মুজিবনগর বললে সে সরকারের গণ্ডিকে খাটো করা হয় এবং একাত্তরের ২৬ মার্চ জনযুদ্ধ শুরুর পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হওয়ার আগে অনেক এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে অথবা সেগুলো মুক্ত এলাকা ছিল। তাই প্রবাসী সরকার বলাও ঠিক নয়’।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসটি বাঙালি জাতির জীবনের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই সরকারই বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার। এই সরকার গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিচালনা করেছে দীর্ঘ নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সব কর্মকাণ্ডের যোগসূত্র হচ্ছে মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ