X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রয়ণ প্রকল্প: দুর্নীতি কি আর্থিক নাকি ‘তেলবাজি’র?

রুমিন ফারহানা
২০ জুলাই ২০২১, ১৪:০১আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ১৫:৪৭

রুমিন ফারহানা আট বছর আগে ঘটা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বেরিয়ে আছে রক্তাক্ত হাত, কোথাও কেবল একটা পা, সিমেন্ট, বালি আর কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে রক্তের ছোপ। কী মর্মান্তিক আর করুণ ছিল গণমাধ্যমে আসা ছবিগুলো। এই বীভৎস সময়কে ছাপিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনায় ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য। ভবন ধসের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে আমি জানতে পেরেছি। ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।’ বক্তব্যটি যে শুধু নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ তা-ই নয়, এটি ব্যক্তির চরিত্রের নিষ্ঠুরতাকেও নির্ভুলভাবে তুলে ধরে।  

একই ধরনের কথা এত বছর পর আবারও বললেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম শাহীন। তার এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের পিলার ভেঙে পড়ার কারণ হিসেবে বলেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য রাতের আঁধারে কে বা কারা ধাক্কা দিয়ে ষড়যন্ত্র করে ঘরের একটি পিলার ফেলে দিয়েছে। নয়তলা প্রকাণ্ড এক ভবন রানা প্লাজা, যাতে কাজ করতো অন্তত ৫০০০ হাজার মানুষ, সেটাকে যদি আওয়ামী বয়ান মতে ‘স্তম্ভ’ ধরে নাড়াচাড়া করিয়ে ধসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে এই অতি ক্ষুদ্র বাড়ির ‘স্তম্ভ’ তো ফেলে দেওয়া সম্ভবই। আসলে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একের পর এক বাড়ি নিয়ে হচ্ছে কী?

সমাজের একেবারে প্রান্তিক, ভূমিহীন মানুষের জন্য ছিল আশ্রয়ণ প্রকল্প। এতে প্রায় নয় লক্ষ মানুষকে ঘর দেওয়ার কথা ছিল। ইতোমধ্যে ৬৬ হাজারের বেশি মানুষকে ঘরের চাবি বুঝিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ঘর বুঝিয়ে দিতে না দিতেই ভেঙে পড়েছে অনেকের ঘর। প্রকল্পের প্রধান হিসাবে তলব পড়েছে সংশ্লিষ্ট ইউএনও’দের। ইতোমধ্যে ওএসডি করা হয়েছে ৫ জনকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এখন পর্যন্ত ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। আরও অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

ঘর ভেঙে পড়েছে তৈরি হওয়ার পরে। কিন্তু ঘর তৈরি হওয়ার আগেই এই প্রকল্পের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় নিয়মিত এসেছে। ঘরের বরাদ্দ পাওয়ার জন্য দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে টাকা নেওয়া হয়েছে। কাউকে বলা হয়েছে বালি, সিমেন্টের দাম, কেউ দিয়েছেন ইলেকট্রিসিটি লাইন বসানোর খরচ। এমনকি স্রেফ ঘুষ বাবদও টাকা তোলা হয়েছে এই প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছ থেকে। এমনকি টাকা পরিশোধ করার পরও ঘর পায়নি এমন খবরও এসেছে মিডিয়ায়। রাষ্ট্রের একেবারে প্রান্তিক কিছু মানুষকে নিয়ে এমন কাণ্ড করা হতে পারে, এটা বোধ করি বর্তমান বাংলাদেশেই সম্ভব।  

এই প্রকল্পে বাড়িপ্রতি বরাদ্দ ছিল ১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এই প্রকল্পের বাজেট থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত তদারক করেছেন, তাই ধরে নেওয়া যাক এ ধরনের একটি ঘর নির্মাণে এই টাকাটি যথেষ্ট। তাহলে একের পর এক ঘর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার একটাই অর্থ দাঁড়ায়, আর তা হলো এই ঘর নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রাথমিক তদন্ত এবং গৃহীত ব্যবস্থা দুর্নীতির স্বীকৃতি দেয়।  

আমি বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলাম, যেহেতু এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প, সেহেতু অনেকেই ভেবেছিলেন, এতে কোনও অনিয়ম/দুর্নীতি হবে না। এই ভাবনাটাই অপরিপক্ব এবং শিশুতোষ। এই দেশেই আমরা দেখেছি আমলারা কী বীভৎস দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্য করে পুরো চাকরি জীবন একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের আপত্তিকর আচরণ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। কোথাও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায় না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ৫৯৫৭ টাকায় বালিশ (যা ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ হয়েছে ৯৩১ টাকা), চেয়ার ৬ লাখ টাকায়, অন্যান্য প্রকল্পে ১০ হাজার টাকায় বঁটি, ১ হাজার টাকায় চামচ, ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকায় দুধে পানি মাপার যন্ত্র, ২.৫ লাখ টাকায় বর্জ্য রাখার পাত্র, ৫৫৫০ টাকায় তালা, ১৮৯০ টাকায় বালতি, ৮৯৯৫ টাকায় ডাস্টবিন কেনার খবর আমাদের সবার জানা। একটা দেশে আমলারা কী পর্যায়ের দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারে তার এক টেক্সট বুক এক্সাম্পল হতে পারে এসব ঘটনা।

আমলাদের বিষয়ে গত কয়েক বছরে যে কথাগুলো সর্বাধিক উচ্চারিত হয়েছে তা হলো তারা নিজেদের সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। বিশেষ করে সরকার গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালনায় নিজেদের অপরিহার্যতা নিয়ে তাদের এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে প্রজাতন্ত্রের মালিক তারা। এর নমুনাও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা গেছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। নানা প্রকার অনিয়ম আর দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত আমলারা হঠাৎ করেই সাধু হয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিজের আগ্রহের এই প্রকল্পে সৎ থাকবেন, এমন ভাবার কোনও কারণ তো নেই। টিআইবি’র খানা জরিপ অনুযায়ী এই দেশে প্রতি বছর সরকারি কাজ করতে জনগণকে ঘুষ দিতে হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে যদি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঘুষ এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

এদিকে মিডিয়ায় এই সংবাদও এসেছে, দুটি কক্ষ, রান্নাঘর ও শৌচাগারসহ ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থের মোটামুটি টেকসই ঘর তৈরিতে ব্যয় হওয়ার কথা কমপক্ষে আড়াই লক্ষ টাকা। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রকল্পের জন্য যে নির্মাণ ব্যয় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা করা হলো, সেটাও ন্যূনতম ব্যয়ের চাইতে অনেক কম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি বরাদ্দের একটি টাকা দুর্নীতি না হয়ে থাকলেও বরাদ্দ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় তৈরি করা ঘর কি বৃষ্টিতে বা নিজে থেকেই ভেঙে পড়ার কথা নয়?

ন্যূনতম ব্যয়ের এই হিসাব যদি সঠিক হয় তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারি, পরিকল্পনার একেবারে কেন্দ্রে এই গলদ তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ আমলারা জেনেশুনে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। খরচ কম করে বেশি সংখ্যক বাড়ি তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের অতি দক্ষ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন তারা। ব্যয়ের এই হিসাব যদি সঠিক হয় তাহলে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নিযুক্ত ইউএনওদের আসলে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে; তাদের ওএসডি করা কিংবা অন্য কোনও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া তাদের ওপর পরিষ্কার অন্যায়।

এই দফায় হস্তান্তরকৃত ঘরের সংখ্যা ৬৬ হাজারের কিছু বেশি। এতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। এক মাসের মধ্যে আরও এক লক্ষ ঘর হস্তান্তরের কথা রয়েছে, যাতে ব্যয় হবে এক হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই পর্যায়ে মোট ব্যয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এই ঘরগুলো ভেঙে পড়বে সহসাই কিংবা কিছুকাল পরে। অর্থাৎ এই দেশের জনগণের টাকা নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করেছেন আমলারা। এই পর্যায়ের আমলাদের বিরুদ্ধে কি তাহলে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?

সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনিক আমলাদের তাদের চৌহদ্দির বাইরে ক্ষমতায়িত করার বিরুদ্ধে নানা মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতাও। এই দেশের রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের দক্ষতা-সততার সুনাম কি ছিল কোনোকালে? সাম্প্রতিক সময়ে মনে হচ্ছিল এই দেশে তারাই দক্ষতা-সততার প্রতিমূর্তি। এটা যে একেবারেই ভুল, সেটা আশ্রয়ণ প্রকল্প একেবারে স্পষ্ট করে দিলো।

দুর্নীতিতে অভ্যস্ত আমলারা কোনও ‘বিশেষ’ প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িত হবেন না, রাখঢাক করবেন, এটা আসলে হয় না। সততা বা অসততা পিক অ্যান্ড চুজ করে হয় না। আমাদের মনে রাখা উচিত, দুর্নীতিবাজ মানুষ, হোন রাজনীতিবিদ কিংবা আমলা, আসলে ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব। ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব একদিন যেমনি তার স্রষ্টা ফ্রাংকেনস্টাইনকেও আক্রমণ করতে যায়, ঠিক তেমনি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আমলাতন্ত্রের হাত থেকে রেহাই পায় না কোনও প্রকল্পই, এমনকি হোক না সেটা প্রধানমন্ত্রীর আবেগের সঙ্গে জড়িত।        

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ