X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জায়েদ আউট নিপুণ ইন: সিনেমা কোথায় দাঁড়ালো?

রেজানুর রহমান
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:৩৫আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:৩৫

রেজানুর রহমান লাগ ভেলকি লাগ, অন্তর মন্তর ছুঁ... এটা হলো জাদুকরের ভাষা। ভালো লাগুক, না লাগুক, বুঝি অথবা না বুঝি, জাদুর প্রতি সবারই একটা ঝোঁক আছে। আর তাই জাদু দেখার জন্য মানুষের অভাব হয় না। তেমনি সিনেমাও হলো এক ধরনের জাদু। পর্দায় মানুষেরা দৌড়ায়, হাসে কাঁদে, প্রেম করে, ধর্ষণ করে, খুনোখুনি করে, মারামারিতে লিপ্ত হয়। সিনেমার নায়ক একাই একশ’। সে একাই হাজার মানুষের সঙ্গে লড়াই করে। ইচ্ছে করলো এক লাফে ৫০ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে যায়। আবার ইচ্ছে করলে ৫০ তলা বিল্ডিং থেকে চুইং করে নিচে নেমে আসে অথবা আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ায়। সিনেমার গরু গাছেও ওঠে। আর নায়িকা যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুন্দরী। তার চোখ, মুখ, হাসি কান্নায় কী যে এক মোহ... দর্শক তাই পাগল হয়ে যায় নায়িকার জন্য। আহা! একবার যদি ছুঁয়ে দেখতে পারতাম। নায়িকা রক্ত মাংসের মানুষ তো। নায়িকা এত সুন্দরী হয়? পেতে চাই তাকে। আহা সুন্দরী তোমার জন্যও মরতে পারি...।

আমাদের সিনেমার বর্তমান অবস্থা দেখে অবশ্য অন্যরকম একটা প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। আমরা কি সত্যিকার অর্থে আমাদের সিনেমাকে ভালোবাসি? প্রায় এক মাস ধরে দেশের সিনেমা অঙ্গনে যা ঘটছে তা কীসের ইঙ্গিত? আমরা কি সিনেমাকে ভালোবেসে সত্যিকার অর্থে এত লড়াই করছি? প্রসঙ্গক্রমে একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ঝড়ের রাতে একটি গাছের নিচে চাপা পড়েছেন একজন পথচারী। একটি মোটা গাছ তার কোমরের ওপর পড়েছে। অসহায় লোকটি বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। তার কোমর থেকে গাছটি সরিয়ে নেওয়ার আকুতি করছে। তাকে বাঁচানোর জন্য উৎসাহী, উদ্বেগাকুল লোকজন ঠিকই দৌড়াদৌড়ি করছে। কিন্তু দৌড়ের মধ্যে লোকটিকে আগে কীভাবে চাপা পড়া গাছ থেকে উদ্ধার করা যায় তা নিয়ে কারও মধ্যে কোনও টেনশন নেই, গুরুত্বও নেই। বরং গাছটি কার জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কোন সংস্থা অথবা কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে গাছটির অবস্থান, এটা যাচাই করার জন্য ছুটাছুটি চলছে। আহারে! সে যে কি ছোটাছুটি? চাপা পড়া মানুষটিকে বাঁচানোর সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা সবার। তবু সেই অসহায় মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। গাছটি কার অধীনে, কে সরাবে এই গাছ? এই তর্ক করতে করতেই অসহায় মানুষটি মারা যায়।

আমাদের সিনেমাকে ওই চাপা পড়া মানুষটির মতোই অসহায় মনে হচ্ছে। সিনেমার প্রতি ভালোবাসায় আমরা কিনা করছি? নির্বাচন করছি, দলাদলি করছি। অমুক বড়, তমুক ছোট, আমি ভালো, সে ভালো না, আমিই শ্রেষ্ঠ, সে তুচ্ছ, ওকি জানে? আমিই সব জানি... এমনই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের লড়াই চলছে সিনেমা পাড়ায়। সবই নাকি সিনেমার উন্নয়নের জন্য। অথচ দেশের প্রায় সব সিনেমা হল বন্ধ। নতুন সিনেমা নির্মাণের তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। এফডিসিতে কবে কোন দিন কোন নতুন সিনেমার জমজমাট শুটিং হয়েছে তা বোধকরি নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক, এমনকি টেকনিশিয়ানরাও তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারবেন না। অথচ সিনেমার নামে চলছে এক ধরনের তামাশা। কেউ কেউ এই তামাশাকে সুনামির সঙ্গেও তুলনা করছেন। একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে, এই যে দেশের সিনেমা অঙ্গনে এত আন্দোলন হচ্ছে, এতে সিনেমার কতখানি উন্নতি হবে?

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরেই মূলত আমাদের সিনেমার দুরবস্থা মারাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে। নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এর আগে নির্বাচনি প্রচারণায় এক ধরনের উদ্বেগ-উত্তেজনা প্রকাশ পেলেও নির্বাচনের দিন শিল্পীদের মধ্যে বেশ ভালোই সদ্ভাবের পরিবেশ দেখা গেলো। দুই একজন বাদে সবার মুখেই ঐক্যের সুর। ক্ষয়ে যাওয়া সিনেমাকে বাঁচিয়ে তোলার স্পষ্ট শপথ দেখা গেলো সবার চোখে-মুখে। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, যা কিছু সামনে থেকে দেখা যায় তাই প্রকৃত সত্য নয়। সত্যের আড়ালেও কিছু মিথ্যা লুকিয়ে থাকে। কিছু অনিয়ম, অনাচার সত্যের মাঝে লুকিয়ে থেকেই সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। তাই বলে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা যায় না। সেটাই ঘটলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে। টাকা দিয়ে ভোট কেনাসহ নানা অভিযোগ উঠলো নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। ভাবা যায়, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির মতো একটি মর্যাদাবান সমিতির ভোটও টাকা দিয়ে কেনা যায়? যিনি টাকা দিয়ে ভোট কিনলেন তার আদর্শ উদ্দেশ্য হয়তো বেশ পরিষ্কার। পাশাপাশি যারা টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রি করলেন তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্যও কি পরিষ্কার?

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে এর আগেও ভোট কেনার নজির রয়েছে। অভিনয়ের সঙ্গে কোনও যোগসূত্র নেই এমন অনেক শিল্পীকে যাতায়াত ভাড়াসহ বাড়তি টাকা পাঠিয়ে ঢাকায় এনে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবারের নির্বাচানেও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

শেষ খবরে দেখা গেলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহানের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বোর্ডের রায়ে টাকা দিয়ে ভোট কেনাসহ আরও কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জায়েদ খানের সাধারণ সম্পাদক পদের  প্রার্থিতা বাতিল করে নিপুণকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঘোষণা শুনে আনন্দে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন নিপুণ। তিনি বলেন, সত্যের জয় হয়েছে। এ সময় আপিল বোর্ডের সামনে জায়েদ খান উপস্থিত ছিলেন না। তবে প্রচারমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘এই ঘটনা হাস্যকর’। তার স্পষ্ট মন্তব্য- ‘তাদের (আপিল বোর্ড) এমন সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনও অধিকার নেই। আপিল বোর্ড ৩০ জানুয়ারি থেকেই ডিজলভ। কারণ, ওই দিন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করে স্বাক্ষর দিয়ে তারা তাদের কাজ শেষ করেছেন। ৫ দিন পর কেন এই সিদ্ধান্ত? কোন ক্ষমতায় এটি হলো?

জায়েদ খান আরও একটি রহস্যজনক মন্তব্য করেছেন- ‘এখনই সব শেষ নয়’। তার মানে ঘটনা আরও আছে? তার মানে কি আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা সেই চাপা পড়া মানুষটির মতো হয়ে যাবে? ক্ষমতার লড়াইয়ে শত্রু শত্রু খেলায় শেষ পর্যন্ত সিনেমা এই দেশে টিকে থাকবে তো?

আজকের এই লেখাটি এখানেই শেষ করা যায়। কিন্তু কয়েকটি প্রসঙ্গ তুলে ধরতে চাই। আমরা কি সত্যি সত্যি দেশের সিনেমার উন্নয়ন চাই? আমরা যারা দর্শক তারাও কি খুব সৎ? দেশের সিনেমা কি দেখি আমরা? ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের দিন এফডিসির সামনের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের ভিড় দেখে অবাক হয়েছি। চিত্রতারকাদের একনজর দেখার জন্য সবার সে কি আপ্রাণ চেষ্টা। এই মানুষগুলো সিনেমা হলে যায় না কেন? অনেকে হয়তো এই প্রশ্নের দায়সারা উত্তর দেবেন। বলবেন, এই দেশে আদৌ সিনেমা হয় নাকি? তাদের উদ্দেশে বলি, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো শেষ কবে হলে গিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা দেখেছেন? শতকরা ৯০ জন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ, আমরা না বুঝে, না দেখে যেকোনও বিষয়েই হুট করে মন্তব্য করে ফেলি।

এবার আসি আমরা যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করি অর্থাৎ পরিচালক, শিল্পীদের কথায়। এফডিসিতে শেষ কবে একটি জমজমাট চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে তা বোধকরি অনেকেই বলতে পারবেন না। অনেকেই হয়তো করোনাকালের দোহাই দেবেন। বলবেন, করোনার কারণে পিছিয়ে আছি। এটাই কি প্রকৃত সত্য? এই করোনাকালেও পাশের দেশে কলকাতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন সিনেমা নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। দেশের একাধিক শিল্পী কলকাতায় গিয়ে সিনেমায় অভিনয় করেছেন এবং করছেন। ওরা পারলে আমরা কেন পারি না? দায়টা কার?

১৮৪ জন শিল্পী তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলন করেছেন। তারা ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছেন। এবার তারা কী করবেন? সিনেমা কোথায়? তাদের অভিনয়ের সুযোগ কই? তাহলে কি তারা ভোটের রাজনীতির অংশ হয়েই থাকবেন?

শেষে ক্ষমা চেয়েই প্রচারমাধ্যমের বন্ধুদের উদ্দেশে কিছু কথা বলি। এবার শিল্পী সমিতির নির্বাচন উপলক্ষে দেড় শতাধিক সংবাদকর্মী নির্বাচন কাভার করার সুযোগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ অনলাইন মাধ্যমের কর্মী। এটাই যুগের দাবি। কিন্তু একটা ছোট্ট প্রশ্ন- এই যে এত সংবাদকর্মী বিনোদন মাধ্যমে কাজ করছেন সবাই কি বিনোদন মাধ্যমকে ভালোভাবে জানেন? একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বছর দুয়েক আগে দেশের একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর লাশ এফডিসিতে আনা হয়েছে। একজন তরুণ সংবাদকর্মী আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি উপস্থিত তারকা শিল্পীদের দুই একজন বাদে আর কাউকেই ভালোভাবে চেনেন না। এজন্য আমার কাছে সহযোগিতা চাইছেন। আমি যেন উপস্থিত তারকাদের নাম তাকে বলে দেই। একটি অনলাইন মিডিয়ার প্রতিনিধি তিনি। অথচ তারকাদের ভালো করে চেনেন না। এই ব্যর্থতা কার? এই যে দেড় শতাধিক মিডিয়াকর্মী শিল্পী সমিতির নির্বাচন কাভার করলো, নির্বাচনি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘোরাফিরা করলো, তাদের মধ্যে সবাই কি দেশের বিনোদন মাধ্যমকে ভালোভাবে চেনেন, জানেন?

নির্বাচনের দিন হিরো আলম এফডিসিতে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিকে দেখলাম ক্যামেরাপারসনসহ হিরো আলমের পেছনে পেছনে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন। অথচ দেশের নামকরা তারকা শিল্পীরা যখন এফডিসিতে ঢুকলো তখন তেমন কাউকে তৎপর হতে দেখা গেলো না। এই ধরনের সাংবাদিকতা আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সেটাও একটা জরুরি প্রশ্ন।

শেষ প্রশ্নটা আমাদের সবার জন্য। একটি জাতীয় দৈনিক শিরোনাম করেছে ‘জায়েদ আউট নিপুণ ইন’। কেউ গেলেন, কেউ এলেন, আমাদের সিনেমা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে গেলো আমরা কি আদৌ বুঝতে পারছি?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার সম্পাদক আনন্দ আলো।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
‘হিট ইমারজেন্সি’ জারির আহ্বান সাইফুল হকের
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ