X
শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই না যে কারণে

রুমিন ফারহানা
১১ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৫৩আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৫৩

রুমিন ফারহানা কিছু দিন আগে সারাদেশ সোচ্চার ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নানা ব্যর্থতা অদক্ষতা,অযোগ্যতাসহ স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে। করোনাকালীন দেড় বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এতই ‘উদ্ভাসিত’ করে রেখেছিল যে আর সব মন্ত্রণালয়ের ‘বীভৎস’ ব্যর্থতা কারও নজরেই আসেনি। তখনও লিখতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছিলাম, কেবল করোনাকাল বলেই সবাইকে ছাপিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতাটাই আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। না হলে ব্যর্থতার প্রতিযোগিতায় কোনও মন্ত্রণালয়ই পিছিয়ে নেই। করোনা কমে আসায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেমন কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ পাচ্ছেন, তেমনি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা প্রতিদিনই আরও বেশি করে দৃশ্যমান হচ্ছে।

গত ক’দিন ধরে আলোচনা দখল করে আছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি। ইভ্যালি ই-অরেঞ্জ এই প্রতারক কোম্পানিগুলো সম্পর্কে সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে একমাত্র সদস্য হিসেবে প্রশ্ন তুলেছিলাম আমি। বলেছিলাম প্রতিযোগিতা কমিশনের ব্যর্থতা, প্রতিযোগিতা আইনের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে। তবে আমার মূল দাবি ছিল সরকারের ব্যর্থতার কারণে সাধারণ মানুষের যে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, সেই টাকা সরকারকেই ফিরিয়ে দিতে হবে। এরপরেই নড়েচড়ে বসে সরকার, গ্রেফতার হন ইভ্যালির মালিক দম্পতি। তবে টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করে শুরু থেকেই অনবরত অনড় বক্তব্য দিতে থাকেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তার বক্তব্য পরিষ্কার– ‘গ্রাহকরা কম দামে পণ্য কিনতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের (গ্রাহকদের) ক্ষতির দায় সরকার নেবে কেন?’

মন্দ বলেননি বাণিজ্যমন্ত্রী। সরকার কেন দায় নেবে সে আলোচনা ব্যাপক এবং সেই আলোচনা সংসদে আর তারপর আমার একটা কলামে আমি করেছি। আজকে আর সে বিষয়ে কিছু বলছি না। জবাবদিহিতা না থাকলে কোনও দায়ই নেওয়ার দায় পড়ে না, যেমন- কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বেড়ে চলা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ে বহু সমালোচনা হলেও তার ব্যাখ্যা দেওয়া কিংবা দাম নিয়ন্ত্রণের ন্যূনতম কোনও চেষ্টা সরকারের তরফে দেখা যায়নি। মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই দায় বর্তায় বাণিজ্যমন্ত্রীর ওপর। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে টুঁ-শব্দটি তার মুখ থেকে পাওয়া যায়নি।

করোনা অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো। সানেমের রিপোর্ট বলছে, ৪২ শতাংশ মানুষ চলে গেছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। সরকারি সংস্থা বিবিএস বা বিআইডিএসের রিপোর্টও এর চাইতে ভিন্ন কিছু নয়। করোনায় আর্থসামাজিক কাঠামো পাল্টে মধ্যবিত্তের অনুপাত এখন ৭০ শতাংশ থেকে নেমে ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে আর দরিদ্র ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে, যদিও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এই বিষয়গুলো মানতে নারাজ। 

ইদানীং বাজারে গেলে জ্বর আসে। আমার যদি এই অবস্থা হয়,যারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র অবস্থায় আছেন,তাদের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। গত বছর অক্টোবরে যে পরিমাণ তেলের দাম ছিল ৫০৫ টাকা, এখন তা কিনতে ৭০০ টাকা লাগে। গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও সবজির দাম। পেঁয়াজের দাম মোটামুটি দ্বিগুণ হয়ে গেছে।  দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজিতে কেনা যেত, তা কিনতে এখন লাগছে ৮০ টাকা। কোনও উৎসব বা উপলক্ষ নেই, তবু ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ টাকা ছুঁয়েছে, যা সাধারণত ১২০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে থাকে। 

টিসিবির ২০২০ সালের ১ মার্চ ও গত বৃহস্পতিবারের বাজার দরের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সে সময়ের তুলনায় এখন মোটা চালের গড় দাম সাড়ে ৩১ শতাংশ, খোলা আটার ২০, খোলা ময়দার ৩৩, এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ৪৩, চিনির ১৯, মোটা দানার মসুর ডাল ৩০ ও গুঁড়া দুধের ১৩ শতাংশ বেশি।

বাজারে মোটা চালের দাম ৫০ টাকা ছুঁয়েছে। এলপিজির দাম এখন প্রতি মাসেই সমন্বয় করে বিইআরসিই। গত কয়েক মাসে গড়ে ১০০ টাকার মতো দাম বাড়ছে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম। সর্বশেষ দাম নির্ধারিত হয়েছে ১২৫৯ টাকা। আমরা কে না জানি,অন্য সময়ের মতোই মানুষকে এলপিজি’র নির্ধারিত মূল্যের ১৫/২০ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হবে।

মানুষ বাঁচবে কীভাবে? জীবনে চলতে গেলে সবকিছুর সমান প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এতক্ষণ যে জিনিসগুলো নিয়ে কথা বললাম তার যে কোনোটি মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। সমাজের একেবারে প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে উঁচুতলার মানুষ, কেউ বাদ নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, কোনও জিনিসের দাম ২০ টাকা বাড়লে উচ্চবিত্তের ওপর তার যে প্রভাব, নিম্নবিত্ত বা প্রান্তিক মানুষের ওপর তা কয়েকগুণ বেশি।

ঢাকা এবং সারাদেশের কিছু স্থানে দিনের কিছু সময় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো নরনারীদের বেশ ভিড় দেখা যায়। এখন করোনার ঝুঁকি তুলনামূলক কম, কিন্তু যখন প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছিল তখনও তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দাঁড়াতো সেসব লাইনে। এই মুহূর্তে এমন ভিড় হওয়ার স্থান ঢাকাসহ সারাদেশে আছে ৪০০টি। হ্যাঁ, এগুলো হচ্ছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করা টিসিবি’র ট্রাক। বাজার মূল্যের চেয়ে কিছুটা কম মূল্যে তেল, চিনি, পেঁয়াজের মতো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ায় অসংখ্য মানুষ।

টিসিবি’র ট্রাকের পেছনের এই লাইন শুরু হয় ট্রাক আসার অনেকটা আগে থেকেই। আর বলা বাহুল্য, প্রয়োজনের তুলনায় এই সেবা অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় সব সময়ই ট্রাকের পণ্য শেষ হয়ে যায়, কিন্তু লাইনে থেকে যায় পণ্য না পাওয়া মানুষ। এমন পণ্য বিক্রি আগেও হয়েছে, কিন্তু গত দুই বছরে এতে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে– অনেক মধ্যবিত্তও এখন এই ট্রাকের পেছনের লাইনে দাঁড়ান। যেতেন আরও অনেক মধ্যবিত্ত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে চক্ষুলজ্জায় যেতে পারেন না অনেকে। এমন তথ্যও এসেছে, পরিবারের স্বামী-সন্তান কেউ রাজি না থাকায় শেষমেশ লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে বয়স্ক গিন্নিকে।

নিত্য ব্যবহার্য পণ্যগুলোর অধিকাংশই আংশিক বা প্রায় সম্পূর্ণরূপে আমদানি নির্ভর। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে এগুলোর মূল্য ওঠানামার সম্পর্ক আছে। করোনাকালে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া, উৎপাদন কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দেশের মজুত প্রবণতা পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতেও কি সরকার তার হাতে থাকা সব ক্ষমতা ব্যবহার করে মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে? প্রশ্নটি সরকারের সদিচ্ছার, আর কিছু নয়।

এই দেশে বাস করে আমরা ভালোভাবেই জানি বৈশ্বিক বাজারে কোনও পণ্যের মূল্য যা বাড়ে, কারসাজির মাধ্যমে দেশের বাজারে বেড়ে যায় তার চাইতে অনেক বেশি। সেই বাজার কারসাজির বিরুদ্ধে কখনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই এসবের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি ভারতে পেঁয়াজের মূল্য সামান্য বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কারসাজির কারণে যে স্রেফ দ্বিগুণ হয়ে গেলো, সেটা রোধকল্পে সরকার কি আদৌ কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে? অতীতেও পেঁয়াজের এই ঝাঁজের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকেই একই রকম উদাসীন দেখা গেছে।

এমনকি বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কর কমানোর মতো পদক্ষেপ নিতেও সরকার অনীহ। দীর্ঘদিন থেকে ভোজ্যতেল এবং চিনির মূল্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সংকট তৈরি করলেও আজ পর্যন্ত এই দুই পণ্যে পুরো কর ছাড় কিংবা নিদেনপক্ষে কমানোর পদক্ষেপ সরকার নেয়নি।

ব্যর্থ মন্ত্রীর পদত্যাগ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর খুব স্বাভাবিক চর্চা। আবার কিছুটা কম বিকশিত গণতান্ত্রিক দেশেও জনগণ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের চাপে ব্যর্থ মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে হয়। আমাদের দেশে এই চর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। আবার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সময়ে এই আশা আরও দূরীভূত। পদত্যাগ করা মানে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা, তাই বর্তমান সরকার জনগণের সামনে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করবে না। সবদিকে চরম ব্যর্থ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে আমরা কিছু দিন আগেই সেটা দেখলাম। আর যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন কিংবা এখন যদি বাণিজ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন, তাতেও পরিস্থিতির ন্যূনতম উন্নতি আমি আশা করি না। কারণ, এই দেশের সব সেক্টরে যত সমস্যা-দুর্নীতি আছে সেগুলোর সঙ্গে খুব প্রভাবশালী মহল জড়িত। তাই এই সিস্টেম না পাল্টালে ব্যক্তির পরিবর্তন আদৌ ফলপ্রসূ হবে না। বাজারে আগুন লেগে মানুষের জীবন পুড়তে শুরু করলেও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সির পদত্যাগ চাই না আমি এই কারণেই।    

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কলমবিরতির দ্বিতীয় দিনে অচল আমদানি-বাণিজ্য, রাজস্ব খাতে স্থবিরতা
কলমবিরতির দ্বিতীয় দিনে অচল আমদানি-বাণিজ্য, রাজস্ব খাতে স্থবিরতা
মাত্র ৪ প্রেক্ষাগৃহে কেন জয়ার সিনেমা!
এ সপ্তাহের সিনেমামাত্র ৪ প্রেক্ষাগৃহে কেন জয়ার সিনেমা!
দুঃসময় কাটিয়ে চার বছর পর প্রিমিয়ার লিগে আরামবাগ
দুঃসময় কাটিয়ে চার বছর পর প্রিমিয়ার লিগে আরামবাগ
চিঠি
চিঠি
সর্বশেষসর্বাধিক