X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইরান-চীন চুক্তি ও ভূ-রাজনীতির পালাবদল পর্ব

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৩ জুলাই ২০২০, ১৫:১০আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২০, ১৯:০৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী অতি সম্প্রতি ১৮ পৃষ্ঠার একটি খসড়া চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশিত হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। চুক্তিটি খুব শিগগিরই সম্পাদন করতে যাচ্ছে ইরান ও চীন। নিউইয়র্ক টাইমস আগাম সংগ্রহ করে প্রকাশ করে বড়সড় কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছে। চুক্তিটি দীর্ঘমেয়াদি। ২৫ বছর ধরে চীন ইরানে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু তোয়াক্কা না করে চীন ও ইরান তাদের মধ্যে এই ২৫ বছরের ‘কৌশলগত সহযোগিতার’ চুক্তি নিয়ে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে বলে জানিয়েছেন স্বয়ং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ। তিনি সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইরানের মন্ত্রিসভা চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন করেছে। বাকি রয়েছে দুই দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদন এবং দুই প্রেসিডেন্টের সই। পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য ডজনখানেক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও ইরানের এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য তথা এশিয়ার বিরাট একটি অংশের ভূ-রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দেবে।

ইরানের ওপর আমেরিকা এত কঠিন অবরোধ আরোপ করেছে যে দীর্ঘ ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিটি করে ইরান চেষ্টা করছে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। এই চুক্তিতে ইরানের অর্থনীতি ও সামরিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে এক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ চুক্তি করা হচ্ছে চীনের সঙ্গে। সেই কারণে বলা হচ্ছে, এই চুক্তি সম্পাদিত হলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনীতিতেও কিছুটা পরিবর্তন আসবে।

বলা হচ্ছে, চুক্তি অনুযায়ী ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরও কয়েক ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করবে। আগেই বলেছি, এই বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪শ’ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ হতে পারে। সেই সঙ্গে প্রস্তাবিত চুক্তিতে সামরিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যৌথ প্রশিক্ষণ, মহড়া, গবেষণা, যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের কথা রয়েছে। চুক্তির আওতায় চীন তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষায় ইরানে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে। সুতরাং এই চুক্তি সই হলে, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম সরাসরি চীনা সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

চীনা বিনিয়োগের বদলে ইরান জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে চীনকে অনেক ছাড় দেবে। বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে তেল-গ্যাস পাবে চীন এবং চীনা মুদ্রায় দেওয়া সেই দাম পরিশোধ করতে পারবে। জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুতের হিসাবে ইরান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানি বিক্রি করা তাদের জন্য দুরূহ কাজ হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগের অভাবে তেলক্ষেত্র উন্নয়নের পথও কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে।

১৯৪৫ সালে আইএমএফের জন্মের সময় সদস্য রাষ্ট্রগুলো ডলারকে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের শাসিত রাষ্ট্রগুলো তাদের তেল বিক্রির বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারকে গ্রহণ করে নেয়। এতে ডলার আন্তর্জাতিক বিনিময়ের একমাত্র মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় আমেরিকার হাতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানোর এক ম্যাজিক পাওয়ার এসে যায়।

এই হাতিয়ারকে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে বহু অনাচার করেছে। কথায় কথায় অবরোধ আরোপ করা তার বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। অবরোধ আরোপের মানে হলো যেই রাষ্ট্রটির ওপর অবরোধ জারি করা হলো সে অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে তার বাণিজ্যের সময় বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলার ব্যবহার করতে পারবে না। অনুরূপভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহু দেশকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। ১৯৪৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আইএমএফের স্বীকৃত দ্বিতীয় কোনও বিনিময় মুদ্রা ছিল না।

চীন এখন বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১৫ সালে আইএমএফ চীনের মুদ্রা ইয়ানকে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তেল এবং গ্যাস ব্যবহারের ব্যবসায়ও চীনের মুদ্রা বিনিময় মুদ্রা হিসেবে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। কারণ, ইরানের কাছে বিশ্বের বড় তেল ও গ্যাসের মজুত আছে এবং তার ক্রেতা হলো চীন আর পাকিস্তান। সুতরাং এক্ষেত্রে চীনের মুদ্রা ইয়ান ইরান, পাকিস্তান আর চীনের মধ্যে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে আমেরিকা অবরোধের এই অস্ত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের অগ্রসর হতে দেয়নি অথচ তারাও শিল্পে বিশ্বের উন্নত ছিল। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ‘বাটার সিস্টেম’ চালু করে ব্যবসা করার একটা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। ‘বাটার সিস্টেম’ মানে হচ্ছে বাংলাদেশ রোমানিয়াকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য দিলো। তার বিনিময়ে রোমানিয়া তার দেশে উৎপাদিত সমমূল্যের বল, বেয়ারিং দিলো। মুদ্রা বিনিময় আমদানি-রফতানিতে যত সহজ ছিল, ‘বাটার সিস্টেমে’ তত সহজ ছিল না।

চীনের সঙ্গে ইরানের এই চুক্তিটি সম্পাদিত হলে ভারতের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভাঙন ধরবে। কারণ, এরমধ্যেই ইরানের বেলুচিস্তান উপকূলে চাবাহারে যে বন্দর স্থাপনের কথা ছিল, ভারত তার নির্মাণকাজ স্থগিত করে রাখায় ইরান তা বাতিল করে দিয়েছে। আর চাবাহার বন্দর থেকে যে সড়কপথ ও রেলপথ আফগানিস্তান পর্যন্ত নির্মাণ করার কথা ছিল তাতে ভারত অর্থ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইরান তাও স্থগিত করে দিয়েছে। এখন ইরান চীনের দেওয়া ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় প্রদত্ত ৪০০ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন কাজে ভারতের পরিত্যক্ত কাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করে সমাপ্ত করবে। তাতে ইরানের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণসঞ্চার হবে এবং ইরানের মানুষের হাতে অর্থ যাবে, যা এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন। না হয় ইরানে রাজনৈতিক গণ্ডগোলের আশঙ্কা রয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, চাবাহার বন্দর, রেলপথ নির্মাণকাজে ভারতের ধীরগতির পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভারত আফগানিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক ঠিক রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। আফগানিস্তান স্থলভূমি দ্বারা আবদ্ধ দেশ। চাবাহার বন্দর তার ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য খুবই প্রয়োজন। সুতরাং আফগানিস্তান তেহরানের সঙ্গে বন্দর, রেলপথ নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাবে।

এই চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে চীনের কোনও বাধা নেই, তবে ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, ইরানি জাতি কৌশলগত এই ২৫ বছরের চুক্তি মানবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, জাতিকে না জানিয়ে কোনও গোপন চুক্তি সম্পাদন করা হলে তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যাবে। অবশ্য ইরান সরকার বলেছে, চুক্তিটি মজলিসে শূরায় পাস করা হবে। দেশটির ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করলে চুক্তিটি বাস্তবায়নে কোনও অসুবিধা হবে না। আর  সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির সম্মতি নিয়ে চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে মনে হয়।

ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে আমেরিকা বের হয়ে যাওয়ার আগেও চীন ছিল ইরানের তেলের বৃহত্তম গ্রাহক। দৈনিক এক মিলিয়ন ব্যারেল তেল চীনকে ইরান সরবরাহ করতো। ইরানের জ্বালানিতে বৈচিত্র্য আনা চীনের প্রধান লক্ষ্য। নতুন চুক্তিটি এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চীনকে সাহায্য করবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এই চুক্তি সফল হলে রাশিয়া তুরস্ককে নিয়ে তার গোল্ডেন রিং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই পরিকল্পনায় রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ