X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তামাকের পক্ষ-বিপক্ষ

মো. তৌহিদ হোসেন
০৩ জুন ২০২০, ১৩:০৩আপডেট : ১৮ জুন ২০২০, ১৫:৪৮

মো. তৌহিদ হোসেন ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপে তামাক আসে আমেরিকা থেকে। আমেরিকার আদিবাসীরা তামাক পাতা মুড়িয়ে সিগার বানিয়ে ধূমপান করতেন, পাইপের ব্যবহারও ছিল। ইউরোপ থেকে যে জাহাজগুলো যেতো এই নব ‘আবিষ্কৃত’ ভূখণ্ডে, তার নাবিকরাই প্রথম কৌতূহল থেকে তাদের অনুকরণে ধূমপান শুরু করেন এবং পরে নিয়ে আসেন ইউরোপে। প্রথম প্রথম অভিজাত এবং ধনিক শ্রেণির বিলাসিতা হিসেবে প্রচলন হয় ধূমপানের। উচ্চ সমাজের পুরুষদের মাঝে নস্যি গ্রহণও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কালক্রমে ধূমপান অন্যান্য শ্রেণির মাঝেও বিস্তার লাভ করে। শুরুতে এটাকে একটা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস হিসেবে মনে করা হতো। তবে আসলে যে তা নয়, বরং উল্টোটা, কিছুকাল পর সেটা জানা হয়ে যায়। তাতে করে অবশ্য তামাকের ব্যবহার কমেনি, বরং বেড়েই গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এর কারণ প্রধানত দুটো। এক, এটা অনেকটা নির্দোষ একটা নেশা হিসেবে পরিচিতি পায়, যাতে সামাজিক তেমন কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয় না (স্বাস্থ্য খাতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তখনও ততটা প্রচার লাভ করেনি)। দুই, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সরকার তামাকজাত পণ্য থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করে। তামাক আসার আগে ইউরোপ এবং এশিয়ায় ধূমপানে গাঁজার প্রচলন ছিল।  

তামাক ব্যবহারের কুফল নিয়ে বিশ্বব্যাপী একধরনের ঐকমত্য আছে, ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলনও আছে। সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হয়েছে অনেকদিন। এখন তো সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ভয়ংকর ছবিও ব্যবহার করা হয়। কোভিড-১৯ মহামারিতে একটা বড় উপসর্গ নিউমোনিয়া হয়ে শ্বাসকষ্ট, যা প্রায়শই মৃত্যুর কারণ হয়। যাদের ফুসফুস দুর্বল, যেমন হাঁপানি রোগীরা, কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর আশঙ্কা তাদের তুলনামূলকভাবে বেশি। ধূমপানে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস। সে হিসেবে একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায় অধূমপায়ী একজনের তুলনায়।

এই বিবেচনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তামাকজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন ও বিক্রয় সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ১৯ মে তারিখের এক চিঠিতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে এই অনুরোধ জানায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন, তাই তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করা প্রয়োজন, চিঠিতে এ কথাও উল্লেখ করা হয়। এর আগে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান  সাবের হোসেন চৌধুরী এই নিষেধাজ্ঞা কামনা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছিলেন। তামাকবিরোধী বিশটি সংগঠনও এপ্রিল মাসে কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষিতে তামাকজাত পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার দাবি জানিয়েছে।

উত্তরে তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। তিনি বলেছেন এই খাতের ব্যবসা সরকারি নিয়ম মেনে পালিত হচ্ছে, এবং সরকার তা থেকে রাজস্ব পাচ্ছে। তাছাড়া এর সঙ্গে বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক চাষি এবং শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত। শিল্প মন্ত্রণালয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলেছে। ধূমপান বন্ধে মোটিভেশনই গুরুত্বপূর্ণ, হঠাৎ উৎপাদন বন্ধ করে দিলেই ধূমপান বন্ধ হবে না। বরং এতে চোরাচালান বাড়বে এবং দেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্যের সঙ্গে অবশ্য শিল্প মন্ত্রণালয় একমত হয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বিষয়েও সমর্থন ব্যক্ত করেছে।

দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যেই যুক্তি আছে অনেক। জনস্বাস্থ্যের ওপর তামাকের বিরূপ প্রভাব নিয়ে দ্বিমতের কোনও সুযোগ নেই। তামাকের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে প্রতিদিন ৫০০ লোকের মৃত্যু হয়। তবে আইন করে তামাকের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে এমন যারা ভাবেন তারা কোনও উদাহরণ দেখাতে পারবেন বলে মনে হয় না। নিঃসন্দেহে এ ব্যাপারে মোটিভেশনই একমাত্র উপায়। আইন প্রয়োজন আছে, তবে তা শুধু এই মোটিভেশনের সহায়ক হিসেবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে একেবারে যে অগ্রগতি হচ্ছে না তাও নয়। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮.৫% কমেছে।  

যারা ধূমপান করেন না তাদের আশেপাশে অনেক ধূমপায়ীকে নির্লিপ্তভাবে তাদের অভ্যাস চালিয়ে যেতে দেখা যায়। অন্যের অসুবিধাকে গুরুত্ব দিতে হলে যতটা সভ্য হওয়া লাগে, আমাদের সমাজ তার অনেকটাই পেছনে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ থেকে ধূমপানের অভ্যাস সম্পূর্ণ দূরীভূত হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমার মতো অধূমপায়ীরা সবাই প্রীত হবেন। তবে ২০৪০ সালের মধ্যে, অথবা কখনোই এ লক্ষ্য অর্জন নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এখানে মানবিকের ছাত্র হয়ে বিজ্ঞান নিয়ে একটু অনধিকারচর্চা করি। কথাগুলো আমার নয়, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি দেশের একজন শীর্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, তার কাছ থেকে ধার করা।

সমাজের ৪০% মানুষ কোনও না কোনও নেশায় আসক্ত (মদ, সিগারেট, গাঁজা, আফিম বা অন্য কোনও নারকোটিক ড্রাগ)। এ আসক্তি বিভিন্ন পর্যায়ের হতে পারে, সবাইকে চরম আসক্ত হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। এর মাঝে সমাজভেদে কমবেশি শতকরা ১০ ভাগ মানুষ জিনগত কারণে নেশাগ্রস্ত, বাকিরা সামাজিক বা পরিবেশগত কারণে। জিনগত কারণে যে ১০% মানুষ নেশাসক্ত তাদেরকে নেশা থেকে পুরোপুরি দূরে রাখা সম্ভব নয়। কোনও না কোনও নেশাদ্রব্য তারা ব্যবহার করবেনই। যদি একটি দ্রব্য বাজার থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, এই নেশাসক্তরা তার বিকল্প নেশা খুঁজে নেবেন। একটু পেছনে তাকালেই এ তত্ত্বের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। 

সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা ছাড়াও আরেকটি কাজ করেছিলেন, তা হলো ‘মৃতসঞ্জীবনী সুরা’ নামক একটি আয়ুর্বেদীয় ওষুধ নিষিদ্ধ করা। নামে ওষুধ হলেও, অ্যালকোহলের উচ্চমাত্রার কারণে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে মৃতসঞ্জীবনী সুরা মদ হিসেবেই ব্যবহৃত হতো দীর্ঘকাল ধরে। বিত্তবানদের জন্য ‘স্বাস্থ্যগত কারণে’ মদ্যপান আইনত সিদ্ধ ছিল। নতুন আইনে সমস্যায় পড়লেন স্বল্পবিত্তরা। তারিখ মিলিয়ে দেখতে পারেন, ঠিক এই সময়টাতেই ভারত থেকে চোরাপথে ফেনসিডিল এসে সয়লাব করে দিলো বাংলাদেশের বাজার। মৃতসঞ্জীবনী সেবন করতেন যারা, তাদের অনেকেরই বিকল্প হলো এই মারাত্মক মাদক। বিষাক্ত স্পিরিট খেয়ে মাঝে মধ্যেই মৃত্যুর খবর তো আছেই।

প্রকৃতিতে যেমন, তেমনি বাজারেও কোনও শূন্যস্থান থাকে না। চাহিদা আছে এমন একটি সামগ্রী সরে গেলে আরেকটি এসে তার স্থান দখল করে নেয়। ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অষ্টাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১.৫% এর বেশি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় নিষিদ্ধ করা হয়। ফল দাঁড়ায় বিভিন্ন স্থানে চোরাই মদের বেআইনি কারখানা আর ব্যাপক চোরাচালান। অবশেষে ১৯৩৩ সালে একবিংশ সংশোধনীর মাধ্যমে অষ্টাদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়। পার্শ্ববর্তী ভারতে মদ অনেক সহজলভ্য, সেখানে তাই ফেনসিডিল বা ইয়াবার বাজার সৃষ্টি হয়নি।

দীর্ঘকাল প্রচলিত কোনও ক্ষতিকর জিনিস নিষিদ্ধ করার আগে চিন্তা করতে হবে এর স্থান কে দখল করবে। রোগের চেয়ে ওষুধ যেন বেশি বিপজ্জনক হয়ে না ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।

লেখক: প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ