X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: টুকলিফাই ঈদ ও ট্রেন্ডি মৃত্যু আতঙ্ক

মাকসুদুল হক
১৬ মে ২০২১, ১২:১৮আপডেট : ১৬ মে ২০২১, ১৮:৫৩

মাকসুদুল হক ভয় মৃত্যুকে প্রতিরোধ করে না। ভয় জীবনকে প্রতিরোধ করে। - গৌতম বুদ্ধ

মহামারির ঈদের দিনটা সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর মতোই কেটে গেলো। বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও ভক্তকুলের হাজারো ঈদের শুভেচ্ছা এলো মেসেঞ্জার, ইমেইল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে। খুবই ভালো কথা, তবে ঈদ নিয়ে সবাই এতই ব্যস্ত যে দুই কলম ‘ঈদ মোবারক’ লেখার সময় মনে হলো অনেকেরই নেই– তাই ‘ডিজিটাল গ্রিটিং কার্ড’ একমাত্র ভরসা। যে সময়টুকু  ‘ঈদ মোবারক’ লিখতে লাগে তা ‘নষ্ট’ না করে ১০টা ডিজিটাল কার্ড ‘ফরওয়ার্ড’ করে পাঠানো সম্ভব এবং তাতেই ল্যাঠা চুকে যায়- এ হলো ‘ট্রেন্ডি’ মানসিকতা। একই নকশার গ্রিটিং কার্ড অন্তত কয়েকশ’ পেয়েছি - অর্থাৎ যে কার্ডটি নিজে পেয়েছি সেটাই অন্যদের পাঠিয়ে দিচ্ছি... ডিজিটাল যুগে এটাই ‘ঈদের আনন্দ বিলিয়ে দেওয়া’... বাহ!

এক স্বনামধন্য গায়িকা অনুরূপ এক কার্ড আমার ওয়ালে সেঁটে দিলেন। অবাক হয়ে দেখলাম সেটা এক ব্যাংক-এর কার্ড ও প্রেরকের নামও সেখানে ছাপা– শিল্পীর নয়। কৌতূহলবশত প্রশ্ন করলাম ‘কার্ড কি তুমি আমাকে পাঠিয়েছ নাকি এই অপরিচিত ব্যাংকার?’ সম্ভবত বিব্রত হয়ে পোস্টটা ডিলিট করে ফেললেন! যাক... কিছু মানুষের লজ্জা-শরম এখনও আছে দেখে প্রীত হলাম।

এই ডিজিটাল যুগে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় খুব ‘স্মার্ট’ হলেও একেবারে নিখাদ টাটকা না- কেমন জানি বাসি-বাসি ঠেকে। নতুনত্বের প্রয়াস বা তার চর্চা আদতে আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে। তার বদলে এসেছে ‘কপি পেস্ট’ বা ‘ফরওয়ার্ড’ করার আধুনিকতা নামের চৌর্যবৃত্তি। ‘টুকলিফাই’ শব্দটা আগামীতে বাংলা অভিধানে নিজের যথাযোগ্য ‘সম্মানের স্থান’ করে নেবে, তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

তবে একটা দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। এই ডিজিটাল ‘অনলাইন’ শিক্ষার যুগে টুকলিফাই সংস্কৃতি যদি ‘ভাইরাল’ হয়ে যায় (বা ইতোমধ্যে হয়ে থাকলে) ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি দুরবস্থা হবে তা চিন্তা করার কি সময় এসেছে? আমরা যেখানে এতটাই ব্যস্ত যে ‘ঈদ মোবারক’ লেখার সময় পাই না–আমাদের সন্তানাদিদের পড়ালেখার কি অবস্থা তা খোঁজ-খবর রাখছি তো?

এসব কার্যক্রম আন্তরিকতা-বহির্ভূত তা কেবল নয়, ডিজিটাল শুভেচ্ছা আমাকে আনন্দ দেয় নাকি বিরক্ত করে সেটাই বোঝা দায়। ঈদ যদি ‘আনন্দের’ দিন হয়ে থাকে তাহলে আনন্দে থাকার অধিকার সকল মানুষের মতো আমারও আছে। আমি এতটুকু জানি যে আমি কম জানি- এতটুকু বুঝি যে আমি কিছুই বুঝি না- কিন্তু এই ঈদের সকালটা হাজারো দুঃখ-কষ্টে অতিবাহিত করোনাকালে আমাকে মিশ্র অনুভূতিতে ঠেলে দেয়- তা মোটেও ভালো লাগেনি। হয়তো ‘কোমল মনের’ শিল্পী বলে আমি একটু বেশি ‘সেনসিটিভ’? হতে পারে...।

কিন্তু এমনও হতে পারে আমি একটু ‘সেকেলে’ টাইপের পাবলিক এবং সেদিনগুলোর কথা ভেবে ধন্য হই যখন শত শত ঈদকার্ড ডাকপিয়ন এসে বাসায় বিলি করে দিয়ে যেতো। অংকন শিল্পীদের জন্য ঈদ ছিল ব্যস্ততম সময়। অনেক কার্ড বাচ্চাদের হাতে আঁকা হতো এবং একেকজন প্রেরকের আন্তরিকতা, ভালোবাসাসহ রুচির স্বাক্ষর বহন করতো। অনেক কার্ডে গোলাপ ফুলের পাপড়ি এমনকি সুন্দর আতর বা পারফিউমের সুগন্ধও যুক্ত থাকতো। আর প্রিয়জনের গোছানো সুন্দর হাতের লেখা? সে যে কি মিস করি তা আর বলার নেই। কী আর বলবো, নিজের হাতের লেখাই বা কেমন তা মাঝেমধ্যে কোথাও স্বাক্ষর দিলেই কেবল টের পাই।

নাহ বাদ দেই এসব ‘পুরনো জামানার’ বোরিং নস্টালজিক কথা...।

সমগ্র রমজান মাসটা ছিল ‘ঘটনাবহুল’। তবে কমবেশি প্রত্যেকটা ঘটনার সঙ্গে ছিল রমরমা, রগরগে যৌন উত্তেজক কনটেন্ট। ইসলামের তথাকথিত ‘হেফাজতকারী’ এক কুলাঙ্গার হুজুর ও তার ‘মানবিক স্ত্রীর’ গল্প, তার ‘হালাল স্ত্রী’কে ‘সীমিত পরিসরে’ মিথ্যা কথা বলার ইসলামি ‘অধিকার’ ছাড়াও ধনাঢ্য বসুন্ধরা গ্রুপের এক পরিচালকের গার্লফ্রেন্ডের আত্মহত্যা (নাকি হত্যা?)।

টাকা ও ক্ষমতার জোরে বাংলাদেশে এখনও অনেকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের ঊর্ধ্বে- এই অপ্রিয় সত্যটা আবার জাতির বিবেকে দিলো সজোরে ধাক্কা। তবে ব্যালেন্সে যা তীব্র হয়ে উঠলো তা মিডিয়ার দুর্নীতি। এ একটা জায়গায় আমাদের ‘শকুনের’ মতো চোখ রাখতে হবে।

জনগণের প্রাপ্তি ছিল এসব নিয়ে যে কী পরিমাণের অশ্লীল, ইরোটিক ও পর্নোগ্রাফিক কথাবার্তা সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়াতে পরিলক্ষিত হয়েছে, তাতে জাতিগতভাবে আমাদের রুচি ও চিন্তাচেতনা কত নিম্নমুখী তার একটা সূক্ষ্ম মাপ পাওয়া গেলো। ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ শব্দযুগল আজ কেবল ‘আনফেশনেবল’ হয়নি- তা এখন প্রাচীন ও বিলুপ্ত।

উল্টোভাবে চিন্তা করলে এমন অনেকেই মনে করতে পারেন যে আমাদের সমাজ কতটা ‘আধুনিক’ হচ্ছে তারই এসব প্রতিচ্ছবি। তা হতেই পারে তবে অধুনা বিশ্ব- যার সম্পর্কে আমাদের অত্যন্ত সীমিত জ্ঞান এহেন পাবলিক আচরণকে ‘পার্ভার্শন’ বা যৌন বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছুই মনে করা হয় না।

এতকিছুর ভেতরে আমাদের তথাকথিত ‘ইসলাম পাসন্ড’ জনগণ কেন জানি ভুলে গিয়েছিল এটা ‘পবিত্র’ রমজান বা সিয়াম সাধনা, আত্মসংযম চর্চার মাস। মোদ্দা কথা নোংরা চিন্তা করবো না, নোংরা কথা বলবো না, নোংরা কিছুই দেখবো না- এটাই ইসলামের বিধান।

এক মাস রোজা রেখে যে ভাষায় আমরা কথা বলেছি, ট্রলিং করে যে হাসি-তামাশা করেছি, যেসব ছবি কেবল দেখিনি- তা হাজার হাজার বার শেয়ার করেছি তা সবই যে ইসলাম পরিপন্থী ও গুনাহ বা ‘মহাপাপ’- এসব কিছুরই আমরা ধার ধরিনি। বছরের বাকি ১১ মাস আমরা কি করবো তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আমরা কেবল ঝাঁপিয়ে পড়েছি দু-চারটা অশ্লীল কথা ও অভিব্যক্তি মানুষকে জানান দিতে। কারণ, এটাই সময়ের ‘ট্রেন্ড’ বা প্রবণতা ও এ কাজ করাটাই ‘ট্রেন্ডি’? চলন্ত বাস কোনোভাবেই মিস করা যাবে না।

আরেক ‘ট্রেন্ড’ মহামারি শুরু হওয়ার আগ থেকেই খেয়াল করেছেন হয়তো। তা হলো– মানুষের ‘অতি ধার্মিক’ হয়ে যাওয়া। ধর্মচর্চা নিয়ে কোনও আপত্তি কোনও সুস্থ লোকের থাকার কথা না। মানুষ বিপদে পড়লে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করাটাই স্বাভাবিক। তবে এও খেয়াল করবেন মৃত্যু আতঙ্ক চড়ানোও এখন একটা নতুন ‘ট্রেন্ডি’ ব্যাপার-স্যাপার।

প্রতিদিন কেউ না কেউ স্ট্যাটাস দেবে ‘মরে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি’ আর্তনাদ করে- সাথে থাকবে কোথা থেকে টুকলিফাই করা কঠিন সব আরবি শব্দ, যার বাংলা অর্থ কেউ বুঝে না- এমনকি যারা লিখেছেন- তারাও না! একজনকে প্রশ্ন করলাম- ‘ভাই এই কথা বাংলায় লিখলে কি সৃষ্টিকর্তা বুঝবেন না’? উত্তর যেটা পেলাম তার সারসংক্ষেপ হলো- ‘পাক্কা মুসলিম’ হতে হলে আরবি ভাষা বাঞ্ছনীয়। তাই? কী আশ্চর্য!

সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেবল ব্যক্তিগত না, তা পবিত্র ও গোপনীয়। সেই নিরিখে ইসলামের পরিষ্কার বিধান- জন্ম, মৃত্যু আর আহার সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্ত্রণ করেন- মানুষ না। এই তিনটি বিষয় মনের ওপরে শক্ত ভিত করেই আমাদের ‘ঈমান’, আমরা ধর্ম পালন করি- এর বাইরে না।

যদি সৃষ্টিকর্তার ওপরেই সব ভরসা রাখি তাহলে মৃত্যুর ভয় আসে কি করে? মৃত্যুর ভয় তারাই বেশি করে যারা ইহ জগতের মোহ থেকে বঞ্চিত হতে চান না। নিজের ব্যক্তিগত মৃত্যুর ভয় সর্বজনের ওপর সংক্রমণ করা হলো নিজের ইমানের সঙ্গে বেইমানি। আমাদের ইমান কতটা পোক্ত, কতটা পাকা- তা প্রমাণ করতে গিয়ে আমরা আরেকজনের ইমান কেবল দুর্বল করছি না- করছি বিনষ্ট।

ধর্মের ভুল ও মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে আমরা নিজেরাই মানুষকে করছি বিভ্রান্ত ও ধর্মান্ধ। কথায় কথায় আমাদের অতি ভঙ্গুর ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ ঘষা খেয়ে চুরমার হয়ে গেলেও নিজের তথাকথিত সাচ্চা ধর্ম পালন করতে গিয়ে নিজ ধর্মেরই অন্যদের ধর্মীয় অনুভূতিতে যে আঘাত করছি- তার খবর কে রাখে? মানুষ দেখানো ধর্ম পালন মানুষের সেবায় কখনও আসতে পারে না। প্রকৃতি ধর্ম পালন হলো মানুষকে মনে সাহস ও আশার আলো দেখানো। এ ছাড়া আছে সৎ কর্ম ও সৎ জীবনযাপন।

আমাদের সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো উন্নত শিক্ষার জন্য আমরা ভিন্ন দেশে যাই- প্রাইভেট ও পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করি, গুগল ঘেঁটে পিএইচডি নিই- এসবই ভালো। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে আমরা স্বেচ্ছায় বেছে নেই অশিক্ষিত ও মিথ্যাবাদী কিছু হুজুরদের। অবাক লাগে, অনেক শিক্ষিত মানুষও এসব হুজুরের কথা ১০০ ভাগ সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং তাদের অত্যন্ত জঘন্য ওয়াজ শুনতে বা শেয়ার করেতে দ্বিধাবোধ করেন না। এমনও দেখেছি, শিক্ষিত নারীগণ এসব কুলাঙ্গার ওয়াজওয়ালার ওপরে মহা ‘ক্রাশ’ খাচ্ছেন। অথচ কি পরিমাণের মিথ্যাবাদী এই ধর্ম ব্যবসায়ীগণ, ন্যায়পরায়ণতার ধুম-ধারাক্কা করে ‘জিহাদ ও ইমানের লড়াই’ করনেওয়ালা এসব হুজুরদের চরিত্রেরই বা কী তার ‘নমুনা’- তা এই রমজান মাসেই আমাদের সবার কাছে অতি পরিষ্কারভাবেই ‘পেশ-এ-খেদমত’ হয়েছে। এটাই রমজান ২০২১-এ আমাদের প্রকৃত অর্জন।

মূলকথা হচ্ছে আমাদের চলমান ‘আত্মপরিচয়ের’ রাজনীতি বা ‘পলিটিক্স অব আইডেন্টিটি’ কেন জানি এই বাংলাদেশে ‘মানুষ’ পরিচয়টা আর যথেষ্ট ঠেকছে না। ধর্ম নিয়ে দাম্ভিকতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সময় বলে দেবে। আপাতদৃষ্টিতে আমরা যা করতে পারি তা হলো এই হিপোক্রেসির, এই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে শক্ত ও যুক্তিসঙ্গত অবস্থান নেওয়া এবং সবকিছু হোক শান্তিপূর্ণভাবে।

শেষ করছি ঈদের দিনের শ্রেষ্ঠ ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট দিয়ে। লিখেছেন অরণ্য হৃদি।

“সবচেয়ে বিশ্রী অহংকার হলো ‘ইবাদতের অহংকার’। ৫ ওয়াক্ত নামাজ আর এক খতম কুরান (কুরআন) পড়ে যদি নিজের মধ্যে কিঞ্চিৎ সুপিরিয়র ভাব চলে আসে এবং ২টা লেকচার শুনে যদি হুট করেই সবাইকে জাহেল মনে হয় তাহলে ধরে নিবেন আপনি ইসলামের সবচেয়ে প্রাচীন পাপের পথে হাঁটছেন... যে পথে হেঁটেছিল বিতাড়িত শয়তান।”

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ, শতাধিক শিক্ষার্থী গ্রেফতার
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
বিতর্কের মুখে গাজায় ইসরায়েলি কার্যকলাপের নিন্দা জানিয়েছেন মালালা
‘পাতানো ম্যাচ’ নয়, মাঠে খেলেই এগিয়ে যেতে চায় স্বাধীনতা
‘পাতানো ম্যাচ’ নয়, মাঠে খেলেই এগিয়ে যেতে চায় স্বাধীনতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ