X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার লজ্জা পাওয়া উচিত

রেজানুর রহমান
১১ মে ২০২১, ১৫:৪৯আপডেট : ১১ মে ২০২১, ১৫:৪৯

রেজানুর রহমান পাছে না আমাদের অবস্থা ‘বাঘ এলো বাঘ এলো...’ গল্পের মতো হয়ে যায়। বাঘ এলো, বাঘ এলো গল্পে দুষ্টু রাখাল বালক তামাশা করার জন্য হঠাৎ একদিন গ্রামবাসীর উদ্দেশে ভয়ার্ত চিৎকার শুরু করে দেয়– কে কোথায় আছো, জলদি আসো, গ্রামে বাঘ এসেছে। রাখাল বালককে বাঁচানোর জন্য গ্রামের মানুষ যে যেখানে ছিল সেখান থেকে ‘পড়িমরি’ করে ছুটে আসে। বাঘ কোথায়, বাঘ কোথায় বলে রাখাল বালককে প্রশ্ন করতে শুরু করে। রাখাল বালক তখন হি হি করে হাসে। মিথ্যা কথা বলে গ্রামের সবাইকে ঘরের বাইরে বের করতে পেরেছে এটাই যেন তার আনন্দ। এভাবে আরও কয়েকদিন গ্রামবাসীকে ঘরের বাইরে ডেকে আনে রাখাল বালক। ফলে গ্রামবাসী আস্থা হারায় তার ওপর। রাখাল বালককে মিথ্যুক হিসেবে ধরে নেয়। একদিন গ্রামে ঠিকই বাঘ আসে। এবার রাখাল বালক প্রাণ বাঁচাতে আগের চেয়ে আরও করুণভাবে চিৎকার শুরু করে দিলেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করে না এবং তাকে বাঁচাতে এগিয়েও আসে না। বাঘের আক্রমণে করুণ মৃত্যু হয় রাখাল বালকের!

আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতিও অনেকটা রাখাল বালকের সেই গল্পের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাখাল বালক মিথ্যা মিথ্যা বাঘের গল্প ফেঁদেছিল। গ্রামের লোকজন তার কথায় বিশ্বাস করে তাকে বাঁচাতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু গ্রামের মানুষ যখন বুঝতে পারে রাখাল বালক প্রাণ হরণকারী একটা কঠিন বিষয় নিয়ে মজা করছে, তখন তাকে আর কেউ বিশ্বাস করে না। তবে করোনার বেলায় গল্পটা একটু অন্যরকম। পরিবেশ, পরিস্থিতি বলছে করোনা যেকোনও মুহূর্তে সারাদেশে মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। কাজেই বাংলাদেশও ভারতের মতো একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে। অথচ দেশের মানুষ যেন এই বাস্তবতা মেনে নিতে নারাজ। সরকার বারবার সতর্ক করে দিচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং দেশবাসীকে অনুরোধ করে বলেছেন, এবারের ঈদটা যে যেখানে আছেন সেখানে থেকেই উদযাপন করুন। প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে সতর্কবাণী প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? গণপরিবহন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বিকল্প উপায়ে যে যেভাবে পারছে রাজধানী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সারাদেশে লকডাউন কর্মসূচি বহাল রয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল এবার ঈদযাত্রায় ট্রেনের ছাদ ও লঞ্চে উপচে পড়া সেই করুণ ছবি হয়তো দেখা যাবে না। কিন্তু এবার অতীতের তুলনায় আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ট্রেন বন্ধ থাকায় ট্রেনের ছাদের সেই ঐতিহাসিক ছবি নেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে ফেরিযোগে নদীতে পারাপারের জন্য হাজার হাজার মানুষের ঈদযাত্রার লড়াই দেখে মনের আতঙ্ক দূর হচ্ছে না। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাটে ঘরমুখো হাজার হাজার মানুষ ফেরিতে ওঠার জন্য একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে অথবা জড়িয়ে ধরে প্রাণপণ লড়াই করছে। এই ভয়াবহ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি ভিডিওতে দেখলাম ফেরি সবেমাত্র ঘাটে এসে ভিড়েছে। ব্যস শুরু হলো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কে আগে ফেরিতে উঠবে তার প্রতিযোগিতা। একজন অন্যজনকে ধাক্কা দিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রশি বেয়ে কমান্ডো স্টাইলে ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করছে অনেকে। ফেরিতে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি পরিবেশ। এই দৃশ্য দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন রসিকতা করে লিখেছেন, ‘করোনার যদি ন্যূনতম লজ্জা থাকে তাহলে এখনই বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়া উচিত।’ আরেকজন সিরিয়াস ভঙ্গিতে লিখেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঈদে কেন বাড়ি যেতে হবে কেউ বলবেন দয়া করে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘দোকানপাট বাজারঘাট সব থাকবে খোলা, শুধু বাড়ি যাওয়ার বেলায় করোনার ভয়। মানুষ ভয় পাবে কেন?’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘যেভাবে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন, পরে হাসপাতালের সিরিয়াল আর অক্সিজেন না পেলে সরকারকে দুষবেন। মানুষ হবেন কবে?’

হ্যাঁ, এটাই বোধকরি কোটি টাকার প্রশ্ন। মানুষ হবেন কবে? বছরের দুটি ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, পারিবারিক মহামিলনের উপলক্ষও বটে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা শহরে এমন অনেক মানুষ বাস করেন যারা বছরে ওই একবার অথবা দু’বার ঈদের ছুটিতে গ্রামে বাবা-মা অথবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে যায়। ফেরিঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য লড়াই করছিল এমন কয়েকজনের সাক্ষাৎকার দেখলাম একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। একজন বললেন, গ্রামে আমার স্ত্রী, বাবা-মা ভাইবোন থাকে। ঈদের ছুটিতে বছরে একবার তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। দেশে লকডাউন চলছে। কিন্তু আমার তো মন টিকছে না। ঢাকায় একা একা ঈদ করা সম্ভব নয়। তাই গ্রামে যাচ্ছি। অন্য একজন ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, করোনা আমার চাকরি কেড়ে নিয়েছে। কাজেই ঢাকায় থেকে কি করবো? গ্রামের বাড়িতে যেতে পারলে ঈদের দিনটা তো আনন্দের সঙ্গে কাটাতে পারবো!

সাধারণ মানুষের এসব যুক্তি একেবারেই উপেক্ষা করার মতো নয়। কিন্তু বর্তমান অস্থির সময়টাকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। পাশের দেশ ভারতে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎসব ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের নামে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে তুমুল জনসমাবেশ করার খেসারত দিচ্ছে ভারত। ঈদযাত্রার ভয়াবহ পরিবেশ দেখে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্টের করোনা খুবই বিপজ্জনক। সহজেই মানব দেহকে কাবু করে। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে বলে স্বয়ং স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে। এই যে ঈদযাত্রায় গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে এত মানুষ গ্রামে গেলো, একজনের দেহেও যদি করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত করে থাকে তাহলে সেটাই হবে ভয়াবহ দুশ্চিন্তার বিষয়। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মানুষ গ্রামে গেছে ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য। ছুটি শেষে আবার গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করেই রাজধানীতে ফিরতে শুরু করবে। এবার স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করা জরুরি। তা না হলে হেলাফেলায় মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হবে।

লেখাটি শেষ করার আগে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে চাই। লকডাউনে তো ফেরি পারাপার বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু ফেরি চালু থাকলো কোন যুক্তিতে? সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকার কথা। অথচ দেশের অনেক স্থানে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। এটা কীভাবে সম্ভব? সবকিছু খোলা রেখে মানুষকে ঘরে বসে থাকার কথা বললে তো কেউই মানবে না।

যারা এখনও করোনার ভয়াবহতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তাদের উদ্দেশে বলি, আপনারা ভুল করছেন। পাশের দেশ ভারতের মানুষ এমনটাই ভুল করেছিল বলে এখন তার খেসারত দিচ্ছে। কাজেই আমাদের একটু সাবধান হওয়া উচিত। ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। এবাড়ি ও বাড়ি সম্পর্ক আমাদের। কোনও কারণে পাশের বাড়ি আক্রান্ত হলে নিজের বাড়িকে নিরাপদ রাখা খুবই কষ্টকর। এজন্য এ বাড়ির মানুষদের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ করার মানসিকতা জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, করোনা মোকাবিলায় আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সেই পরিবেশ দেখা যাচ্ছে না। বরং করোনা নিয়ে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলেছেন। নেগেটিভ মানসিকতার ভিডিও বানিয়ে অনেকে ফেসবুকে বাহাবা নিচ্ছেন। একটি ভিডিওতে দেখলাম, একজন বেশ গর্বের ভঙ্গিতে বলছেন, আমার বাপের গোষ্ঠী, নানার গোষ্ঠী এমনকি আমার পরিচিত কারও করোনা হয় নাই। কাজেই আমি করোনায় বিশ্বাস করি না। মাস্ক পরবো কি মরার জন্য? এই ধরনের ভিডিও বানানোর অর্থ কী?

আবারও সেই বাঘ এলো, বাঘ এলো গল্পটার কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। রাখাল বালকের মতো করোনা নিয়ে রসিকতা করবেন না। এমনও হতে পারে এই রসিকতাই একদিন আপনার জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়াবে। সেদিনই বুঝবেন কি ভুলটা করেছেন।

প্রিয় পাঠক, পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা নিন। ঈদ মোবারক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘বিএনপি বিরোধিতা করলেও তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’
‘বিএনপি বিরোধিতা করলেও তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে’
পেনাল্টি নিয়ে বিবাদ, চেলসি কোচ যা বললেন
পেনাল্টি নিয়ে বিবাদ, চেলসি কোচ যা বললেন
লিটারে ১০ টাকা বাড়লো সয়াবিন তেলের দাম
লিটারে ১০ টাকা বাড়লো সয়াবিন তেলের দাম
কোপেনহেগেনের ঐতিহাসিক স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনে আগুন
কোপেনহেগেনের ঐতিহাসিক স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ