X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজে ইসলামিক বক্তাদের প্রভাব ও জনসংস্কৃতির তর্ক

আমীন আল রশীদ
২৬ জুন ২০২১, ১৫:৪৫আপডেট : ২৬ জুন ২০২১, ১৫:৪৫

আমীন আল রশীদ ইসলামিক রাজনীতি, অর্থনীতি, ইহুদিবাদসহ সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান নামে এক যুবকের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার আটদিন পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে জানানো হয় যে, তার সন্ধান পাওয়া গেছে এবং দাবি করা হয়, তিনি ‘ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপনে’ গিয়েছিলেন। যদিও দুই সঙ্গী এবং গাড়ির চালকসহ ব্যক্তিগত আত্মগোপনের রহস্য পরিষ্কার নয়। ফলে ১০ জুন নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এই আটদিন ত্বহা এবং অপর তিনজন আসলেই কোথায় ছিলেন, তা হয়তো  কোনোদিনই জানা যাবে না। কারণ এর আগেও তার মতো নিখোঁজের পরে ফিরে আসা বা ফিরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিরা কোথায় ছিলেন, তাদের কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তাদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়েছে এবং জীবিত ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কী কী শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে—সেসব বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা চুপ থেকেছেন। সুতরাং ত্বহা এবং অপর তিনজনের বেলায়ও ঠিক কী ঘটেছিলো—সেটি সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলে আমাদের আপাতত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি তিন সঙ্গীসহ ‘ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপনে’ ছিলেন। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য তার নিখোঁজ এবং উদ্ধারের রহস্য উদ্ঘাটন নয়। বরং তার মতো আরও যারা ইসলামিক বিষয়ে আলোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়েছেন, সমাজে তাদের বক্তব্যের প্রভাব কী, কারা এসব বক্তৃতা শোনেন, ইদানীং ইসলামিক আলোচনায় প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহারজনিত শ্লাঘাবোধ এবং সমাজের প্রান্তিক মানুষের মনস্তত্ত্ব—সর্বোপরি জনসংস্কৃতি ও ক্ষমতাকাঠামোর আলোকে বিষয়গুলো দেখার সুযোগ আছে কিনা, সে বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করা।

অস্বীকার করার উপায় নেই, একসময় ওয়াজ মাহফিল বলতে যা বোঝানো হতো, সেই ধারণায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে সমাজের যে স্তরের আলেম-ওলামারা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে খোলা ময়দানে বড় প্যান্ডেলের ভেতরে ওয়াজ করতেন, সেসব ওয়াজ এখনও অব্যাহত থাকলেও এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইসলামিক আলোচনাগুলোর প্রভাব অনেক বেশি। আবার মাঠে ময়দানের আলোচনার অংশবিশেষও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ যারা মাঠে গিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থেকে ওয়াজ বা ইসলামিক আলোচনা শুনতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না বা এসব জায়গায় যাওয়ার সময় পান না, তারাও নিজেদের মোবাইল ফোনে এসব আলোচনা বা বক্তৃতা শুনতে পারেন।

এসব ওয়াজকারী বা আলোচকদের সামাজিক অবস্থানেও যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। কারণ তাদের অনেকের বক্তৃতা সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ ভিউ ও শেয়ার হয়—যার মধ্য দিয়ে স্টার বা তারকা বিষয়ক ধারণায়ও পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ এখন শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের বাইরে এই আলোচকরাও তারকা হয়ে উঠছেন। ফলে যেসব আলোচকের নামও একসময় মানুষ জানতো না, তারাও এখন পরিচিতই শুধু নন, একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে তারা আদর্শ ও জনপ্রিয় এবং তাদের এই বক্তৃতা ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে দিয়ে, মোবাইল ফোনে কপি করে অনেকে ভালো অংকের টাকা-পয়সাও কামাচ্ছেন। অর্থাৎ ইসলামিক ওয়াজের একটা অর্থনৈতিক মূল্যও দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যেমন ওয়াজ করে শুধু নির্দিষ্ট বক্তা এবং যে প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে তিনি ওয়াজ করতেন, তারাই লাভবান হতো, এখন সেখানে একটি নতুন লাভবান গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা এসব বক্তব্য বা ওয়াজকে সম্পাদনা করে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

ম্যাক্স স্টিল ‘ইসলামিক সারমন অ্যান্ড পাবলিক পিওটি ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে (পৃষ্ঠা ২০) ওয়াজকে শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং জনসংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এর বিনোদনমূল্যকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বিষয়টিকে ধর্ম বা রিলিজিয়নের সাথে বিনোদন বা এনটারটেইনমেন্টকে সমাসবদ্ধ করে ‘রিলিজিওটেইনমেন্ট’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যে কারণে আমরা দেখতে পাই গিয়াসউদ্দিন তাহিরী নামে একজন বক্তার আলোচনাগুলো ধর্মের বৃত্ত ছাপিয়ে ‘বিনোদনমূলক’ অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয় এবং জনাব তাহিরীও যতটা না ইসলামিক স্কলার বা আলোচক, তার চেয়ে বেশি তিনি এখন ‘সোশ্যাল মিডিয়া পারফরমার’ হিসেবে হিসেবে আর্বিভূত হচ্ছেন। ওয়াজের বিষয়বস্তুর সঙ্গে অন্যান্য উপাদান সংযুক্ত করা হচ্ছে। কখনও তা করা হচ্ছে বাংলা বা হিন্দি গান গেয়ে, আবৃত্তি করে বা গজলের সুরে। আবার ওয়াজে ব্যবহৃত জিকির ও গানগুলোয় মিউজিক লাগিয়ে এবং কিছুটা কাঁটছাঁট বা এডিট করে অন্য ফরম্যাটে ইউটিউবে প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এসব চালানো হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে ইসলামিক ওয়াজের এই রূপান্তর কেন ঘটলো এবং এখানে আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় কোন কোন বিষয়গুলো ক্রিয়াশীল রয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, মিজানুর রহমান আজহারিসহ আরও কিছু বক্তা তাদের আলোচনায় বাংলা ও আরবির পাশাপাশি যে প্রচুর ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করেন, সেটি নিয়ে তাদের ভক্ত অনুরাগীরা, বিশেষ করে কম পড়ালেখা করা এবং তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষেরা যে শ্লাঘা বোধ করেন, তার পেছনেই বা কী কারণ রয়েছে?

ইসলামি আলোচকদের অনেক বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছে, তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান আজহারি তুলনামূলকভাবে বেশি ইংরেজি প্রয়োগ করেন। যেমন একটি আলোচনায় মাজারের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মাজার হচ্ছে ‘মাকানুজ জিয়ারা’ মানে ‘ভিজিটিং প্লেস’, যেখানে মানুষ জিয়ারত করতে যায়। দেখা যাচ্ছে এখানে তিনি আরবিতে ‘মাকানুজ জিয়ারা’ বলার পরেই এর ইংরেজি ভার্সনটাও বলছেন। আবার তিনি যখন কোনও কিছু পয়েন্ট আকারে বলেন তখন সেখানে এক দুই না বলে নাম্বার ওয়ান, নাম্বার টু ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। একটি আলোচনায় নবজাতক শিশু বোঝাতে তিনি ‘জাস্ট নিউ বর্ন বেবি’ শব্দগুলোর প্রয়োগ করেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, যখন তিনি এই ইংরেজি শব্দগুলোর উচ্চারণ করছেন, তখন তার বলার ভঙ্গি তথা এক্সপ্রেশনে পরিবর্তন আসে। এক ধরনের শ্লাঘাবোধ তার মুখাবয়বে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ প্রতিটি বক্তৃতার মধ্যেই তিনি সচেতনভাবে অনেক ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করেন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, আমরাও দৈনন্দিন আলাপচারিতা ও কথাবার্তায় প্রসঙ্গক্রমে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি। কিন্তু ইসলামিক বক্তারা যখন আরবি ও বাংলা এবং মাঝেমধ্যে উর্দুর সঙ্গে ইংরেজির প্রয়োগ করেন, তখন সেখানে সম্ভবত মূল উদ্দেশ্য থাকে দর্শক শ্রোতাদের এটি বোঝানো যে, তিনি ইংরেজিও জানেন। এটি তাদের জানান দিতে হয় কারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণাটিই প্রবল যে, মাদ্রাসায় পড়া লোকজন ইংরেজি জানে না বা ইংরেজি কেবল সমাজের উচ্চবিত্তের ভাষা। ফলে আজহারির মতো বক্তারা শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা ও ইংরেজি বলার ব্যাপারে সচেতন। তাদের ভক্তরাও এটি পছন্দ করেন।

আজহারির বক্তৃতা শুনেছেন এরকম একজন লোকের সাথে আলাপ হচ্ছিলো। তিনি বলছিলেন, আজহারি সাহেবের বক্তৃতা শুনেছেন? কী সুন্দর ইংরেজি বলেন! তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ইংরেজির অর্থ বোঝেন? তিন বললেন, বুঝি না। কিন্তু শুনতে ভালোই লাগে। এই ‘শুনতে ভালো লাগা’র অর্থ হলো আজহারির সঙ্গে তিনি নিজের নৈকট্য অনুভব করেন। কারণ তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষ। আবার যারা এসব ইসলামিক আলোচনা করেন, তাদেরকেও যেহেতু এই প্রান্তিক মানুষের একটি বিরাট অংশ নিজেদের প্রতিনিধি মনে করেন, ফলে তারা যখন ইংরেজি বলেন, তখন তাদের ভক্ত অনুরাগীরাও একধরনের শ্লাঘা বোধ করেন।

প্রসঙ্গত, একসময় এই উপমহাদেশে ইংরেজি ছিল শাসকদের ভাষা। দুইশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি দাঁড়িয়েছিল এই ভাষার ওপরে। সমাজের প্রান্তিক ও ব্রাত্যজনেরা এ ভাষা হয় প্রত্যাখান করেছেন, অথবা শিক্ষাব্যবস্থার কারণে এই ভাষা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। ধর্মীয় বিবেচনাও এখানে কাজ করেছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ইসলামিক বক্তারা ইংরেজি রপ্ত করছেন। এই নবপ্রকাশ দেখে প্রান্তিক মানুষেরা এসব বক্তার মধ্যে নিজেদের প্রতিস্থাপন করছেন। আনন্দ ও তৃপ্তির আস্বাদন করছেন। সব মিলিয়ে ইংরেজি ভাষা ঘিরে ইসলামিক বক্তারা হয়ে উঠছেন এক পরাস্ত মনস্তত্ত্বের প্রতিনিধি।

২.

বিপরীত দিক হলো, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ইসলামিক আলোচককে গ্রেফতার করা হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে কথিত জিহাদ ও জঙ্গিবাদে উসকানি দেওয়া এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ রয়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের শুরুর দিকে মিজানুর রহমান আজহারির সকল ওয়াজ মাহফিল নিষিদ্ধ করেছিলো প্রশাসন। যদিও তার মাহফিলের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লোক দাঁড়িয়ে যান। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোরও ইন্ধন ছিল তাও অস্বীকার করা যাবে না। শুধু তাই নয়, আজহারির কিছু বক্তব্য সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ ওঠে। তিনি জামায়াতে ইসলামির লোক তথা যুদ্ধাপরাধের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ইসলামিক বক্তা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অনুসারী বলেও দাবি করা হয়। যে কারণে আলেম-ওলামাদের একটি অংশও আজহারির বিরোধী।

করোনাভাইরাস নিয়ে নানারকম অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা বলে আলোচিত বা বিতর্কিত হন মুফতি মাওলানা ইব্রাহিম। যে কারণে অনেকে তাকে ব্যঙ্গ করে ‘ড. আব্রাহাম’ বলেও উল্লেখ করেন। নুরুল ইসলাম জিহাদী নামে একজন বক্তা বিরোধী মতের লোকদের উদ্দেশ করে তাদের পিটিয়ে মাথার চান্দি ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন এবং তার সেই বক্তব্যে উপস্থিত লোকজন সমস্বরে সায়ও দেন। এভাবে সমাজের বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জাগিয়ে তোলা ইসলামের সহনশীলতার সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক।

কিন্তু এতসব বিতর্কের পরেও এইসব ব্যক্তির আলোচনা বা ওয়াজ সোশ্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ মানুষ দেখছেন। তাদের বক্তব্যের অডিও কপি করে মোবাইল ফোনে শুনছেন। অনেক রিকশাচালককে দেখেছি বুকপকেট মোবাইল ফোন রেখে তাতে এইসব ওয়াজ চালিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন। তার মানে এইসব ওয়াজে এমন কিছু কনটেন্ট আছে, যা তিনি শুনতে চান বা যা তাকে আকৃষ্ট করছে। এই জনগোষ্ঠী সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তার মানে সমাজের বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে এইসব ওয়াজের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু সেই প্রভাবটি আসলেই কত ব্যাপক, তা নিয়ে কি বৃহৎ পরিসরে কোনও গবেষণা হয়েছে?

২০১৯ সালের ২৩ মার্চ বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদে বিশেষজ্ঞদের বরাতে বলা হয়, ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে সামাজিক প্রভাবের বলয় তৈরি হয়। এটি ক্ষেত্রবিশেষে একইসঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক। সামাজিক আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে এসব দৃশ্যমান হয়। মানুষের মধ্যে তুলনামূলক ধর্মবিরোধ, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রভাবের বিষয়টি যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনই ধর্মীয় আবহ তৈরিতেও ভূমিকা রাখে ওয়াজ মাহফিল।

প্রশ্ন হলো আদনান ত্বহা, মিজানুর রহমান আজহারি কিংবা গিয়াসউদ্দিন তাহিরির মতো আলোচকরা কেন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয় হচ্ছেন? তারা কীভাবে সমাজের বিশাল অংশের মানুষকে আকৃষ্ট করছেন এবং সেই আকৃষ্ট হওয়া মানুষদের সামাজিক অবস্থান কী? তারা সবাই কি কম শিক্ষিত এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে বসবাস করেন? তাদের আর্থ-সামজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, রাষ্ট্র তাদের অস্বীকার করতে পারে না। বরং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের যদি ভোটার হিসেবেও বিবেচনা করা হয়, তাহলেও তারা বিশাল অংকের ভোটার। ফলে রাজনীতিবিদরাও এই ভোটারদের উপেক্ষা করতে পারেন না। পারেন না বলেই হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও তারা ধর্মীয়-সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে সোচ্চার হলে খোদ রাষ্ট্রকেও উদ্বিগ্ন হতে হয়। সেই উদ্বেগের কারণে এই সংগঠনকে ‘বাগে আনতে’ তাদের মৌলিক দাবি-দাওয়াও রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হয়।

২০১৮ সালের ৭ জুলাই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশ প্রফেসর আলী রীয়াজের বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখা হয়, বাংলাদেশে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীরা শক্তিশালী হয়েছেন। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ‘সংস্কারবাদী ইসলামপন্থী’ রাজনীতি দুর্বল হয়েছে, বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে ‘রক্ষণশীল’ ইসলামপন্থীরা।

সমাজে ইসলামাইজেশন যে বাড়ছে সেটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হিজাব ও বোরখা পরা মেয়েদের সংখ্যা অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে এখন বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই প্রবণতা বাড়ছে তার নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে আমরা রাজি আছি? এর পেছনে কি অর্থনৈতিক কারণ নেই? এর পেছনে কি রাস্তায় চলাচলে নারীর নিরাপত্তাবোধের অভাব অনেকাংশে দায়ী নয়? সুতরাং বোরখা ও হিজাবের সংখ্যা বাড়ছে বলে এ নিয়ে টিপ্পনি কাটা সহজ, কিন্তু এর পেছনের কারণগুলোও জানা দরকার।

সেইসাথে জানা দরকার কারা ইসলামিক আলোচনা বা ওয়াজ শুনে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন এবং কেন এসব আলোচক তারকা হয়ে উঠছেন বা উঠতে পারছেন। আমজনতার বিনোদন বা জনসংস্কৃতির সঙ্গে এর কি কোনও সম্পর্ক নেই? ‘গরিব মানুষের শিল্পী’ মমতাজ কীভাবে সুপার স্টার হয়ে উঠলেন এবং কীভাবে তিনি একজন আইনপ্রণেতা হয়ে গেলেন—তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ কি হয়েছে? কী করে সমাজে হিরো আলম তৈরি হয় এবং তারা ক্ষমতাকাঠামোর অংশ হয়ে যান; হিরো আলমের মতো একজন লোক কী করে জাতীয় পার্টির মতো একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতার সাথে হাস্যোজ্জ্বল ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন বা দিতে পারেন—তার সাথেও এই জনসংস্কৃতি ও রুচির কি কোনো সম্পর্ক নেই?

পরিশেষে, ইসলামিক আলোচকদের ওয়াজ বা বক্তৃতা যে পরিমাণ মানুষ শোনে, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য বা আলোচনা সেভাবে শোনে না। গ্রামের সাধারণ মানুষও তাদের মোবাইল ফোনে ওইসব ওয়াজ মাহফিল কপি করে নেন এবং কাজের ফাঁকে সেগুলো শোনেন। বরং তারা রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী বা এমপিদের কোনও বক্তৃতার চুম্বক অংশ, যেগুলো মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, সেগুলো শোনেন এবং তাদের এই শোনা বা দেখার মূল উদ্দেশ্য থাকে সমালোচনা করা। অর্থাৎ যে মানুষেরা আজহারি বা তাহিরীদের বক্তব্য মন দিয়ে শোনেন, বিনোদন খোঁজেন এবং তাদের ইংরেজি উচ্চারণ শুনে পুলকিত হন, তারাই রাজনীতিবিদদের বিতর্কিত বক্তব্যসমূহের খণ্ডিত অংশ শুনে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এর পেছনে প্রচলিত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিজেদের বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ কতটুকু কাজ করছে—তা নিয়েও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীরমুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীরমুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
মোংলার তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সহসা নামবে না বৃষ্টি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ