X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

প্রসঙ্গ পৌরসভা নির্বাচন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৫ নভেম্বর ২০১৫, ১৯:১৬আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ১৬:৫৪

Ishtiaque Rezaআরও একটি স্থানীয় নির্বাচন, আবারও প্রান্তিক পর্যায়ে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ। পৌরসভা নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গা-ঝাড়া দিয়ে উঠছে। এবার উত্তাপ অন্যরকম। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে মেয়র নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উষ্ণতা ছুঁতে শুরু করেছে জাতীয় রাজনীতিকেও। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৩৪টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ হবে ৩০ ডিসেম্বর।

স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রস্তুতির দিক থেকে কিছুটা এগিয়ে। বিএনপি-জামায়াত জোটও দু-এক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানিয়েছে।

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের অবসান ঘটিয়ে দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে পৌরসভার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনের বিধান রেখে ২ নভেম্বর স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০১৫-এ সংশোধনী এনে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করেন। পরে এ সংক্রান্ত বিলটি জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন এতদিন না হলেও, কাগজে-কলমে অরাজনৈতিক থাকলেও বাস্তবে বাংলাদেশে স্থানীয় নির্বাচন দলীয় রাজনীতিমুক্ত ছিল না। শুধু প্রতীকটিই থাকত নির্দলীয়, বাকি সবই ঘটত রাজনৈতিক দলের নামে। দলগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দিত, প্রচারকার্য চালানো হতো কার্যত দলীয় পরিচয়েই, এমনকি মিডিয়া যে ফলাফল ঘোষণা করত, তা-ও হতো দলীয় পরিচয়ের বিবেচনাতেই।  

দলীয়ভাবে পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ নির্বাচনি প্রতিযোগিতা শুরু হবে। বিএনপি দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্তকে সরকারের দুরভিসন্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও দলটি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেবে এমন আভাসই দিচ্ছে। এটি শুভ লক্ষণ। নিবন্ধিত সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই তা হবে অর্থবহ।

শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা ছাড়াও এখানে বাস করা মানুষের জন্ম নিবন্ধন, নাগরিত্ব সনদসহ কত সেবাই না দিতে হয় পৌর চেয়ারম্যানকে। গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মূলত পরিচালিত হয়ে থাকে এদের দ্বারাই। কিন্তু চেয়ারম্যানকে প্রতিটি কাজে যদি এমপি’র কাছে জবাবদিহি করতে হয় কিংবা এমপি’র দেহাই দিয়ে জেলা প্রশাসক যদি খবরদারি করেন,  তাহলে তাকে যারা নির্বাচিত করেছে তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা হয় না।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের বিরুদ্ধের যে অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি অস্বস্তির তা হলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নির্বাচন বর্জন, প্রতিহত করার সহিংস চেষ্টার মধ্যে সে নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন দেড়শরও বেশি সদস্য। সেই অস্বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে এই পৌরসভা নির্বাচন হতে পারে সরকারি দলের জন্য একটি বড় সুযোগ। সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার আহ্বান আসছে নানা স্তর থেকে, যা বিবেচনা করা হবে বলেই আশা করছে সবাই।

বিএনপি জামাতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পৌরসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দল ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কাদের নিয়ে নির্বাচন করবে, সে প্রশ্ন তারা তুলছে। প্রকৃত অপরাধীদের সাথে রাজনৈতিক কর্মীকে মেলানোর সুযোগ যেমন রাজনৈতিক দলের নেই, তেমনি নেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও। যাদের রাজনৈতিক কারণে বা ছোটখাটো অপরাধে আটক করা হয়েছে, তাদের জামিনের ব্যবস্থা করলে আশা করতে পারি বিএনপি জোটের মধ্যে নির্বাচনের আগ্রহ বাড়বে।  

পৌরসভা হল স্থানীয় সরকারের একটি অন্যতম প্রতিষ্ঠান। এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে তার একটি সুদুরপ্রসারী ইতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব আগামীতে আমরা দেখতে পাব।

নির্বাচন হবে, নতুন মেয়র আর কাউন্সিলররা আসবেন। দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থানীয় সরকার কতটা গুরুত্ব পাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। খবরের কাগজে আমরা প্রায়ই পড়ছি যে স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্যদের দাপটে দিশেহারা অবস্থায় থাকেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা। এটি একটি মনস্তত্ব যা কেন্দ্রীয় রাজনীতিকদের দীক্ষা দেয় প্রান্তকে উপেক্ষা করার, প্রান্তিক রাজনীতিকে পরাধীন করে রাখার। সাংসদ নিজেও প্রান্তের মানুষ। কিন্তু নিজেকে তিনি কেন্দ্রের ভাবতেই পছন্দ করেন। অনেকটা জাত্যাভিমান, অনেকটা হলো সবকিছু দখলে রাখার মানসিকতা। আর কেন্দ্রীয় রাজনীতির এই মানসিকতার পুরোপুরি সুযোগ নেয় আমলাতন্ত্র। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে আমলারা উপেক্ষা করতে শেখে সংসদ সদস্যদের এই মানসিকতার কারণেই।  

কেন্দ্রীয় রাজনীতি, কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের আধিপত্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই এখন অকার্যকর। মানুষ ভোট দেয় ঠিকই। কিন্তু তারাও মনে করে সব কিছুর ‘মালিক’ এমপি, ডিসি আর এসপি, ইউএনও।

জনগণের অনেক প্রয়োজন, প্রতিদিনের প্রয়োজনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিই তাদের কাছের মানুষ। তাদের শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা ছাড়াও এখানে বাস করা মানুষের জন্ম নিবন্ধন, নাগরিত্ব সনদসহ কত সেবাই না দিতে হয় পৌর চেয়ারম্যানকে। উপজেলা পরিষদ বা পৌরসভা দেশের অন্যতম দুটি গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার। মেট্রোপলিটান শহরের বাইরের শহর ও গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মূলত পরিচালিত হয়ে থাকে এদের দ্বারাই। কিন্তু চেয়ারম্যানকে প্রতিটি কাজে যদি এমপি’র কাছে জবাবদিহি করতে হয় কিংবা এমপি’র দেহাই দিয়ে জেলা প্রশাসক যদি খবরদারি করেন,  তাহলে তাকে যারা নির্বাচিত করেছে তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা হয় না।

অনেকে মনে করছেন, সংসদ সদস্য ও উচ্চপর্যায়ের আমলাদের একটি অশুভ আঁতাত তৈরি হয়েছে এবং এই আঁতাত উপজেলা চেয়ারম্যান ও অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করতে চাচ্ছে। এ অবস্থা গড়াবে পৌরসভা পর্যন্ত। ঢাকঢোল পিটিয়ে স্থানীয় নির্বাচন হবে, অথচ তাদের ওপর খবরদারি করবেন অন্যরা বা দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক জিইয়ে রাখা হবে, এমন মানসিকতায় স্থানীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

একটা কথা হয়তো আমলাতন্ত্র এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতির চরিত্র বুঝতে চায় না যে কেন্দ্রীয় সরকারের মতো স্থানীয় সরকারও সরকার। তাদের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং ভূমিকা আইন দ্বারা নির্ধারিত। এই নির্ধারিত ভূমিকার ভিত্তিতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারার কথা। তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের সম্পর্ক নিকট ও প্রত্যক্ষ। জনসাধারণের প্রয়োজন মেটায় এমন অনেক কাজ করার দায়িত্ব তাদের এবং ক্ষমতাও সেই অনুযায়ী অর্পিত। স্থানীয় সরকারের কাজের পরিধি সীমিত হওয়ার জন্য এসব কাজে অধিক মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সেই আচরণ বা আন্তরিকতা যদি তারা দেখাতে পারেন তবেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সেবা দিতে পারবে জনগণের এসব প্রতিষ্ঠান।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক