X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ডাক্তার ভালো, সেবা নিম্নমানের

আনিস আলমগীর
১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৬:২৭আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৭:১৭
আনিস আলমগীর পিত্তথলীতে পাথর জমেছিল চারটি। ফেলবো কার দ্বারা– এই নিয়ে বহু চিন্তার পর ঠিক করলাম মগবাজারের একটি হাসপাতালে একজন অধ্যাপককে দিয়ে অপারেশনটি করাবো। কারণ, অনেকে তাকে দিয়ে অপারেশন করানোর সুপারিশ করেছেন। এই সেক্টরে তার অনেক নাম। সপ্তাহে প্রায় ২০ জনের গলব্লাডারের পাথর অপসারণ করেন তিনি। নির্ধারিত দিনে, ডাক্তারদের অনেক আন্তরিকতায় অপারেশনও হলো। কিন্তু অপারেশনের পর একটি হাসপাতালকে আমি যেমন কল্পনা করি, দেখলাম তার থেকে অনেক পিছিয়ে আছে এই হাসপাতালটি। নার্স, ওয়ার্ডবয় রোগীর ডাকে যথাযথ সাড়া দেয় না।

সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি হাসপাতালটি রোগীদের কোনও খাবার দেয় না। তাদের রিসেপশনের পাশে একটি খাবার দোকান আছে সত্য কিন্তু তা রোগীদের খাবার উপযোগী না। এমনকি রাতে স্যুপ চেয়ে পেলেও, সকালে বললো স্যুপ শেষ হয়ে গেছে। অথচ আমাকে তরল খেতে হবে এটা ডাক্তারের নির্দেশ। পরদিন বিদায় বেলায় অধ্যাপক যখন দেখা করে বললেন, আমি চাইলে বাড়ি ফিরতে পারি, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, যদিও কমপক্ষে আরও একদিন আমার থাকার দরকার ছিল।

আমি যখন অধ্যাপক সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম এই হাসপাতালের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? তিনি বললেন, আমি এর চেয়ারম্যান। আমি বললাম মাইন্ড করবেন না, আপনি এত ভালো একজন ডাক্তার কিন্তু আপনার হাসপাতালের সেবা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তিনি সহাস্যে বললেন, ঠিক আছে আমরা রোগীদের ফিডব্যাক গ্রহণ করি।

বাসায় ফিরে এক পরিচিত ডাক্তারকে জানালাম বিষয়টা। তিনি বললেন, বাংলাদেশের সিংহভাগ হাসপাতালের একই দশা। ডাক্তার ভালো কিন্তু সেবার মান এত নিচুতে যে রোগী সন্তুষ্ট হতে পারে না। ধরেন সরকারি হাসপাতালে আপনার রুমে একটি বিড়াল হেঁটে গেলো, ওতে আপনার কোনও ক্ষতি নেই কিন্তু মানসিকভাবে আপনি তা মেনে নিতে পারবেন না। সরকারি হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ডবয় আর বেসরকারি হাসপাতালের ওই সেবা কর্মীদের স্বভাব একই রকম প্রায়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে চিকিৎসা শুধু চিকিৎসক দিয়ে হয় না। ডাক্তার এবং হাসপাতালের আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অপারেশনের পর রোগীর রুমে এসির শব্দ হচ্ছে, কিংবা এসি থেকে পানি পড়ছে, রুমে টিভি আছে কিন্তু রিমোট ভাঙা, বাথরুমে যথাযথ কমফোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না, বয়স্ক রোগী হলে তার জন্য বাথরুমে বসার জন্য এক্সট্রা হাতল নেই- এসব ছোটখাটো বিষয় রোগীর মানসিক অবস্থার বিঘ্ন ঘটাতে পারে। সুস্থতার একটা আনন্দ আছে। বাংলাদেশের হাসপাতালে রোগী সেই আনন্দ পায় না, চিকিৎসা হয়তো ঠিকই পায় বা কখনও সেটাও পায় না।

সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা অন্যান্য দেশে গিয়ে রোগীরা কেন খুশি হয়? কারণ, হাসপাতালের অবকাঠামোগত সুবিধা, আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনা সবকিছু মিলে তাকে শান্তি দিয়ে থাকে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের হাসপাতালগুলোতেও বাংলাদেশিরা যথেষ্ট যাচ্ছে। শিলিগুড়িতে, আগরতলায় সীমান্ত এলাকার লোকজন চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে, এমনকি রাঙ্গামাটির লোকজন মেঘালয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা নিতে। আর্থিক সামর্থ্য আমাদের থেকে সেখানকার স্থানীয়দের যে খুব ব্যবধান আছে তা নয় কিন্তু তৃপ্তি পাওয়ার জন্য, চিকিৎসায় আনন্দ পাওয়ার জন্য রোগীরা সেখানে যাচ্ছে।

এসবের সঙ্গে চিকিৎসার কোনও সম্পর্ক নেই কিন্তু রোগী এই সেবা নেওয়ার জন্যে টাকা দিচ্ছে। রোগীর মানসিক আনন্দ হবে না যতক্ষণ ‘হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট’ সেটা দিতে পারবে। এই কারণে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট গুরুত্ব দেওয়া হলেও বাংলাদেশে এ বিষয়টি অনেক অবহেলার মধ্যে আছে। সরকার অনেক জায়গায় হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের জন্য ডাক্তারদের এই দায়িত্ব দিয়েছেন, অথচ সেই ডাক্তার হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছেন কিনা তার হদিস নেই।

আপনি কলকাতা কিংবা মাদ্রাজের হাসপাতালগুলোতে ব্যবস্থাপনায় কোনও ডাক্তারকে পাবেন না। সেখানে ব্যবস্থাপনায় দক্ষ অন্য পেশার লোকরাই আছে। ম্যানেজমেন্টে যদি ডাক্তার পেয়ে থাকেন তিনিও ব্যবস্থাপনায় একজন দক্ষ ব্যক্তি হয়ে সেই পেশা নিয়েছেন এমবিবিএস পাস করে। এমবিবিএস পাস করার পর ডাক্তাররা বিভিন্ন স্পেশাল সেক্টর বেছে নেন। বাংলাদেশেও অনেক ডাক্তার হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেন কিন্তু সরকার হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে এদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয় না বলে কেউ আর এটা পড়তে আগ্রহী হয় না। অথচ যুগের প্রয়োজনে এটি সবচেয়ে বেশি দরকারি ছিল আমাদের।

একটি হাসপাতাল যদি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মতো লম্বা হয় তাহলে রোগীর কাছে গরম খাবার পৌঁছানোর জন্যও ব্যবস্থাপনার দক্ষতার প্রয়োজন, গোলাকার হলে আরেক রকম ব্যবস্থাপনা, এমনকি হাসপাতালের ফ্রিজে রাখা মাছ-মাংস কতদিন রাখা যাবে সেটাও ব্যবস্থাপনার অংশ। এগুলো পড়ানো হয়।

বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাপনা বিষয়টি যে কত গুরুত্বহীন তার প্রধান প্রমাণ ডিজি হেলথ অফিস। সেখানকার বর্তমান ডিজি বা প্রধান কর্তা একজন সার্জন। তার দুই প্রধান সহযোগীর একজন মেডিসিনের ডাক্তার, আরেকজন রোগ তত্ত্ববিদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সর্বোচ্চ জায়গায় যদি এই অবস্থা হয়, অন্যদিকের কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ডিরেক্টর দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য হাসপাতালেও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় পড়া নেই এমন ডাক্তারদের বসানো হয়েছে। আমলারা অবশ্য এক্ষেত্রে ডাক্তারদের দায়ী করেন। তাদের মতে, ডাক্তাররা চায় না এসব পদে অন্যরা যাক। কিন্তু কেউ চাইলেই কি সরকার তাকে বসিয়ে দেবেন? একটি টিভি স্টেশনের একজন ক্যামেরাম্যান কিংবা বিজ্ঞাপন ম্যানেজার চাইলেই তাকে হেড অব নিউজ বানানো যাবে?

বিজ্ঞাপন ম্যানেজার থেকে একটি টিভির সিইও পদ দখল করা ব্যক্তি কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে বেকুবের মতো একটি প্রশ্ন করে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন- সংবাদের জন্য সংবাদের লোক দরকার। প্রমাণ তো সব আমাদের হাতেই আছে।

এখন প্রশ্ন আসে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বেশি সংখ্যক ডাক্তার পড়তে আগ্রহী নয় কেন? কারণ সহজ, সরকার এই পড়াকে কোনও গুরুত্ব দেয় না। চিকিৎসক, কৃষিবিদ এবং শিক্ষকরা আমলাদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে বেতন সমান পান সত্য, কিন্তু তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা কোথায়? একজন ডিএস মর্যাদার আমলা সরকারি গাড়ি পায় কিন্তু অন্য পেশার সরকারি কর্মকর্তারা পান না কেন? তাদের কি সরকারি মোবাইল ফোনের দরকার হয় না? আসলে সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড পেশায় পেশায় দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখেছে। চিকিৎসকরা কেন আমলা, পুলিশ, সাংবাদিকদের বাঁকা চোখে দেখেন? পাঁচ বছর এমবিবিএস পড়ে একজন ইনটার্নি ডাক্তার কী করে রোগীর স্বজনদের গায়ে হাত তোলে? ৫০০ ছাত্রের ৫০ জনও যদি এই ‘মাস্তানি’ শিখে বের হয় তাহলে চিকিৎসা যে একটি সেবামূলক পেশা- এই সিলেবাসে কি তা পড়ানো হয়নি!

আমাদের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার পাশাপাশি সেবার মান বাড়াতে হলে অবশ্যই যেসব ডাক্তার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পড়েননি তাদের ধীরে ধীরে প্রশাসনিক পদ থেকে সরাতে হবে। সরকারি হাসপাতালের অনুকরণে বেসরকারি হাসপাতালেও এই ব্যবস্থাপনা চলছে। একজন ডাক্তার এক ঘণ্টা পরিশ্রম করে যতজন রোগীর জীবন রক্ষা করবেন, সেই একঘণ্টা তিনি নার্স কোথায়, ওয়ার্ডবয় কি করছে, ডাস্টবিন কেন পরিষ্কার নয়- তা দেখতে যাবেন? আমাদের যেসব বিশেষায়িত জাতীয় হাসপাতাল আছে তার উচ্চ পদে ডাক্তাররাই বসে আছেন। সে কারণে সেখানে সেবার মান নিয়ে জনগণের অসন্তোষের শেষ নেই। অবিলম্বে সরকারের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দেওয়া দরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
জাহাজেই দেশে ফিরবেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক
জাহাজেই দেশে ফিরবেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা, টানা ৪ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
তাপপ্রবাহের গেটওয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা, টানা ৪ দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের গল্প বাংলাদেশের পর্দায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ