X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবার ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ করলেন কিশোর, করলাম আমরাও

ডা. জাহেদ উর রহমান
১০ মার্চ ২০২১, ১৮:২৪আপডেট : ১০ মার্চ ২০২১, ১৮:৩৪

ডা. জাহেদ উর রহমান
কার্টুনিস্ট কিশোর কি অকল্পনীয় রকম ভালো অভিনেতা? আটক হওয়ার পরের পরিস্থিতি প্রথম আলো অফিসে বর্ণনা করার সময় কিশোর কি কান্নার অভিনয় করছিলেন? সময় পেরিয়ে যায়নি খুব বেশি, আবার বিপুল পরিমাণ ‘শাক’ দিয়ে ঢেকে ফেলা যায়নি এই ‘মাছ’টা, তাই এখনও একেবারে তরতাজা আমাদের স্মৃতি, আবেগ।

এক ফোঁটা অশ্রু, ক্রন্দনরত একটি মুখ হয়ে গেলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। ভেতরটা একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার জন্য ছবিটার দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয় না, একটিমাত্র পলকই যথেষ্ট। এমন একটি ছবি নিয়ে কিশোরের অভিনয় প্রতিভার কথা কেন আসছে, সেটা স্পষ্ট হবে এই কলামের পরের অংশে।

কার্টুনিস্ট কিশোর শুধু গ্রেফতার হননি, তার ভাষ্যমতে তিনি ‘গুম’‌ও ছিলেন ৬৯ ঘণ্টা, অর্থাৎ প্রায় তিন দিন। এই দেশে গুম হয়ে যাওয়া মানুষ বহু ক্ষেত্রেই আর ফিরে আসে না। কখনও কখনও কোনও সৌভাগ্যবানের হয়তো ফিরে আসা হয়, কিন্তু ফিরে আসার পর সেই মানুষগুলো হয়ে যায় একেবারে নিশ্চুপ। হবারই কথা।

এই প্রবণতার একটা ব্যতিক্রম আমরা দেখতে পেলাম যখন সাংবাদিক কাজল মুক্ত হলেন। তার গুম থাকার সময় এটা নিয়ে খুব বিস্তারিত কিছু না বললেও তার একটি মন্তব্য আমাদের কাছে পরিস্থিতিকে খুব সহজে বুঝিয়ে দেয়। সেই সময়টা নিয়ে‌ আরও কিছু তথ্যের সাথে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক পত্রিকাকে তিনি বলেছিলেন – ‘মনে হচ্ছিল যেন আমি একটা কবরের ভেতরে আছি।’

সেই ঘটনার পর কিশোর ফিরে এলেন আমাদের মাঝে, খুব বিস্তারিত জানালেন গুম থাকার সময়টায় ঠিক কী হয়েছিল তার সাথে। এত বিস্তারিত বয়ান আমরা আর শুনিনি। এই বয়ানের সাথে সামনে থাকা ছবিটি যুক্ত হয়ে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। কিন্তু সেই নির্যাতনের বয়ান কি সত্যি ছিল? সেটি যদি মিথ্যা হয় তবে কিশোর তো অভিনয় করেছিলেন। সেজন্যই শুরুতে প্রশ্ন করেছিলাম, কিশোর কি অভিনয় করেছিলেন? কিশোর মিথ্যা বলছে, সেটা আমি বলিনি, বলেছে র‌্যাব।

কিশোর জানিয়েছেন তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ২০২০ সালের ২ মে। আর ৫ মে তুলে নিয়ে যাওয়া অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাকে র‌্যাব হেফাজতে দিয়ে আসে। মাঝের ৬৯ ঘণ্টা, কিশোরের ভাষ্যমতে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার ওপর চলে বর্বর অত্যাচার। কিন্তু মামলার এজাহার অনুযায়ী, কাকরাইলের বাসা থেকে ৫ মে বেলা আড়াইটায় র‌্যাব–৩ তাঁকে গ্রেফতার করে।

তাহলে কিশোর যে বলছেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাকে ২ মে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা কি মিথ্যে? র‌্যাব অন্তত সেটাই বলছে। বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ কিশোরের বক্তব্য প্রকাশকারী একটি পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে যেকোনও বক্তব্য দিতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কার্টুনিস্ট কিশোরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। গত বছরের মে মাসে গ্রেফতারের পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। এত পরে এমন অভিযোগ উঠলে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থাকে।’

সরকার বলবে র‌্যাব সত্য বলছে না– সেটা তো হতে পারে না। অর্থাৎ অসত্য বলছেন কিশোর। অজ্ঞাতনামা মানুষ, যারা কিশোরকে তুলে নিয়েছেন, তাদের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তাতে তাদের অন্তত ৪ জনের হাতে ছোট অস্ত্র দেখেছেন। এই দেশে সন্ধ্যাবেলা ১৬/১৭ জন সশস্ত্র মানুষ একজন মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া মানে এরা কোনও না কোনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, যারা পরবর্তীতে তাকে বর্বর নির্যাতন করেছে বলে তার অভিযোগ।

ওদিকে আবার তার বয়ান র‌্যাবের এজাহারে বলা গ্রেফতারের ঘটনার সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ তিনি দেশের ‘এলিট’ বাহিনীটিকে মিথ্যা এজাহার দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করছেন; এক ভয়ংকর অভিযোগ নিঃসন্দেহে। এই অভিযোগ ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শুধু সেটাই না, আমরা, নেটিজেনরা সেই রিপোর্ট, কিশোরের ছবি ইচ্ছেমত শেয়ার করেছি আমাদের ফেসবুক থেকে।

কিশোর সংবাদমাধ্যমকে যা বলেছেন তার মাধ্যমে তিনি এবং সেই বক্তব্য ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ করে তার পক্ষে লিখে আমরা সবাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বড় অপরাধ করছি।

দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান র‌্যাবকে প্রকারান্তরে মিথ্যেবাদী বলে এবং অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে তার ওপরে শারীরিক নির্যাতনের ‘মিথ্যা’ অভিযোগ করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর ২৫(১) এবং ৩১(১) ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছেন। ধারা দু’টো এরকম

২৫। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে,-

(খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণু করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

৩১। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন‌‌ চলমান‌ আছে। কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর থেকেই এই আন্দোলন যথেষ্ট দানা বেঁধেছে। নিশ্চিতভাবেই ৩১(১) ধারার ‘অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়’ এর অধীনে খুবই গর্হিত অপরাধ হিসেবে দেখা যায়। এমনকি যখন কিশোরদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তখন বরং রাস্তায় কোনও রকম আন্দোলন বা প্রতিবাদ ছিল না। সেই তুলনায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিশোরের এই সব ‘মিথ্যে’ দাবি বর্তমান ‘বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা’য় ঘৃতাহুতি। সুতরাং এটা অনেক বড় অপরাধ।

আমরা যারা কিশোরের বক্তব্যসহ সংবাদের লিংক কিংবা ছবি প্রচার করছি, তারা নিশ্চিতভাবেই কিশোরের করা অপরাধে সহায়তা করছি, তাই আমাদের জন্য প্রযোজ্য আছে নিচের ধারাটি -

৩৫। (১) যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

এখানে উল্লেখ্য, গত বছরের মে মাসে কিশোর-মুশতাক দিদারুলসহ আরও ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় উল্লেখ করা ধারাগুলো ছিল ২১, ২৫(১)খ, ৩১(১), ৩৫(১)‌। তাহলে ২১ ধারাটিও একটু দেখে নেওয়া যাক।

২১। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদত প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

স্বাধীনতার চেতনা বায়বীয় কোনও বিষয় নয়; স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনা এটাকে একেবারে স্পষ্ট করে দেয়। কিন্তু প্রপাগান্ডা মেশিন সরকারি বয়ানের বাইরে যেকোনও কিছুকেই স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী বানিয়ে দেয়। তাই যেসব কর্মকাণ্ড ঘটছে সেসবকে খুব সহজেই স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী আখ্যা দেওয়াই যায়, যেমন দেওয়া হয়েছিল কিশোরদের বিরুদ্ধে দেওয়া মামলায়।

আমরা স্মরণ রাখবো গত বছর কিশোর-মুশতাক-দিদারুলদের বিরুদ্ধে দেওয়া এজাহারে মামলা দেওয়ার মূল কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল– ‘আসামিদের উদ্দেশ্য ছিল অপপ্রচার বা মিথ্যা জানা সত্ত্বেও গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো’।

এটাই যদি তাদের মূল অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে এখন কিশোর যা করছেন, আমরা যা করছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংজ্ঞায় সেটা কি অনেক বেশি বড় অপরাধ নয়? আর এই দেশে সরকারের কোনও সমালোচনা করা যায় না;‌ ক্ষমতাসীনদের কাছে সরকারের সমালোচনা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহ। অর্থাৎ এতক্ষণ যে ‘অপরাধ’ এর কথা বললাম, সেটাকে অবলীলায় বলে দেওয়া যাবে রাষ্ট্রদ্রোহ।

হ্যাঁ, এটাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেটার মাধ্যমে আপনি যে‌কোন‌ও সময় যে কাউকে চাইলেই নিপীড়ন করতে পারেন।‌ এবং সেই কাজটি করা হবে আইনের শাসনের নামে।

‘আইনের শাসন’ কথাটি খুব শোনা যায় ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে। এটা শুধু এই সরকার না, যখনই যে সরকার থাকে তারাই এই ভাষাটি ব্যবহার করে। এমনকি আইনের শাসন নিশ্চিত করা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়, কারণ আইনটি কেমন সেই প্রশ্ন‌ও জরুরি। ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এর শাসন‌ও আইনের শাসন, কিন্তু সেটা কোনোভাবেই আমাদের সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে যেতে পারে না।

বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে বাতিল করে একদম নতুনভাবে একটা ‘সভ্য’ আইন বানানো হলেও হয়রানি এই দেশে বন্ধ হয়ে যাবে না, এটা আমি জানি। আইন কারা, কেন, কীভাবে প্রয়োগ করে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই আলাপ শুরুর প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য ডিজিটাল মাধ্যমের জন্য এখনই একটি ‘সভ্য’ আইন তৈরি করা অত্যাবশ্যক।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ