X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’

আমীন আল রশীদ
২০ আগস্ট ২০২১, ১৭:২২আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২১, ১৭:২২

আমীন আল রশীদ বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা গৈলা বাজা‌রে মোবাইল ফোন চুরির অপরাধে প্রকাশ্য বাজারে এক শিশুর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। শিশুটির মা বলেছেন, তার ছেলে যদি সত্যিই চুরি করে থাকে, তাহলে তিনিই এর বিচার করতেন। কিন্তু বাজারের লোকজন অমানবিকভাবে তাকে মারধর করেছে, চুলও কেটে দিয়েছে। ১৪ আগস্ট বিকালে এ ঘটনা ঘটে।

বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’

জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির মতো বিভিন্ন দলিলেও কারও সাথে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণ না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দেখা যায়, নানা ঘটনায় অপরাধে অভিযুক্ত এমনকি নিরপরাধ লোকও নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হন। প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে অনেক সময় ক্ষুব্ধ জনগণ ডাকাত কিংবা ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে—যার বড় উদাহরণ ২০১১ সালের ১৮ জুলাই শবে বরাতের রাতে ঢাকার অদূরে সাভারের আমিনবাজার এলাকায় ছয় জন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালে হঠাৎ করেই ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে এমন একজন নারীও ছিলেন, যিনি রাজধানীর একটি স্কুলে গিয়েছিলেন তার সন্তানের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে। অথচ কেউ একজন সন্দেহ করেছে তিনি ছেলেধরা। অতএব ‘সচেতন’ জনগণ সম্মিলিতভাবে ওই নারীর ওপর আক্রমণ করে এবং বেধড়ক পিটুনিতে তার মৃত্যু হয়। প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যুর দায় কার?

যখনই এরকম পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে, তখনই পুলিশ সদরদপ্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে পিটিয়ে মারাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে জনগণকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু তারপরও মাঝেমধ্যেই এরকম নৃশংসতার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়।

প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়? সে আসলে কার বিরুদ্ধে কীসের প্রতিশোধ নেয়? আইনের শাসনের অভাব কিংবা প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা নেই নাকি সে অন্য কারণে ক্ষুব্ধ যা অন্য কোনও ঘটনার দ্বারা সেই ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায়? ঘরে-বাইরে মানুষের এসব নৃশংস আচরণের পেছনে তাদের অবদমিত কামনা-বাসনাও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হয়। হয়তো সে অন্য কোনও কারণে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত কিংবা তিনি নিজেও জীবনের কোনও না কোনও পরিস্থিতিতে শারীরিক বা মানসিক নৃশংসতার শিকার হয়েছেন; ফলে সুযোগ পেলেই তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। নানা ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অযোগ্য ব্যক্তিদের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা, দীর্ঘদিনের হতাশা, অপ্রাপ্তিবোধ ও বঞ্চনাও এর পেছনে অনেক সময় কাজ করে বলে মনে করা হয়।

২০১৯ সালে রাজধানীর বাড্ডায় রেনু নামে এক নারীকে পিটিয়ে মারার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ভিডিওতে মানুষের নৃশংসতার ভয়াবহতা স্পষ্ট। কেউ কেউ তখন এমনও বলছিল , ‘ভালো করে মরে নাই।’ অবস্থা কতটা সঙ্গিন হলে একদল লোক মিলে একজন নারীকে, সন্তানের ভর্তির খবর নিতে আসা একজন মাকে এভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে। মানুষ আসলে কাকে মারছে? সে কোন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে?

একটি মোবাইল ফোন চুরির অপরাধে প্রকাশ্য বাজারে একজন শিশুকে বেদম মারধরের পরে তার মাথার চুল কেটে দিতে হবে? প্রথমে ওই শিশুটির পরিবারের কাছে অভিযোগ করা এবং প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতো। কিন্তু ক্ষুব্ধ লোকজন প্রচলিত পথের বাইরে গিয়ে কেন এরকম নৃশংস আচরণ করলো? মানুষ কেন এরকম নৃশংস হয়ে ওঠে? মানুষ কি মনে করে যে প্রচলিত ব্যবস্থা অপরাধীদের বিচার হবে না? নাকি সে যে ধরনের শাস্তি প্রত্যাশা করে সেটি প্রচলিত আইনে সম্ভব নয়? নাকি মানুষ বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেই শাস্তি দিয়ে একধরনের প্রশান্তি লাভ করতে চায়? আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই বলেই কি মানুষ আইন নিজের হাতে আইন তুলে নেয়? কেন আইনের প্রতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের পুরোপুরি আস্থা তৈরি হয়নি? এই প্রশ্নের নির্মোহ বিশ্লেষণ কি হয়েছে?

যারা এরকম আইন হাতে তুলে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধের বিচার করতে চান, তাদের মাথায় কেন এটি থাকে না যে, তারা একটি অপরাধের বিচার করতে গিয়ে নিজেরাও আরেকটি অপরাধ করে ফেলছেন? বরং আগৈলঝাড়ায় মোবাইল ফোন চুরির দায়ে যে শিশুটির মাথার চুল কেটে দেওয়া হলো, তাকে যে বেদম মারধর করা হলো, তার ফলে এখন ওই ঘটনার সাথে যুক্ত লোকজনকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজছে।

শুধু চোর, ডাকাত বা ছেলেধরা সন্দেহে প্রকাশ্য বাজারে কিংবা গাছের সাথে বেঁধে গণপিটুনি অথবা মাথা ন্যাড়া করে দেওয়াই নয়, ঘরের ভেতরেও মানুষ তার অধস্তনদের সাথে নানারকম নৃশংস আচরণ করে। গৃহকর্মীকে গরম খুনতি দিয়ে ছ্যাঁকা, মারধর, অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার নতুন কিছু নয়। আবার এইসব ঘটনার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে অভিযুক্তরা নানারকম যুক্তিও দিয়ে থাকেন।

ভুলে গেলে চলবে না, একজন অপরাধীরও মানবাধিকার রয়েছে এবং যেকোনও অবস্থায় তার মানবাধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের একজন শীর্ষ অপরাধীকেও গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শাস্তি দিতে হয়। এই যুক্তিতে ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে বিনা বিচারে কাউকে মেরে ফেলাও এক ধরনের রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠ হলো, এই বিনা বিচারে হত্যার পক্ষেও জনমত রয়েছে। কারণ, প্রচলিত বিচারিক প্রক্রিয়ায় অনেক সময়ই অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যায় না। যায় না বলেই যখন কোনও বড় অপরাধী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়, তখন জনগণের একটি বিরাট অংশ, বিশেষ করে যারা ওই অপরাধীর কারণে ভুক্তভোগী, তারা খুশি হয়। ক্রসফায়ারে অনেক বড় সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার পরে বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টি বিতরণও করা হয়েছে। কিন্তু জনমত আছে বলেই ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা বৈধ হয়ে যায় না। কারণ দশজন অপরাধীর মধ্যে যদি একজন নিরপরাধ লোকও এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাহলে সেটি পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। নারায়ণগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে সাত জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা তার বড় উদাহরণ।

বড় ধরনের অপরাধ হলেই মানুষ এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। তারা এমন শাস্তি চায় যাতে এ ধরনের অপরাধ করতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস না পায়। বিশেষ করে যারা কোনও ঘটনায় ভুক্তভোগী, যেমন যার সন্তান ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বা যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তিনি হয়তো ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডেও খুশি নন। কারণ ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড হলেও তার জীবনের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়।

সৌদি আরবে চুরির দায়ে হাত কেটে ফেলা; হত্যার শাস্তি প্রকাশ্যে গলা কাটা; বিবাহ-বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ অপরাধ দমনে এরকম নৃশংস শাস্তির পক্ষে। যখনই বড় কোনও অপরাধ হয়, সাধারণ মানুষের তরফে এর দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা শ্রেণিপেশার মানুষ তো বটেই, খোদ জাতীয় অনেক সংসদ সদস্য ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেওয়া এবং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলেন। অনেকে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়ারও দাবি জানান। জনদাবির মুখে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এর ফলে ধর্ষণ কমে আসবে।

এখন অনুসন্ধানের বিষয় হলো, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার ফলে আসলেই দেশে এই অপরাধ কতটুকু কমেছে? যদি না কমে তাহলে বুঝতে হবে, শুধুমাত্র আইন করে বা অপরাধের শাস্তির মাত্রা বাড়ানো হলেও কোনও একটি নির্দিষ্ট অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। বরং সমাজে ওই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনের ছোট-বড় সব কারণ চিহ্নিত করা জরুরি। কারণ মানুষমাত্রই অপরাধপ্রবণ। সুযোগ পেলেই মানুষ অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং, তার সেই সুযোগগুলো বন্ধ করা দরকার। এটি একদিনে সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ করার বা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সব দরজা খোলা রেখে শুধুমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অপরাধমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়।

মানুষ কেন অপরাধে জড়ায়? এর একটি বড় কারণ সে মনে করে অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে। পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামে এক দর্জি দোকানিকে যে তরুণরা প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তারা জানতো এই ঘটনা কারও না কারও ক্যামেরায় বন্দি হবেই। বুয়েটের যে শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যা করলো, তারাও কি জানতো না কোথাও কোথাও সিসি ক্যামেরায় তাদের গতিবিধি রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে? হয়তো জানতো। কিন্তু তাদের মনে এই বিশ্বাস ছিল, তাদের কিছুই হবে না। কারণ, তারা ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে আছে। যুগে যুগে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরাই অপরাধে জড়ায়। সুতরাং সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির চেয়েও বেশি জরুরি ক্ষমতার এই বলয় বা বৃত্তকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করা।

নারায়ণগঞ্জে যে সাত জন মানুষকে খোদ র‍্যাব সদস্যরাই খুন করেছিল, তাদের মনে হয়তো ভয় ছিল না কিংবা তারা মোটা অঙ্কের টাকার কাছে এতটাই বিকিয়ে গিয়েছিল যে, ওই ভয়ের বিষয়টি তাদের বিবেচনাতেই আসেনি। এখন কারাগারের প্রকোষ্ঠে তারা হয়তো অনুশোচনা করছে। কিন্তু যে বা যারা র‍্যাব সদস্যদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এত বড় একটি অন্যায় করালো সেই টাকার উৎস কী এবং কারা এভাবে অবৈধ টাকার মালিক হয়? রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শুধু নিজের চেষ্টায় কেউ অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা কামাতে পারে না। সুতরাং আমরা যখন সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলের কথা বলি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলি, তখন অবৈধ পথে টাকা রোজগার এবং সেখানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রশ্নটিও তোলা দরকার।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ