X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইভ্যালি: গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে কে?

আমীন আল রশীদ
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৯:৩২আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:২২

আমীন আল রশীদ গত জানুয়ারিতে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ইভ্যালির পৃষ্ঠপোষকতায় ‘অপারেশন সুন্দরবন’ নামে একটি চলচ্চিত্র বানাচ্ছে র‌্যাব ওয়েলফেয়ার কো-অপারেটিভ সোসাইটি। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে র‌্যাবের সাফল্যগাথা ও রোমাঞ্চকর অভিযানই এই সিনেমার প্রতিপাদ্য বলে জানানো হয়। ট্র্যাজেডি হলো, সেই র‌্যাবই ইভ্যালির  প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেছে। অভিযোগ, অনলাইন ব্যবসার নামে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ।

প্রশ্ন হলো, র‌্যাবের মতো একটি চৌকস বাহিনী তাদের সিনেমা বানানোর জন্য এই ইভ্যালির কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নেওয়ার আগে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে কেন বিস্তারিত খোঁজ নিলো না? তারা কি ইভ্যালির বিপুল গ্রাহক ও বিজ্ঞাপনের বাহার দেখে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি? একই কথা দেশের অনেক খ্যাতিমান অভিনেতা ও মডেলের ক্ষেত্রে, যারা এই প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরসহ নানা কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিলেন। তারাও কি ইভ্যালির প্রতারণার কৌশলগুলো বুঝতে পারেননি, নাকি ইভ্যালি যে মডেলে ব্যবসা করে আসছিল, সেটি এক অর্থে ঠিকই ছিল এবং এর চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীকে গ্রেফতার না করে তাদের নির্দিষ্ট একটি সময় বেঁধে দিয়ে গ্রাহকদের পণ্য বুঝিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল?

যুবক, ডেসটিনি বা ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চোখের সামনেই বেড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে সচেতন মহল থেকে সতর্কও করা হয়। ইভ্যালির ব্যবসার মডেল নিয়েও অর্থনীতিবিদ ও আইনজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ প্রশ্ন তুলছিলেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতারিত হওয়ার আগে তাদের এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন ধরা হয় না বা ধরা যায় না এবং ধরা পড়ার পরে কেন গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পান না—সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীকে গ্রেফতারের পরে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব বলেছে, জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন যে তারা একটা পর্যায়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ভ্যালু কাজে লাগিয়ে বিদেশি কোনও কোম্পানির কাছে বিক্রি অথবা দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা করছিলেন। র‌্যাব জানায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চালু হওয়া ইভ্যালি এখন পর্যন্ত কোনও লাভ করতে পারেনি। অথচ তার অফিস পরিচালনা ও স্টাফদের বেতন বাবদ ব্যয় ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা। যার পুরোটাই গ্রাহকের কষ্টার্জিত বিনিয়োগের অর্থে। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ইভ্যালির মোট দায় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি টাকা। তাদের সম্পদ ছিল ৬৫ কোটি টাকার। নানা পণ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ২১৪ কোটি টাকা। গ্রাহক ও অন্যান্য কোম্পানির কাছে বকেয়া আছে ১৯০ কোটি টাকা।

প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিরা তাদের সহযোগী অজ্ঞাতনামা প্রতারকসহ ইভ্যালির পণ্য বিক্রয়ের নামে নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এক গ্রাহকের তিন লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

সুতরাং, ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীকে গ্রেফতার করা হলো কিনা; তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার কতদিনে শেষ হবে; সেই বিচারে তাদের কী সাজা হবে—তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, যেসব গ্রাহক এরইমধ্যে ইভ্যালির কাছ থেকে পণ্য কিনতে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন কিন্তু এখনও পণ্য বুঝে পাননি, তারা আদৌ সেই পণ্য বা টাকা ফেরত পাবেন কিনা? নাকি এর আগে যুবক ও ডেসটিনির মতো এবারও গ্রাহকরা প্রতারিত হবেন? যদি গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত না পান, তাহলে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী বা চেয়ারম্যানের ফাঁসি হলেও তাতে ভুক্তভোগীদের কিছু যায় আসে না।

এ প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন যে মানুষ কেন ইভ্যালিতে পণ্য কিনতে গেলো? বাস্তবতা হলো, মানুষ সস্তায় পেলে বা বড় ধরনের ছাড় পেলে সেখানে দৌড় দেয়। আবার সবাই এসব অফারের প্রলোভনে পা দেয়ও না। কিন্তু যারা পা দিয়েছেন এবং প্রতারিত হয়েছেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সেই ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো। গ্রাহকদের টাকা বা পণ্য কীভাবে ফেরত দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করা। এর আগে যুবক, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের কর্তারা গ্রেফতার হলেও গ্রাহকরা টাকা ফেরত পায়নি। যদি তা-ই হয়, তাহলে এসব গ্রেফতারের কোনও অর্থ হয় না। বরং গণমাধ্যমে এমন খবরও বেরিয়েছে, জেলখানায় থাকার নামে হাসপাতালের কেবিনে ডেসনিটির কর্ণধার রফিকুল আমিন ‘রাজার হালে’ আছেন। তার মানে প্রতারকরা রাজার হালে থাকবেন আর বিনিয়োগকারী ও গ্রাহকরা অর্থের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবেন! মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার নামে যুবক ও ডেসটিনি এবং সবশেষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিই শুধু নয়, এরকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তারা গ্রেফতার হয়েছেন; নানা মহল থেকে অস্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সেসব সচেতনতা উপেক্ষা করে অনেকেই লোভের বশবর্তী হয়ে কিংবা সস্তায় পণ্য কেনার স্বার্থে এসব ফাঁদে পা দিয়েছেন এবং যথারীতি প্রতারিত হয়েছেন।

ইভ্যালি বা এ ধরনের ই-কমার্স সাইটগুলো যা করছিল, তা যে স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম নয়, এটি ঠিকই বলা হচ্ছিল এবং সতর্ক ক্রেতারা এদের এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু সব মানুষ সাবধান বা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও সতর্ক নন। ইভ্যালির মতো ই-কমার্স উদ্যোক্তারা হয়তো এই জনগোষ্ঠীকেই টার্গেট করেছিলে। এই কথার অর্থ এই নয় যে যারা ইভ্যালি থেকে পণ্য কিনেছেন তারা বুদ্ধিমান নন। নিশ্চয়ই অনেক বুদ্ধিমান লোকও এসব সাইট থেকে পণ্য কিনেছেন বা পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন। তাদের অনেকে পণ্য পেয়েছেন, অনেকেই পাননি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে পণ্য অথবা টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অধিকতর ক্ষীণ হয়ে গেলো কিনা, সে প্রশ্নও গ্রাহকদের মনে আছে।

অস্বীকার করা যাবে না, ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা সবার হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে যাওয়া এবং মানুষের ঘরের ভেতরে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশে দ্রুতই জনপ্রিয় হতে থাক ই-কমার্স সাইটগুলো। বিশেষ করে করোনাকালে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ঘরে সব পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে আরও বিকশিত হতে থাকে ই-কমার্স সাইটগুলো।

অনেক তরুণ এই ই-কমার্সে ব্যবসা করে, তথা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অনেকে বড় উদাহরণও তৈরি করেছেন। বিশেষ করে নারীদের বিরাট অংশ—যারা চাকরির পেছনে না ছুটে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগিয়ে নানারকম ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। কেউ পাইকারি বাজার থেকে কম দামে পোশাক-প্রসাধনীসহ নানারকম ফ্যাশনেবল পণ্য কিনে; কেউ নিজের ঘরে খাবার বানিয়ে বিক্রি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে একত্রে বড় বড় প্ল্যাটফর্মও গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যেহেতু এটি বাংলাদেশে একেবারেই নতুন একটি ধারণা, ফলে এই শূন্য গোয়ালে অনেক দুষ্ট রাখালও ঢুকে গেছে—যারা মানুষকে অবিশ্বাস্য সব অফার দিয়ে বা চটকদার বিজ্ঞাপনে বিমোহিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণার দায়ে অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না।

গত ১৮ আগস্ট আরেকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মূল মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলেছেন গ্রাহকরা। একইভাবে আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, পেপারফ্লাইসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

এ রকম বাস্তবতায় অনলাইন ব্যবসায় একটি গ্রাহক ও ব্যবসাবান্ধব নীতিমালা করা জরুরি। শুধু গ্রাহক নয়, বরং যারা সৎভাবে অনলাইনে ব্যবসা করেন, তাদের স্বার্থেও এ রকম একটি নীতিমালা করা জরুরি। না হলে ইকমার্সের নামে প্রতারণা এবং অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে কিছু লোককে সুবিধা দেওয়া এবং বিনিময়ে বিশাল অংশের মানুষকে প্রতারিত করার প্রবণতা বন্ধ হবে না।

সর্বোপরি, ইভ্যালির গ্রাহকরা যেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য কোনও কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু অতীতের যুবক ও ডেসটিনির অভিজ্ঞতা বলছে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া ইভ্যালির মালিকের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি যা আছে, রাষ্ট্র যদি সেগুলো বিক্রি করেও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে চায়, সেটিও সম্ভব কিনা, তাও নিশ্চিত নয়। তবে মোদ্দা কথা হলো, অফার দেখলেই সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতাও বন্ধ করা দরকার। প্রতারিত হওয়ার পরে হায় হায় করার চেয়ে প্রতারিত যাতে হতে না হয়, সেজন্য লোভটাকেও সংবরণ করা দরকার।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ