X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহামারিকালে হাসপাতাল বন্ধ!

আমীন আল রশীদ
২৬ জুলাই ২০২১, ১৮:৩০আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২১, ২০:৪৬

আমীন আল রশীদ জনবল সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল; যেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। গত ১৫ জুলাই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদটি দেখার পরে প্রথমে যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হলো—করোনার মতো একটি অতিমারিকালে, যখন প্রতিদিনই মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ছে, সেরকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতরে খোদ রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত একটি সরকারি হাসপাতাল কী করে বন্ধ হয়ে যায়!

ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাভুক্ত পুরান ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজের পাশে এই হাসপাতালটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জনবল সংকটের কারণে। প্রশ্ন হলো, ১৭ কোটি লোকের দেশে জনবল সংকটের কারণে একটি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়া কি খুব স্বাভাবিক ঘটনা? অথচ এই হাসপাতালে লজিস্টিক সবকিছুই আছে। নেই শুধু চিকিৎসক, নার্স ও দক্ষ জনবল।

গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর এটিকে কোভিড ডেডিকেটেড একশ’ শয্যার হাসপাতাল বানানো হয়। বসানো হয় ৫ বেডের আইসিইউ ও ১৫ বেডের এইচডিইউ। স্থাপন করা হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট। অথচ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় সারা দেশেই যখন বেড ও আইসিইউ নিয়ে হাহাকার, তখন শুধু জনবল না থাকায় এরকম একটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হলো। একইভাবে লোকবল না থাকায় চিকিৎসা দিতে পারছে না রাজধানীর লালকুঠি হাসপাতালও।

তবে শুধু রাজধানীর এই দুটি হাসপাতালই নয়, সারা দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য জনবল সংকট চরমে—যা এই অতিমারিকালেও খুব একটা কাটানো সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ হাসপাতালে আধুনিক মানের যন্ত্রপাতি নেই। কোথাও যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ান। সংশ্লিষ্ট জনবলের অভাবে বিকল হয়ে আছে অনেক যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া ছুটির দিনে বন্ধ থাকে বহির্বিভাগ ও প্যাথলজি। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের পড়তে হয় সমস্যায়।

জেলা শহরের হাসপাতালগুলোয় সেবা না পাওয়ায় মানুষের চাপ বাড়ে রাজধানীর হাসপাতালে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের অন্তত অর্ধেক হয় দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার্ড হয়ে আসা, না হয় সেখানে সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আসা। কয়েক বছর ধরেই অসংক্রামক রোগের মধ্যে ক্যানসারে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। কিন্তু জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

যখন জনবল সংকটে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালও বন্ধ ঘোষণা করা হয় কিংবা জনবল না থাকায় আধুনিক অবকাঠামো আর যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত কোনও হাসপাতাল খালি পড়ে থাকে, তখন এটি বুঝতে বাকি থাকে না যে দেশের স্বাস্থ্য খাতে কী পরিমাণ লোকবলের অভাব রয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনার কারণে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিপর্যয়কর সময় পার করছে স্বাস্থ্য খাত। অথচ এই সময়ে এ খাতে ৫৪ হাজারের বেশি পদ শূন্য পড়ে আছে। এরমধ্যে চিকিৎসক পদই ফাঁকা ১১ হাজার ৩৬৩টি।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, স্বয়ং রাষ্ট্রপতির এলাকায় কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রথম শ্রেণির ক্যাডার চিকিৎসকের ৬৮ পদই শূন্য। নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির দুটি পদের সবই শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্সের ৩৪২ পদের মধ্যে ১৩২, দ্বিতীয় শ্রেণির পাঁচ পদের দুটি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১৩৯ পদের ১২৯টি শূন্য। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে টেকনিশিয়ান সংকটে। ৫৬ পদে কর্মরত মাত্র তিন জন। ফলে রোগীদের উচ্চমূল্য দিয়ে বাইরের ল্যাব থেকে বেশিরভাগ পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটের কারণেও চিকিৎসা কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। এখানে এমআরআই মেশিন নেই।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) বরাত দিয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৭৫ হাজার চিকিৎসক ও ৩২ হাজারের মতো নার্স রয়েছেন। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ২ হাজার ২৬৭ জনের জন্য রয়েছেন একজন চিকিৎসক। এ ছাড়া ৫ হাজার ৩১৩ জনের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে রয়েছেন একজন নার্স।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তিন জন নার্স ও পাঁচ জন টেকনিশিয়ান থাকা উচিত। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২৩ জন চিকিৎসক থাকা দরকার। গত বছরের শেষে জাতীয় সংসদে জেলাওয়ারি একটি পরিসংখ্যান দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, দেশের ৬৪ জেলার সবকটিতেই চিকিৎসকের পদ ফাঁকা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি শূন্যতা ঢাকায় ৩ হাজার ১৮৫টি। মন্ত্রীর নিজ জেলা মানিকগঞ্জে ২১৪টি, প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জে ২৮৩টি পদ ফাঁকা। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার।

প্রশ্ন হলো, করোনার মতো মহামারিকালেও কেন স্বাস্থ্য বিভাগের শূন্য পদে লোক নিয়োগ করা যাচ্ছে না? সরকারের কি টাকার অভাব? করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন খাতে প্রণোদনার চেয়ে মানুষ বাঁচানোর জন্য চিকিৎসক নার্স ও মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান নিয়োগের পেছনে অর্থ খরচ করাই যুক্তিযুক্ত নয়?

সরকারের বিভিন্ন দফতরে জনবল সংকটের কারণে সেবা ব্যাহত হওয়ার খবর এলে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে  জানা যায় বাজেট সংকটের কথা। অর্থাৎ লোকবল নিয়োগের মতো পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ আছে কিনা বা করোনার মতো অতিমারিকালে যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকার কথা তা আছে কিনা—তা নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হলেও কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বাজেটের আগে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানানো হলেও বাস্তবতা হলো, কম বরাদ্দও ব্যয় করতে পারে না স্বাস্থ্য বিভাগ। গত ২৮ মে একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে যে পরিমাণ বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া হয় তাও ব্যয় করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি করোনা মহামারির এই সময়েও এখন পর্যন্ত সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো অব্যয়িত রয়েছে।

বলাই বাহুল্য যে বরাদ্দ এই খরচ করতে না পারার পেছনে সরকারের পরিকল্পনার অভাব যেমন দায়ী, তেমনি আছে বাস্তবায়নকারী বিভিন্ন পক্ষের অদক্ষতা বা অগ্রাধিকার ঠিক করতে না পারা। অন্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে। যেমন আগে থেকে জনবল প্রস্তুতসহ চাহিদাপত্র তৈরি করতে হয়। এজন্য পরিকল্পনা নিতে হয়। অথচ তা না করে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলে সেই অর্থ যে অব্যয়িত থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক।

স্বাস্থ্য খাতে সরকার যে বরাদ্দ দেয়, তার বড় অংশই অনুন্নয়ন ব্যয়, অর্থাৎ চিকিৎসক নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের বেতন বোনাস। আর উন্নয়ন ব্যয়ের মোটা অংশের বরাদ্দ থাকে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ এবংং ভারী যন্ত্রপাতি কেনাকাটার জন্য। একটি অংশ খরচ হয় প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রী,  গজ, ব্যান্ডেজ, তুলাসহ হালকা যন্ত্রপাতি ও পথ্য ক্রয়ের পেছনে। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে ভারী যন্ত্রপাতি কেনাকাটা বন্ধ। এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের খবর প্রকাশ। অর্থাৎ  স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা; করোনাকালে কেনাকাটা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দীর্ঘদিন ধরে সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররা নিজেদের গুটিয়ে রাখার পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হওয়া সব ঠিকাদারের সক্ষমতার অভাবেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অর্থ খরচ হচ্ছে না। আবার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বেশ কিছু হাসপাতালের পরিচালক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ফলেও পুরো খাতে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তারাও কেনাকাটার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না—এমনটিও শোনা যাচ্ছে।

আবার এই বাস্তবতাও অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়। ডিজিটাল এক্সরে মেশিন নেই, রক্তের এই পরীক্ষাটি হবে না—এরকম নানা অজুহাতে রোগীদের বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। কারণ, সরকারি হাসপাতালের এক্সরে এবং প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের ডাক্তাররাই এসব বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ফলে তারাও চান না সরকারি হাসপাতালে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হোক। অর্থাৎ একটি বড় চক্রের বক্তিগত লোভের বলি হচ্ছে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো। সুতরাং এই যখন অবস্থা, তখন সরকারি হাসপাতালের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি কেনাকাটার অর্থ দিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে চিকিৎসক নার্স ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে করোনার চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলো সচল রাখা যায় কিনা—সেটিও নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন।

লেখক: সাংবাদিক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ