X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লোভের দৌড়ের বিষণ্নতা

তুষার আবদুল্লাহ
০৬ মার্চ ২০২১, ১২:৩০আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২১, ১২:৩০

তুষার আবদুল্লাহ গণমাধ্যমের বিষণ্নতা নিয়ে যখন অবয়বপত্রে কথা চলছে, তখন ব্যাংকে কর্মরত এক ছোট ভাই লিখলো, ভাই ব্যাংকাররাও বিষণ্নতায় ভুগছে। আমার এই অনুজ ভাইটির গণমাধ্যমে কিছু সময় যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা আছে। ওর কাছে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দিন যেতে হয়েছে ব্যক্তিগত কাজে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছে ও। দুই দিন কফি এবং একদিন দুপুরের খাবারের সময়ে দেখলাম প্রাণবন্ত ভাইটি আদতে প্রাণ হারিয়ে বসে আছে। উচ্ছ্লতা নেই। বিচলিত, বিষণ্নতার বোতলে বন্দী যেন ও। কিছু জানতে চাইনি। নিজে থেকেই বলছিল, ব্যবসা দেন ভাই। না হলে চাকরি থাকবে না। বাঁচবো না। বছরের যে টার্গেট ধরিয়ে দিয়েছে, সেটা পূরণ করতে না পারলে রক্ষা নেই। ওই ব্যাংকে ওর আরও সহকর্মীদের সঙ্গেও দীর্ঘ সময় কথা হয়েছে, তারাও কেমন এক অবসাদে ডুবে আছেন। অন্য দুই ছোট বোনের কথা বলি। ওরাও ব্যাংকে কাজ করছে, ঋণ দেওয়া-নেওয়া, আমানত সংগ্রহের সঙ্গে ওদের সরাসরি যোগাযোগ নেই। কিন্তু তারপরও ওদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে টার্গেট। আমানত সংগ্রহ করতে হবে মোটা অংকের না হলে চাকরি বাঁচবে না। ওদের ব্যাংকের একটা অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছিল দিন কয়েক আগে। কিছুক্ষণ ছিলাম। সেই সময়ের মধ্যেই ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য শীর্ষ কর্তাদের বিষণ্নতা, অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো। তারাও দমবন্ধ অবস্থায় আছেন। টার্গেট নামের বিস্কুট দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন তারা। আমার এক বান্ধবী লিজিং কোম্পানিতে কাজ করে। একটি শাখার কর্তা। টার্গেট গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকেও। ও আবার সেই টার্গেট চাপিয়ে দিয়েছে অধস্তনদের ওপর। তারাও মাঠে বেপরোয়া আমানত সংগ্রহে। সেই দলের একটি মেয়ে চাকরি বাঁচাতে আমানত সংগ্রহে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, তার সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে একটি সংস্কৃতমনা প্রতিষ্ঠান থেকেও মেয়েটির কাছে অনৈতিক প্রস্তাব আসে। মেয়েটি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। নতুন চাকরির অসংখ্য প্রস্তাব ঝুলে আছে ওর সামনে কিন্তু আতঙ্কে কোনোটাকেই কবুল বলতে পারছে না।

সাধারণত কফিশালায় বসে দল বেঁধে আড্ডা দেওয়ার অভ্যাস নেই। মাঝে মধ্যে এক দুই জনের সঙ্গে গিয়ে বসি। তাও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নয়। পক্ষকাল আগে এমনই এক প্রয়োজনে এক কফিশালায় বসতে হয়। এক পাশে গিয়ে বসলেও ধীরে ধীরে পরিচিত, স্বল্প পরিচিত অপরিচিতদের বড় এক বৃত্ত তৈরি হয়। আড্ডা জমে ওঠে। কফির পেয়ালায়  ধোঁয়া উড়ছিল, কিন্তু আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা নিজেদের বাস্পিত করছে। এদের মধ্যে শিল্প গোষ্ঠীর বড় কর্তা, বিপণন ও বিজ্ঞাপন, টেলিকম প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা, সদ্য যোগ দেওয়া নবিস, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সকলেই ছিলেন। কিন্তু কেউ যেন কফি’র পেয়ালায় সুখের চুমুকটি দিতে পারছেন না।

সবাই টার্গেটের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের খেলোয়াড়। বেসরকারি খাতে যারা আছেন, তাদের ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বেচা বিক্রি, উৎপাদন ও মানুষ ভুলিয়ে আমানত আনার টার্গেট। সরকারি কর্মচারীদের টার্গেটের ভিন্নতা আছে। তাদের আছে আনুগত্য প্রকাশ, দুর্নীতি, অন্যায় সইয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা। ইচ্ছে করলেও প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই। কারো বিরুদ্ধে অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেনেও  চুপ করে থাকতে হচ্ছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যায় কাজটি করে দিতে হচ্ছে। এই যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া এগুলো করপোরেট দুনিয়ার নব্য সালতানাতের কৌশল। দাস শোষণের ‘অ্যাপস’ বলা যেতে পারে। সত্যি তারা এক প্রকার অ্যাপস এনে বসিয়েও দিয়েছে। যেখানে মানব এই রোবটের প্রতি মুহূর্তের কাজের হিসেব উঠে যাচ্ছে। সপ্তাহ বা মাস শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে কোথাও সতর্কতা আবার কোথাও একেবারে বহিস্কার। তাই মানব রোবটগুলো এখন আর মস্তিস্ক দিয়ে কাজ করে না। কেমন এক গাণিতিক সূত্রের মাঝে নিজেদের মনহীন দেহটাকে সঁপে দিয়েছে। আখের মতো সেখান থেকে রস বের করে নিচ্ছে মনিব। সরকারি চাকরি যারা করছেন, তারাও এক সহমতের অ্যাপসে লগইন করে বসে আছেন। মন প্রাণ নেই। সফটওয়্যার যেভাবে চালাচ্ছে সেভাবেই চলছে। এভাবে ‘নিজের সব বেচে দাও’  নামের যে ক্যারিয়ার বা কাজ, সেখানে ভালোবাসা নেই। মেশিন থেকে ভুট্টার মতো বেরিয়ে আসা টাকাও এক সময় বিস্বাদ বা অপ্রয়োজনীয় কাগজের মতো লাগে। সেই সময়টা যখন আসে, তখন বুঝে নিতে হবে আমরা বিষণ্নতায় ভুগছি। আমাদের চারপাশের বিভিন্ন পেশার মানুষদের অনুভূতি সেই রকমই– রোজগার করছি। ভোগ করছি। কিন্তু সেই ভোগ যেন কোনও মানুষ করছে না। করছে কোনও যন্ত্র।

মানুষ বা তাদের মনিবেরা ভাবছে প্রযুক্তি সভ্যতা দিয়ে মুনাফার নির্বান লাভ করবেন তারা। তাদের এই ভাবনা মানব সভ্যতা বা মানবকূলের আত্মহনন। শুধুই মুনাফা, আরো মুনাফা, দৌড় আরো দৌড়ের অ্যাপস আগে বুকে বেঁধে নিয়েছিল যারা, ক্রমশ তারা বিষণ্নতার সমুদ্রে প্রাণহীন দেহ নিয়ে ভেসে গেছে।  জীবনে বেঁচে থাকা কেন? সেই উত্তর ভুলে গেছে তারা। এত এত মুনাফা কার জন্যে, সেই উত্তর খুঁজে পায়নি। দৌড়ের শেষ প্রান্তে এসে দেখে সব পাওয়ার পরেও মুঠোতে এক বিশাল শূন্যতা, যা বইবার শক্তি তাদের নেই। এদের একটি অংশ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এই প্রবণতা আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে। আমরা কতটা, কতটা জানি না। দৌড়ে টিকতে না পেরে কিংবা দৌড় শেষ করে শূন্যতার গহ্বর দেখে কেউ কেউ আর জীবন বয়ে নিতে পারছিল না বা পারছে না। এমন এক বিষণ্নকালে আমরা প্রবেশ করছি, বা করে ফেলেছি যা আত্মহননেরই নামান্তর। এখান থেকে, এই বিষণ্নকাল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, আমাদের লোভের বোতল ভূত থেকে মুক্তি পেতে হবে। লোভ, অতি আকাঙ্ক্ষা এবং অসংযমী জীবনই আমাদের হাতছানি দেয় ‘সব বেচে দাও’ অ্যাপসের গ্রাহক হওয়ার। যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমরা বিষণ্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। মনে পড়ে, আশির  দশকের শেষে একটি ওষুধ কোম্পানি টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতো, বিষণ্নতা একটি রোগ। আমরা বিজ্ঞাপন দেখে হাসতাম, এ আবার কেমন রোগ? এখন বুঝতে পারছি রোগটি কেমন। ওই পোকা খেয়ে নেওয়ার মতো মন ও শরীর নিয়ে বেঁচে আছি।

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ